টিভি সাংবাদিকতা : আমার স্বপ্ন ও ভাবনা
- আপডেট সময় : ০৭:৪৯:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ অগাস্ট ২০২০
- / 2315
করোনা ভাইরাসের আবহে বিশ্বজুড়ে যখন থমকে আছে জীবন, তখন অতীতকালের স্মৃতিতে ডুব দিতে মন চাইছে। মন বলছে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে নিজের কিছু না বলা কথা পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করি। আর সে কারণেই আপনাদের জ্ঞাতার্থে আমার আজকের এই লেখা। খুব মনে পড়ে আমি যখন স্কুলে পড়ি , আমাদের সাদা – কালো টিভিতে সংবাদ দেখার সময় আমার আম্মা সব সময় বলতেন, “আমার ছেলেদের মধ্যে একজন যদি টেলিভিশন সংবাদ পাঠক হতে পারতো”! উনি প্রায়শই এ কথা বলতেন। তখন থেকেই বড়ো ছেলে হিসেবে আমি মনে মনে পণ করেছিলাম, আল্লাহ চাহেনতো আমি একদিন টিভি সংবাদ পাঠক হবার চেষ্টা করবো। আম্মার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমার টিভি সংবাদ পাঠক হবার যাত্রা শুরু সেই স্কুল জীবন থেকেই।
পড়াশুনার পাশাপাশি রোজ টিভি সংবাদ দেখতাম। সে সময়ের বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক / পাঠিকা – সিরাজুল মজিদ মামুন, রোকেয়া হায়দার, সরকার কবির ,শামীম আহমেদ, রাশেদ নিজাম , আয়েশা জায়গীরদার, পরবর্তীতে তাহমিনা শাহাবুদ্দিন, আসমা আহমেদ এদের সবার সংবাদ পাঠ মনোযোগ সহকারে শুনতাম। একটা সময় এমন হলো যে, তাদের কণ্ঠ অবিকল নকল করতে পারতাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা খবরের কাগজ থেকে সংবাদ পাঠের আদলে অংশ বিশেষ পাঠ করতাম। আমার ছোট দুই ভাই এ নিয়ে আমার সাথে অনেক সময় হাসাহাসি করতো। কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কখনো বাড়িতে কিংবা বাড়ির সামনের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে রেডিওতে বিবিসি বাংলা বিভাগ, লন্ডন থেকে প্রচারিত প্রবাহ অনুষ্ঠান নিয়মিত শুনতাম। নুরুল ইসলাম, সিরাজুর রহমান, দীপঙ্কর ঘোষ, সৈয়দ মাহমুদ আলী, মানসী বড়ুয়া, শামীম চৌধুরী – এদের সবার সংবাদ পঠন আমার ভীষণ ভালো লাগতো। তাছাড়া ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ থেকে যে কণ্ঠগুলো ইথারে ভেসে আসতো, তার মধ্যে বিশেষ করে অনুকরণ করতাম কাফি খান আর ইকবাল বাহার চৌধুরীকে।
আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৮৯ সালে ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার ও অনুষ্ঠান উপস্থাপক হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেয়ার এবং পরবর্তীতে বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকাতে কাজ করার। কিন্তু তখন পর্যন্ত টিভিতে সংবাদ পড়ার আমার আম্মার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৯৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সেই স্বপ্নের সুযোগটি আসে। ব্রিটেনে প্রথম বাংলা টিভি চ্যানেল- “বাংলা টিভি” সংবাদ পড়ার জন্য অডিশনের আয়োজন করে। অডিশনে টিকে যাই। আম্মার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ পার হলাম সে দিন। ১৬ সেপ্টেম্বর “বাংলা টিভি” আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের যাত্রা শুরু করে। আমার স্মৃতি যদি ভুল করে না থাকে তাহলে যতটুকু মনে পড়ে প্রথম দিন আহসানুল হক ও শাহীন জামান সংবাদ পাঠ করেছিলেন। সম্ভবত দ্বিতীয় দিন উর্মি মাজহার আর আমি সংবাদ পাঠ করি ।আর এভাবেই আম্মার স্বপ্ন পূরণে আমার চুড়ান্ত যাত্রার শুভ সূচনা ঘটে। আরম্ভ হয় টিভি সংবাদ পাঠে আমার পথ চলা। এর পর আম্মা যখন লন্ডনে বেড়াতে এলেন, টিভিতে আমাকে সংবাদ পড়তে দেখে তাঁর চোখে – মুখে যে আনন্দের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছিলাম এখনো আমার তা কাঁচের মতো পরিষ্কার মনে আছে। সেদিন আম্মাকে খুশি করতে পেরে মনে হয়েছিল যেনো বিশ্ব জয় করেছিলাম। উল্লেখ্য ২০০৩ সালে বাংলাদেশে বেড়াতে যাবার পর “এ টি এন বাংলায় ” সংবাদ পাঠ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। আম্মা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আত্মীয়দের ফোন করে তাঁর ছেলের সংবাদ পাঠের খবর দিয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ে নঈম নিজাম তখন “এ টি এন বাংলার ” নিউজ এডিটর ছিলেন।
আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ একটা আর্ট বা শিল্প। সংবাদ উপস্থাপনায় অবশ্যই সুন্দর কণ্ঠ, শুদ্ধ উচ্চারণ ও চমৎকার বাচনভঙ্গি থাকা অত্যাবশ্যকীয় । সে সাথে উপস্থাপকদের হতে হবে স্মার্ট এবং প্রেজেন্টেবল। প্রয়োজন যোগ্যতা, আত্মবিশ্বাস, মনোবল, সংবাদের জ্ঞান ও আগ্রহ । নিতে হবে যথাযত প্রশিক্ষণ। সংবাদ উপস্থাপকদের রপ্ত করতে হবে প্রমিত উচ্চারণ, সংবাদ উপস্থাপনার কলাকৌশলসহ আরো কিছু বিষয়। সংবাদ উপস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকলেই কেবল একজন ব্যক্তি সফল সংবাদ পাঠক হবার চেষ্টা করতে পারেন। টিভি সংবাদে মুখভঙ্গি অত্যন্ত জরুরী। উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি আর স্বরের উত্থান – পতনের সাথে মুখাবয়বের প্রকাশভঙ্গির যোগসূত্র থাকতে হবে, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন থাকতে হবে। দর্শকদের বোঝাতে হবে আমি সংবাদ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল হয়েই তা পাঠ করছি। আনন্দ – উচ্ছাস – বেদনার বহিঃপ্রকাশ পরিষ্কারভাবে চেহারায়, চোখেমুখে ফুটিয়ে তুলতে হবে। ভয়েস মডিউলেশন বা কণ্ঠের ওঠানামা খুব দরকার। আমরা বিভিন্ন সময় নানাধরণের সংবাদ পড়ে থাকি। যেমন আনন্দের সংবাদ আবার কষ্টের সংবাদ। আমাদের বুঝতে হবে কোন সংবাদটা আমরা কিভাবে উপস্থাপন করবো। তা না হলে দর্শকরা আমাদের হয়তো ভালোভাবে গ্রহণ করবেন না। তাই আমাদের আগেভাগে বুঝতে হবে সংবাদটির ধরণ কি ও এর গুরুত্ব কতখানি। কিভাবে এটা আমার পড়া উচিত। আমরা যদি ভয়েস মডিউলেশনের বিষয়টির উপর গুরুত্ব না দেই, সে ক্ষেত্রে সংবাদটি হবে ভীষণ একঘেঁয়ে এবং অমানানসই।
টিভি সংবাদ পাঠক – পাঠিকাদের পোশাক – আশাকের ব্যাপারে ভীষণ সজাগ থাকা দরকার। সংবাদ পাঠক যে রঙের স্যুট পড়বেন, তার সাথে ম্যাচ করে শার্ট ও টাই পরিধান করলে ভালো হয়। চেক শার্ট এর সাথে প্লেইন টাই, আবার প্লেইন শার্টের সঙ্গে কালারফুল বা প্রিন্টেড টাই পড়লে ভালো দেখাবে। হালকা মেইকআপ নিলে ভালো হয়। অনুরূপভাবে সংবাদ পাঠিকাদেরও এব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। মোট কথা, সংবাদ পাঠক – পাঠিকাদের পোশাক – আশাকে পেশাদারিত্বের ছাপ থাকা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে সাজ গোজ যেনো বিয়ে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের মতো না হয়। আমি বলতে চাচ্ছি, সংবাদ পাঠক – পাঠিকার পোশাক – আশাক হতে হবে পরিমার্জিত ও পরিশীলিত, যাতে তাঁর রুচিশীলতার প্রকাশ ঘটে ও ব্যক্তিত্ব ফুঁটে ওঠে। মনে রাখতে হবে যে , কেবল অভিরুচি পারে আমাদের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে। এব্যাপারে সৌজন্যবোধ বজায় রাখা অতি প্রয়োজন। কারন দর্শকদের অনেকেই বাস্তব জীবনে তাদের পছন্দের সংবাদ পাঠক – পাঠিকাদের “রোল মডেল” হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন।
আমার মতে টিভি সংবাদ পাঠক, পাঠিকা, নিউজ তৈরির সাথে সংশ্লিষ্টদের এবং রিপোর্টারদের নিয়মিত দিনে অন্তত একবার বিবিসি , আই টিভি , চ্যানেল ফোর , সি এন এন কিংবা আল জাজিরা থেকে প্রচারিত সংবাদ দেখা দরকার। এছাড়া বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো থেকে প্রচারিত সংবাদও আমাদের দেখতে হবে। কোন পাঠক বা পাঠিকা ভালো সংবাদ পরিবেশন করছেন, কোন রিপোর্টার চমৎকার রিপোর্ট তৈরী করেছেন, কোন চ্যানেল কেমন নিউজ করছে , যেমন শিরোনাম, সংবাদ বাছাই, সংবাদের বিষয়বস্তূ ও গুরুত্ব, কোন নিউজগুলোর বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত, এসব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করা বাঞ্চনীয়। সংবাদের দায়িত্বে যিনি আছেন বা যারা রিপোর্টারের কাজ করছেন, সবাইকে নিরপেক্ষভাবে সংবাদ তৈরী করতে হবে। দর্শক – শ্রোতাদের কোনোভাবেই বুঝতে দেয়া উচিত হবে না যে, তারা আওয়ামীলীগ বা বিএনপির হয়ে কথা বলছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিবিসির সংবাদ পাঠক – জর্জ এলিগাইয়া ও মিশেল হুসেইন এর পরিবেশনা পছন্দ করি। তারা দুজনেই আমার পছন্দের সংবাদ পাঠক – পাঠিকা।
তদ্রূপভাবে ব্রিটেনে বাংলা টিভি চ্যানেলে যারা সংবাদ পরিবেশন করেন, তাদের মধ্যে জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, তৌহিদ শাকিল , শহীদুল ইসলাম সাগর, তানজিনা নূর ই সিদ্দিকীর সংবাদ পরিবেশনা আমার বেশ ভালো লাগে। এছাড়া টিভি টক্ শোতে বুলবুল হাসান, সামসুল আলম লিটন, আব্দুস সাত্তার যখন অংশ নেন, তাদের কথা শুনতে আমি পছন্দ করি । কারন তারা শুদ্ধ উচ্চারণে , বিষয়ের গভীরে গিয়ে আলোচনা করেন। তাদের কথা শুনলে আমার কাছে মনে হয় যে, তারা পরিপূর্ণ প্রস্তূতি নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছেন। নির্ধারিত বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী তারা। এছাড়া ঊর্মি মাজহার ও ফারহান মাসুদ খান চমৎকার উপস্থাপনা করেন।
অনেক সময় দেখা যায়, টিভি সাংবাদিকদের কেউ কেউ শব্দের উচ্চারণে এতটাই অযত্নবান যে , প্রচারিত সংবাদটি বাংলায় হলেও কোনো কোনো শব্দ বুঝতে দর্শকদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। কয়েকটি শব্দের ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। যেমন টাওয়ার হ্যামলেটস্ কে আমরা অনেকেই উচ্চারণ করি টাওয়ার হেমলেট, মিডল্যান্ডস কে বলি মিডলেন্ড, ম্যানচেস্টারকে বলি মানচেস্টার, ইংল্যান্ডকে বলি ইংলেন্ড, ক্যাবিনেটকে বলি কেবিনেট, লন্ডনকে উচ্চারণ করি ল্যান্ডান বলে। এছাড়া আরো কিছু কমন শব্দের বিষয়ে আমাদের যত্নশীল হওয়া দরকার। যেমন এলাকা, এবং, এছাড়া, এন টিভি, বেথনাল গ্রীন , বেচাকেনা, বলেছে, স্থগিত, ঐকমত্য , প্রমুখ , ভাষা, খসড়া চুক্তি , মতবিরোধ, আহ্বান, সম্মুখ পানে , কর্তৃক, শতাধিক, নিকটস্থ, সম্প্রতি, মতবিনিময় ইত্যাদি। রিপোর্টারদের উচিত রিপোর্টিং এ যদি ইংরেজিতে কারো নাম , রাস্তার নাম, এলাকার নাম উল্লেখ করতে হয়, তা বাংলায় না লিখে ইংরেজিতে লিখে পাঠানো।
এতে করে সংবাদ পাঠক – পাঠিকা সঠিকভাবে নামটি ইংরেজিতে উচ্চারণ করতে পারবেন। সঠিক উচ্চারণের জন্য আমরা জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট প্রকাশিত “ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান”টি অনুসরণ করতে পারি। তাছাড়া উচ্চারণরীতি নিয়ে অনলাইনে অনেক ভিডিও রয়েছে। সেখান থেকেও সাহায্য নেয়া যেতে পারে। উচ্চারণের উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমরা যতই দামী পোশাক – আশাক পরিধান করি বা দেখতে যতই সুশ্রী হই না কেনো, শুদ্ধ উচ্চারণ যদি করতে না পারি আর কণ্ঠ যদি শ্রূতিমধুর না হয়, দর্শকরা আমাদের কখনোই ভালোভাবে গ্রহণ করবেন না।আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমাদের সবাইকে ব্রিটিশ মন্ত্রী সভার মন্ত্রীদের নাম ও তাদের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ের নাম মুখস্ত করতে হবে। আরো জানা দরকার বিরোধী দলের শ্যাডো ক্যাবিনেটে কারা আছেন। সে সাথে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কেও আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। এছাড়া বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে সে সম্পর্কেও খোঁজ রাখা দরকার।
টিভি সাংবাদিকদের “অন এয়ার” এ কথা বলার সময় বেশ সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। বেফাঁস কথাবার্তা দর্শকদের আহত করতে পারে। এ কথা সর্বক্ষণ মাথায় রাখতে হবে । দর্শকদের শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন খুবই জরুরী। কিছুদিন আগে “চ্যানেল এস” এর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান – “রিয়ালিটি উইথ মাহী” তে উপস্থাপক মাহী ফেরদৌস জলিল এর হিন্দু সম্প্রদায়কে নিয়ে মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর হয়েছে। রীতিমতো তোলপাড় বয়ে গেছে কমিউনিটিতে। এখনো দর্শকরা এ নিয়ে কথা বলছেন। “চ্যানেল এস” এর সাথে আমি যুক্ত হই ২০০৬ সালে। সে থেকে আমি মাহী জলিলকে জানি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া মন্তব্য আমি বেশ কয়েকবার শুনেছি। আমার ব্যাক্তিগত ধারণা তিনি জেনে শুনে কাউকে আঘাত দেয়ার জন্য এ ধরণের মন্তব্য করেন নি। এটা ছিল তার অনিচ্ছাকৃত ভুল। মুখ ফুসকে বেরিয়ে এসেছে। তবে এ ধরণের মন্তব্য নিঃসন্দেহে অনুভিপ্রেত। অন্যদিকে মাহী জলিলের মন্তব্য হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে তা বলাবাহুল্য। তাই এ নিয়ে প্রতিবাদ করা সঠিক ছিল বলে আমি মনে করি। আবার এও মনে রাখতে হবে যে, মাহী জলিল তার ভুল বুঝতে পেরে অনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। আমাদের প্রত্যেকের এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া দরকার। আমাদের আরো সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন । উপস্থাপনার সময় সংযত আচরণ প্রদৰ্শন অপরিহার্য।
টেলিভিশন সাংবাদিকতার সাথে জড়িতদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও নিয়মিত যোগাযোগ থাকা দরকার। গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণের মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। কারো জনপ্রিয়তা দেখে ঈর্ষার্ণিত না হয়ে বরং প্রশংসা করা দরকার। নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য একে অন্যের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরী। অন্যদিকে জবাবদিহীতা নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষের উচিত প্রত্যেকের কাজের মান কিংবা পারফরমেন্সের বিবেচনা করে যথাযত পারিশ্রমিক প্রদান করা। পারিশ্রমিক না দিলে জবাবদিহীতার প্রশ্নই উঠে না। অভিজ্ঞতার আলোকে পারিশ্রমিকের মান নির্ধারিত হওয়া উচিত। যিনি দীর্ঘদিন ধরে সংবাদ পাঠ করছেন বা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন, তার পারিশ্রমিক এবং নবাগত বা অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সহকর্মীদের পারিশ্রমিক সমান হওয়া ঠিক না। এমনটাই হচ্ছে বলে শোনা যায়। এহেন আচরণ সিনিয়রদের অভিজ্ঞতাকে অবমূল্যায়ন করার শামিল। যা কিনা অশোভন, অন্যায় ।
পাশাপাশি সংবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারদেরও সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য সুযোগ – সুবিধা দেয়া দরকার। বর্তমানে ব্রিটেনের বাংলা টিভি চ্যানেল গুলোতে সংবাদ পাঠক – পাঠিকা, উপস্থাপক – উপস্থাপিকার ছড়াছড়ি। টিভি অন করলে প্রতিনিয়ত নতুন মুখ লক্ষ্যনীয়। কিন্তু এদের মধ্যে মান সম্পন্ন পারফর্মারদের সংখ্যা খুবই নগন্য। কর্তৃপক্ষের উচিত কোয়ান্টিটির বদলে কোয়ালিটির দিকে নজর দেয়া। আমাদের সবার মনে রাখা দরকার যে, কেবল বাংলা পড়তে – লিখতে পারলেই টিভি সাংবাদিক হওয়া যায় না। প্রয়োজন কঠোর অধ্যবসায় আর অনুশীলনের। যারা উপস্থাপনার সাথে জড়িত, তারা প্রতি রবিবার সকালে বিবিসি টিভি থেকে প্রচারিত “Andrew Marr Show” দেখতে পারেন। আমার বিশ্বাস উপস্থাপনার বিকাশ ঘটবেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যারা টক শো উপস্থাপনা করেন তাদের উচিত নিজে কম কথা বলে আমন্ত্রিত অতিথিকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া। অনেক সময় দেখা যায় যে উপস্থাপক কথাই বলে যাচ্ছেন আর অতিথি নিরব দর্শকের মতো অনেকটা অসহায় হয়ে উপস্থাপকের বকবকানি শুনছেন। যা কিনা দৃষ্টিকটু মনে হয়। ব্রিটেনের বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ পাঠক – পাঠিকা , উপস্থাপক – উপস্থাপিকা ও রিপোর্টারদের কোনো নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম আছে বলে আমার জানা নেই। তবে আমি মনে করি টেলিভিশন সাংবাদিকদের পক্ষে ন্যায্য কথা বলার লক্ষ্যে একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানো জরুরী। কেউ কি এব্যাপারে উদ্যোগী হবেন? আমার সমর্থন থাকবে।
প্রায় একত্রিশ বছর ধরে ইলেট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তারপরও বলবো, আমি এখনো সংবাদ পাঠের ব্যাপারে অনেক কিছু আয়ত্ত করতে পারিনি। সংবাদ পাঠকালীন অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে যায়। আমি নিয়মিতভাবে নিজের সংবাদ রেকর্ড করে পরে তা বার বার দেখি নিজের ভুল – ত্রূটি বের করতে। ভাবি আর বুঝি ভুল হবে না, তাসত্ত্বেও নিজেকে সবসময় নির্ভুল রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আপ্রাণ চেষ্টা থাকে ভুল না করার।
নিজের সংবাদ পঠনকে তুলনামূলকভাবে যাচাই করার জন্য আমি প্রতিটি বাংলা টিভি চ্যানেলের সহকর্মীদের পারফরমেন্স নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি। অভিলক্ষ্য একটাই। আর তা হলো, কারো চেয়ে ভালো পড়তে না পারলেও, অন্তত খারাপভাবে পড়ছি কি না তা দেখা। উল্লেখ্য কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করার কোনো অভীপ্সা আমার নেই। কারো ভুল ধরার বা সমালোচনা করার যোগ্যতা আমি এখনো অর্জন করতে পারিনি। টেলিভিশন সাংবাদিকতা নিয়ে কেবল নিজের স্বপ্ন ও ভাবনার কথা তুলে ধরলাম। এর পরেও কেউ যদি আমার লেখা পড়ে দুঃখ পেয়ে থাকেন, তাহলে আমি সত্যিই আপনার – আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করি আমাকে অভিসম্পাত দিবেন না।
লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী। লন্ডন।
(লেখাটি সম্প্রতি সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।)




















