জনতা যখন দ্রোহী হয়, প্রতিবাদ যখন সংঘবদ্ধ হয়, জাত-পাত যখন শোষণ-মুক্তির জন্য জোট বাঁধে তখন হাজার হাজার গ্রেফতারেও সে আগুন জ্বলতেই থাকে। বিশ্বের নানা প্রান্তের ভিন্ন বর্ণের মানুষের রুদ্রমূর্তি আজ আমেরিকায়। আর তাইতো বর্ণবৈষম্য বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলনের সহ-চেয়ার টামিকা মেলোরি নামক কালো মেয়েটির রক্ত টগবগ করা একটা বক্তৃতার শেষ কথা ‘তোমরাই তো আমাদের লুট করতে শিখিয়েছ, শিক্ষা দিচ্ছ কীভাবে সন্ত্রাসী হতে হয়?’
একদিন আমি একটা মানি ট্রান্সফার অফিসে গেছি। দেশে কিছু টাকা পাঠাব। পাউন্ডগুলো যখন দিয়েছি, কাউন্টারে বসা এশিয়ান মানুষটা আমাকে এর মাঝে একটা ২০ পাউন্ডের নোট জাল হিসেবে উল্লেখ করলেন। কী আর করা, মেনে নিলাম। মাঝখান থেকে আামার গচ্ছা গেল ওই পাউন্ড। তিনি নোটটা রেখে দিলেন এবং তার একটা অফিসিয়াল লেটার ধরিয়ে দিলেন, যাতে আমি পুলিশকে ইনফর্ম করলে তিনি ঝামেলায় না পড়েন। অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান এটা করতেই পারে। তাকেও আমি চ্যালেঞ্জ করতেই পারি। কারণ এ দায় আমার নয়। কোথায় পেলাম, কীভাবে এসেছে, অনেক কিছুই হয়তো বলতে হতো, সত্যি কথা হলো যার কোনো ক্লুই আমার কাছে নেই। এবং বেশি বাড়াবাড়ি করলে হয়তো মানি ট্রান্সফারের কর্মকর্তা পুলিশ ডাকতেও পারতেন, আমিও ডাকতে পারতাম।
আমি জানতাম আমার কোনো লাভ হবে না। ফেক নোটটি মেশিনেই ধরা পড়েছে। সুতরাং আমার করার কিছু নেই। কিন্তু আমি ওই ২০ পাউন্ড নোটের বাহক হতেই পারি। পাউন্ড-ডলার-টাকা-রুপি-দেহরাম অর্থাৎ নোটগুলোতো পৃথিবীর দেশে দেশে হাত বদলের জন্যই। সুতরাং কার কাছ থেকে কোথায় কীভাবে যায়, কে জানে? আর সে জন্য পুলিশ এসে আমাকে জেরাও করতে পারে। সর্বোচ্চ পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেতে উদ্যত হতে পারে। কিন্তু আমাকে আঘাত করার অধিকারতো এই সমাজ ব্যবস্থায় তাকে কেউ দেয়নি। সত্যি কথা হলো, এত নিরাপত্তা এত এত আইন তবুও ব্রিটেনেও এ রকম জাল নোট মাঝে মাঝে বাজারে আসে। সতর্কতা অবলম্বন করেও নাগরিকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ঘটনাটা এ রকমই। সিগারেট কিনতে গিয়ে জাল নোটের জালে আটকা পড়েছিলেন ফ্লয়েড এবং দোকানওয়ালা এ নিয়ে পুলিশকে অবহিত করলে পুলিশ উপস্থিত হয়ে ৮ মিনিটি ৪৬ সেকেন্ড ফ্লয়েডের কাঁধের ওপর হাঁটু দিয়ে চাপ দেয় এবং শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ওই পুলিশ প্রজাতির কেউ যদি ওই সময় মানি ট্রান্সফারের দোকানটাতে আমাকে পেত, তাহলে আমার ভাগ্যে কী হতো; এ কথাটা যদিও বাস্তবতার সাথে যায় না, তারপরও মিনেসোটার পুলিশের একজন মানুষকে মেরে ফেলার দৃশ্য দেখে বারবারই কেন যেন এ কথাগুলো মনে হয়েছে।
স্বীকার করি এথনিক মাইনরিটির একটা ক্ষুদ্র অংশ অপরাধ কর্মে জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই অপরাধ কর্ম আরও আট-দশটা অপরাধেরই একটা অংশ। এ অপরাধগুলোতে যেমন শুধু কালো বর্ণ নয়, সাদা চামড়ার মানুষগুলোও জড়িত হয় এবং সব জায়গায়ই এটা হচ্ছে। যেমন ব্রিটেনে এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাদা চামড়ার মানুষগুলোই চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মে বেশি জড়িত, যেমন আছে এমনকি ব্রিটেনের শ্বেতাঙ্গ মানুষদের অনেকেই। কিন্তু কতিপয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের বদ্ধমূল ধারণা, ওই কর্মগুলো শুধু কালোদের দ্বারাই ঘটে থাকে।
আর এ কারণেই এমনকি ব্রিটেনেও বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছে কালো মানুষগুলো এমনকি এশিয়ান কমিউনিটিও। শাসকরা সবসময়ই যে মানবিক থেকেছে, তা নয়। আইনের মাঝ দিয়েই ওই নিরাপত্তাকর্মীদেরও সাজা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এ রকম ঘটনায় একটা দেশ সমাজ-বাস্তবতায় যা হওয়ার তা হয়ে যায়। আর সে জন্যই ব্রিটেনেও এ রকম দাঙ্গার মুখোমুখি হয়েছে বিভিন্ন সময়। ১৯৮১ সালে এ রকম এ দাঙ্গা মূলত কালো কমিউনিটিকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ে লন্ডনের ব্রিক্সটন থেকে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, লিডস, লিভারপুলসহ বিভিন্ন শহরে। জ্বলেছে গাড়ি, হয়েছে লুট। দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়া মানুষসহ পুলিশদের অনেকেই আহত হয়েছেন সে সময়। এতে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই অল্প হলেও দাঙ্গায় সম্পদহানির পরিমাণ বিশাল। গ্রেফতারের সংখ্যাও ছিল হাজার হাজার। যদিও কালোদের সাথে হয়ে যাওয়া এ দাঙ্গার পর ব্রিটেনে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ যে এখনও উঠছে না, তা নয়।
বর্ণবিদ্বেষ চাপিয়ে দেয়া হয়। বর্ণের ধোয়া তোলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জাতীয়তার নাম নিয়ে নিষ্পেষণ-নির্যাতন করা হয়, তখন শাসনকে পাকাপোক্ত করার এক মোক্ষম অস্ত্রই হয়ে ওঠে বর্ণ। সে কারণে বর্ণবিদ্বেষী আন্দোলন মানে শুধুই সাদা আর কালোর মাঝে দ্বন্দ্ব নয়। ক্ষমতায় টিকে থাকতে যথন যা প্রয়োজন হয় পৃথিবীর দেশে দেশে, তখন তা-ই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ধনিক শ্রেণির শাসন আর লুণ্ঠনকে পাকাপোক্ত করতে রাষ্ট্র সন্ত্রাস পোষে। সভ্যতার ধোয়া তোলা রাষ্ট্রগুলো তাদের পুঁজিবাদী শাসন-শোষণ আর অবাধ বাজারনীতি বাঁচিয়ে রাখে প্রশাসন যন্ত্র দিয়ে। রাষ্ট্র কিংবা নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষার নাম নিয়ে এরা নিরেট ভালো মানুষগুলোকে হিংস্র করে তোলে। আর এ রকম এক হিংস্রই পিষে মেরে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের হতভাগ্য কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে।
সেই থেকে ফুঁসে উঠেছে কালোবর্ণের মানুষগুলো। তারাও হিংস্র হচ্ছে। মিনিয়াপলিস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০টি শহরের রাস্তা তাদের দখলে। সুপারস্টোরগুলো ভেঙে ঢুকে যাচ্ছে দাঙ্গাকারী, দোকানপাটে চালাচ্ছে লুটপাট। আতঙ্কিত জনপদ। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে অনেক কিছুই। লুটপাট শুধু কালোরাই করছে কি? সে প্রশ্নও আছে। জ্বলছে পুলিশের গাড়ি। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র উপরের নির্দেশেই থেমে থাকেনি। অশ্বারোহী পিষে মারছে কালোর পাশাপাশি সাদাদেরও। তারা গাড়ি চালাচ্ছে শ্বেতাঙ্গ শরীরেও।
সে কারণেই মিনেসোটা বলি আর নিউইয়র্ক বলি, সাদা-কালোর দ্বন্দ্বটা শুধুই যে একটা আবরণ, এ সত্যকে মেনে নিয়েছে সবাই। তাইতো যেন যুদ্ধে নেমেছে কালোদের পাশাপাশি শ্বেতাঙ্গ মানুষও। কারণ এ যুদ্ধ বর্ণের বিরুদ্ধে বর্ণের নয়, এ যুদ্ধ কালোর বিরুদ্ধে সাদার নয়। এ যুদ্ধ বর্ণষৈম্যের বিরুদ্ধে। তাইতো ধবধবে সাদার পাশাপাশি চিকচিকে কালো যেন এক বিস্ময়কর মানবিক মিশেল। ঠিক সেভাবেই মিয়ামি প্রদেশে পুলিশ নতজানু হয়েছে, মাটিতে হাঁটু গেড়েছে মাথা নুইয়েছে বিক্ষোভকারীদের দেখে। গলা মিলিয়েছে ক্ষোভ থামাতে। নিউইয়র্কের মেয়রের মেয়েও বিক্ষোভে হয়েছেন গ্রেফতার। এ এক ভিন্নতম সহমর্মিতা। রাষ্ট্র আর নাগরিকের সহাবস্থান। জীবন এখানেই মানবিক। এখানেই এক জায়গায় মিশে গেছে মানবিকতা একই মোহনায়।
জর্জ ফ্লয়েড সারাবিশ্বে এখন এক প্রতিবাদের নাম। তাইতো বর্ণবাদী বৈষম্যের অবসানের দাবিতে টানা বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে পুরো দেশ। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ অন্তত ৪০টি শহরে কারফিউ জারি। তবুও নিভছে না বিদ্রোহের আগুন। জনগণের শক্তি পরাভূত হয় না। তাইতো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংকারে লুকাতেও বাধ্য হয়েছেন।
জনতা যখন দ্রোহী হয়, প্রতিবাদ যখন সংঘবদ্ধ হয়, জাত-পাত যখন শোষণ-মুক্তির জন্য জোট বাঁধে তখন হাজার হাজার গ্রেফতারেও সে আগুন জ্বলতেই থাকে। বিশ্বের নানা প্রান্তের ভিন্ন বর্ণের মানুষের রুদ্রমূর্তি আজ আমেরিকায়। আর তাইতো বর্ণবৈষম্য বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলনের সহ-চেয়ার টামিকা মেলোরি নামক কালো মেয়েটির রক্ত টগবগ করা একটা বক্তৃতার শেষ কথা ‘তোমরাই তো আমাদের লুট করতে শিখিয়েছ, শিক্ষা দিচ্ছ কীভাবে সন্ত্রাসী হতে হয়?’
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম