রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
গোপালগঞ্জে জনমনে আতঙ্ক, কারফিউর সঙ্গে বাড়ছে গ্রেফতার  » «   এখন লড়াই নতুন বাংলাদেশের, বক্তৃতার সময় লুটিয়ে পড়লেন আমির  » «   এবার চকরিয়ায় বিএনপির প্রতিরোধের মুখে এনসিপির পথসভা পণ্ড  » «   গণতন্ত্রবিরোধীরা আবার জোট পাকাচ্ছে বলে মির্জা ফখরুল কাদেরকে ইঙ্গিত করলেন?  » «   চালু হলো স্টারলিংক, বাংলাদেশের মতো এত দ্রুত বিশ্বের আর কোথাও হয়নি  » «   গণ–অভ্যুত্থান যেটা বলা হচ্ছে, সেটা আসলে বিস্ফোরণ  » «   ইসলামপন্থিদের হুমকি সত্ত্বেও জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় বাংলাদেশে  » «   গোপালগঞ্জে যারা মারা গেলেন তারা কোন দলের?  » «   গোপালগঞ্জে সহিংস পরিস্থিতির পেছনে এনসিপি’র দায় কতটা?  » «   গোপালগঞ্জে কারফিউয়ের সময় বাড়লো, ‘মৃত্যুর দায় সরকার এড়াতে পারে না’  » «   গোপালগঞ্জে এনসিপির জনসভায় লোক ছিলেন ২০০ জন : পুলিশ প্রতিবেদনে যা উঠে এলো  » «   আবারও গোপালগঞ্জ যাওয়ার ঘোষণা নাহিদের, সরকার ও এনসিপি’র সমালোচনায় বিএনপি  » «   গোপালগঞ্জে কারফিউ, চলছে ধরপাকড়, সরকারের তদন্ত কমিটি  » «   ‘জুলাই শহীদ দিবসে’ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে একি লেখা!  » «   নাহিদ-হাসনাতদের এপিসিতে ওঠার ব্যাখ্যা দিলেন এনসিপি নেতা  » «  

গাজায় এক লাখ মৃত্যু, কী বলছে এই সংখ্যা



ইসরায়েলি অভিযানে গাজায় প্রতিদিন মানুষ মরছে। উপত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহেই যুদ্ধে নিহতদের একটি হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করে। ১ হাজার ২২৭ পৃষ্ঠার ওই তালিকায় বয়সের ক্রম অনুসারে নিহতদের নাম আছে।

আরবি ভাষায় তৈরি ওই নথিতে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির পূর্ণ নাম, পিতার ও দাদার নাম, জন্মতারিখ ও পরিচয়পত্র নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে।

আগের তালিকাগুলোর তুলনায় এবার প্রথমবারের মতো এক বছর বয়সের নিচে নিহত শিশুদের নির্ভুল বয়স আলাদাভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

মাহমুদ আল-মারানাখ নামে এক নবজাতক এবং আরও সাতটি শিশু তাদের জন্মদিনেই নিহত হয়েছে। আরও চারটি শিশু জন্মের পরদিন মারা গেছে। পাঁচটি শিশু দুই দিন বেঁচে ছিল। এই তালিকার ১১ নম্বর পৃষ্ঠায়, অর্থাৎ ৪৮৬টি নাম পার হওয়ার পর প্রথমবারের মতো এমন একটি শিশুর নাম পাওয়া যায়, যার ছয় মাসের বেশি বয়স ছিল মৃত্যুর সময়।

১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের নামই এই তালিকার ৩৮১টি পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে। এদের মোট সংখ্যা ১৭ হাজার ১২১ জন। যুদ্ধের মোট মৃতের সংখ্যা ৫৫ হাজার ২০২ জনের মধ্যে ৯ হাজার ১২৬ জন ছিলেন নারী।

ইসরায়েলি মুখপাত্র, সাংবাদিক এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই তথ্যকে অবিশ্বাস করে সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত ও ফাঁপা।

তবে বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, যত ভয়ংকরই হোক না কেন এই তালিকা বিশ্বাসযোগ্য। এমনকি কেউ কেউ বলছেন, এটি বাস্তবতার তুলনায় বরং সংযত।

লন্ডনের হোলোয়ে কলেজের অর্থনীতিবিদ এবং সহিংস সংঘাতে মৃত্যুহার সংক্রান্ত বিশ্বমানের বিশেষজ্ঞ মাইকেল স্প্যাগাট একাধিক গবেষণা করেছেন ইরাক, সিরিয়া ও কসোভোর যুদ্ধ নিয়ে। গত সপ্তাহে তিনি ও তার গবেষক দল গাজা উপত্যকায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বিস্তৃত একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন।

এতে তিনি ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ ও গবেষক ড. খলিল শিকাকির সহায়তায় গাজার ২ হাজার পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এর আওতায় প্রায় ১০ হাজার মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।

গবেষণার ফল অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গাজায় মোট ৭৫ হাজার ২০০ জন মানুষ সহিংসতায় নিহত হয়েছে। এদের প্রায় সবাই ইসরায়েলি গোলাবারুদের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে।

তখন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছিল, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৪৫ হাজার ৬৬০ জন মানুষ নিহত হয়েছে। অর্থাৎ, মন্ত্রণালয়ের হিসাব প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ কম দেখানো হয়েছিল।

গবেষণাটি এখনও সহকর্মীদের মাধ্যমে পর্যালোচিত হয়নি, অর্থাৎ এটি ‘প্রিপ্রিন্ট’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এর ফলাফল লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষকদের এক ভিন্নধর্মী পদ্ধতিতে করা গবেষণার সঙ্গে অনেকটাই মিলেছে। ওই গবেষণাও দেখিয়েছিল, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের সঙ্গে প্রকৃত মৃত্যুর পার্থক্য প্রায় ৪০ শতাংশ।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ইতিহাসের পিএইচডি শিক্ষার্থী ম্যাথিউ গ্যাব্রিয়েল ককারিল গত সপ্তাহেই আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। তিনি “অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স” নামের একটি সংস্থার হয়ে কাজটি করেন।

ওই গবেষণায় দেখা হয়, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকা থেকে মুছে ফেলা ৩ হাজার শিশুর মধ্যে ১ হাজারের নাম ও তথ্য। এতে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, তালিকা থেকে বাদ দেওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ শিশু সত্যিই নিহত হয়েছে।

স্প্যাগাট ও তার সহকর্মীদের গবেষণায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে—“এক্সেস মোর্টালিটি” বা অতিরিক্ত মৃত্যুর হার। অর্থাৎ যুদ্ধের সরাসরি আক্রমণ ছাড়াও ক্ষুধা, ঠান্ডা, চিকিৎসার অভাব ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধ্বংসের ফলে কতজন মানুষ মারা গেছে।

যুদ্ধের প্রথম বছরে বিভিন্ন গবেষক ও চিকিৎসক অনুমান করেছিলেন এই অতিরিক্ত মৃত্যুর হার নিয়ে। তবে অধিকাংশ অনুমানই পরে অতিরঞ্জিত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

নতুন জরিপ অনুযায়ী, জানুয়ারি পর্যন্ত অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ৫৪০ জনের। এই সংখ্যা যেকোনো মানদণ্ডে অনেক বেশি। তবে আগের অনুমিত লাখো মৃত্যুর তুলনায় তা কম।

এই বিষয়ে ‘হারেটজ’ সংবাদমাধ্যম কথা বলেছে একাধিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।

তাদের মতে, যুদ্ধ শুরুর আগে গাজার জনসংখ্যার স্বাস্থ্য এবং সেখানকার স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। বিশেষ করে আফ্রিকা বা ইয়েমেনের মতো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ-দ্বন্দ্বপূর্ণ অঞ্চলের তুলনায় গাজা অনেক ভালো অবস্থানে ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গাজায় টিকাদান কর্মসূচির হার ছিল খুবই উচ্চ। এটি দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর চেষ্টার ফলে হয়েছে।

গবেষকরা আরও এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন, গাজার সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো। পরিবারের সহায়তা কাঠামো এই দুঃসময়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে এবং অনেক মানুষকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে বাঁচাতে পেরেছে।

স্প্যাগাট জাতিসংঘ ও অন্যান্য সহায়তা সংস্থার ভূমিকাকেও ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেছেন। যুদ্ধের প্রথম বছরে এসব সংস্থা গাজার জনগণকে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা দিতে সফল হয়েছিল।

গাজায় চলমান যুদ্ধকে ২১ শতকের অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত করছে সাম্প্রতিক তথ্যগুলো। এই যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুদ্ধে নিহত যোদ্ধা ও বেসামরিক মানুষের অনুপাতে গাজা বর্তমানে প্রথম স্থানে রয়েছে। একই সঙ্গে জনসংখ্যার অনুপাতে মৃত্যুহারও বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।

তবে অধ্যাপক মাইকেল স্প্যাগাট জোর দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধের প্রথম বছরে যেসব প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা কাজ করেছিল, সেগুলোর কার্যকারিতা এখন আর নেই। গত ছয় মাসে গাজার মানুষ ক্রমাগত অতিরিক্ত মৃত্যুর বিপদে আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

আর এর একটি বড় কারণ হলো—গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের স্থানচ্যুতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্পূর্ণ ধ্বংস। এর ফলে টিকাদান কর্মসূচির হার ব্যাপকভাবে কমে গেছে। বর্তমানে গাজার অধিকাংশ মানুষ অস্থায়ী তাঁবু শহরে বাস করছে। ওসখানে ঠান্ডা, গরম, দুর্ঘটনা, ভিড় ও সংক্রামক রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি।

পাশাপাশি খাদ্যের ঘাটতি ও জাতিসংঘের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। গত ২ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৭৮ দিনের পূর্ণ অবরোধ এবং এরপর থেকে চলমান আংশিক অবরোধের ফলে গাজার মানুষের মধ্যে ভিটামিন, খনিজ ও প্রোটিনের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে হাসপাতাল ও চিকিৎসা পরিকাঠামোর ধ্বংস আরও বেড়েছে।

এই বাস্তবতা থেকে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়—গাজায় আগামী দিনগুলোতে অতিরিক্ত মৃত্যুর ঢেউ আবারও দেখা দিতে পারে। অধ্যাপক স্প্যাগাট বলেন, “আমার ধারণা, জানুয়ারির তুলনায় এখন হয়তো সহিংসতার বাইরের মৃত্যুর হার আরও বেড়েছে।”


‘আফ্রিকা লিগ’-এর মধ্যে গাজা
ভবিষ্যতের অতিরিক্ত মৃত্যুর ঢেউ ধরে না রাখলেও এখন পর্যন্ত সহিংসতা ও ক্ষুধা-রোগে মৃত্যুর সংখ্যা মিলিয়ে জানুয়ারির আগেই ৮৩ হাজার ৭৪০ জন নিহত হয়েছে। এই সংখ্যাটি জরিপ ও অতিরিক্ত মৃত্যুর তথ্য মিলিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, আরও ১০ হাজার নিহত হয়েছে। যদিও এই সংখ্যায় অতিরিক্ত মৃত্যুর হিসাব অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ এখনও যুদ্ধের মৃতের সংখ্যা এক লাখ অতিক্রম না করলেও তা এর খুব কাছাকাছি।

এসব তথ্যের ভিত্তিতে অধ্যাপক স্প্যাগাট বলেন, গাজার যুদ্ধ ২১ শতকের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতগুলোর একটি। সিরিয়া, ইউক্রেন ও সুদানের মতো দেশগুলোর মোট মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো বেশি, কিন্তু গাজা এগিয়ে আছে যোদ্ধা ও বেসামরিক নিহতের অনুপাত এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে মৃত্যুর হারের দিক থেকে।

জরিপের সঙ্গে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মিলে যায়। জরিপ অনুযায়ী, নিহতদের ৫৬ শতাংশই শিশু (১৮ বছরের নিচে) অথবা নারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যত যুদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে এই হার প্রায় নজিরবিহীন।

স্প্যাগাটের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় সহিংস মৃত্যুর শিকার হওয়া নারী ও শিশুর অনুপাত অন্য সব সাম্প্রতিক সংঘাতের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। যেমন কসোভোতে এ অনুপাত ছিল ২০ শতাংশ, ইথিওপিয়ার উত্তরে ৯ শতাংশ, সিরিয়ায় ২০ শতাংশ, কলম্বিয়ায় ২১ শতাংশ, ইরাকে ১৭ শতাংশ ও সুদানে ২৩ শতাংশ।

গবেষণায় আরেকটি চরম তথ্য পাওয়া গেছে—জনসংখ্যার অনুপাতে নিহতের সংখ্যা।

স্প্যাগাট বলেন, “আমার ধারণা, গাজার প্রায় ৪ শতাংশ জনগণ নিহত হয়েছেন। ২১ শতকে আর কোনও সংঘাতে এত উচ্চ হার দেখা গেছে বলে আমার জানা নেই। সুদানের নতুন তথ্যগুলো দেখে নিতে হবে, আর কঙ্গো নিয়েও বিতর্ক আছে। তবে আমরা এখন ‘আফ্রিকার লিগ’-এর মধ্যে পড়ে যাচ্ছি, মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে নয়।”

ভয়ংকর এই সংখ্যাগুলোর পরও অধ্যাপক স্প্যাগাট “গণহত্যা” শব্দটি ব্যবহার করতে দ্বিধায় আছেন।

তিনি বলেন, “এই জরিপের তথ্য দিয়ে ‘গণহত্যা’ শব্দের সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব নয়। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণ করা এখনও বাকি।” তবে তিনি স্বীকার করেন, “আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকা এই বিষয়ে একটি শক্তিশালী মামলা উপস্থাপন করেছে।”

তার মতে, গাজায় যা ঘটছে, সেটি সম্ভবত “শুধু জাতিগত নির্মূল”।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে যেভাবে বিশদ ও নির্ভরযোগ্য তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তার বিপরীতে ইসরায়েলের সরকারি মুখপাত্রদের নীরবতা বিস্ময়কর। ৭ অক্টোবরের যুদ্ধই প্রথম, যেখানে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী শত্রুপক্ষের নিহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যা জানায়নি।

ইসরায়েলি মুখপাত্র ও আইডিএফ শুধু একটি সংখ্যা বারবার উল্লেখ করছে— ২০ হাজার হামাস ও অন্যান্য সংগঠনের যোদ্ধা নিহত হয়েছে। কিন্তু এই দাবির পেছনে নেই কোনও নামের তালিকা, কিংবা কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ।

স্প্যাগাটের মতে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এই ২০ হাজার যোদ্ধার নাম প্রকাশের চেষ্টা করলেও মাত্র কয়েকশ নাম পাওয়া গেছে। এমনকি হাজার জনের তালিকা তৈরি করাও কঠিন।

ম্যাথিউ ককারিলও এই সংখ্যা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, “ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, সাধারণত যত যোদ্ধা নিহত হয়, তার অন্তত দ্বিগুণ আহত হয়। সুতরাং যদি ইসরায়েল বলে ২০ হাজার যোদ্ধা নিহত হয়েছে, তবে অন্তত ৪০ হাজার আহত হয়েছে। এ হিসেবে হামাসের মোট যোদ্ধা সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০ হাজার। আর এটি বাস্তবসম্মত নয়।”

ককারিলের মতে, ইসরায়েল দুটি প্রধান কৌশলে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। প্রথমত, যারা সরকারে কাজ করে, এমন সাধারণ নাগরিকদের ‘যোদ্ধা’ হিসেবে চিহ্নিত করা। দ্বিতীয়ত, ‘কিল জোন’ বা নির্দিষ্ট এলাকা যেখানে যারাই নিহত হয়, সবাইকে ‘যোদ্ধা’ ধরা হয়।

তবে ধরা যাক, ইসরায়েলের দেওয়া সংখ্যাই সঠিক। তবু হিসাব বলছে, প্রত্যেক হামাস যোদ্ধার বিপরীতে চারজন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। অথচ ইসরায়েলি মুখপাত্ররা দাবি করেন, এই অনুপাত ১:১।

সাম্প্রতিক এক গবেষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে: যদি গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা আসলে অনেক কম হয়ে থাকে, তাহলে বাকি মৃতদেহগুলো কোথায়? কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মূলত হাসপাতালের মর্গে আনা মৃতদেহের উপর ভিত্তি করে তৈরি।

অধ্যাপক স্প্যাগাটসহ অন্যান্য গবেষকদের ধারণা, এখনও হাজার হাজার মানুষ ধ্বংস হয়ে যাওয়া হাজার হাজার ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছেন। এদের নাম তাই তালিকায় আসেনি। আবার কেউ কেউ বিস্ফোরণের কেন্দ্রবিন্দুর খুব কাছাকাছি ছিলেন, যাদের দেহের কোনও চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। তবে এই কারণেই যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকা ও জরিপের মধ্যে এত বড় পার্থক্য, তা নয়।

স্প্যাগাট আরও একটি সম্ভাবনার কথা বলেন। অনেক পরিবার হয়তো তাদের প্রিয়জনদের দাফন করে ফেলেছে, কিন্তু তাদের মরদেহ হাসপাতালে আনেনি বা মৃত্যু মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করেনি।

ম্যাথিউ ককারিল বলেন, “কিছু পরিবার হয়তো জানাতে চায় না, বা জানাতে সক্ষম নয়। হয়তো বাবা-মা ও সন্তান সবাই মারা গেছে, শুধু একটি আট বছরের শিশু বেঁচে আছে। সে কীভাবে জানাবে?”

‘আমি মরতে পারি, প্লিজ?’
খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতালে এই পরিসংখ্যান বাস্তব রূপ পেয়েছে। ব্রিটিশ সার্জন ড. গোহের রাহবুর সম্প্রতি গাজার এই হাসপাতাল থেকে এক মাসের দায়িত্ব শেষ করে দেশে ফিরে গেছেন।

তিনি বলেন, “প্রতিদিনই ট্রমা, বিস্ফোরণে আহত ও শরীরে স্প্লিন্টার বিদ্ধ রোগীদের নিয়ে কাজ করতে হতো। প্রতি দুই-তিন দিন পরপর একেকটি গণ-আহতের ঘটনা ঘটতো। তখন জরুরি বিভাগে তীব্র ভিড় ও সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা দেখা যেত।”

একজন রোগীর ঘটনা তার মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে। ১৫ বছর বয়সী কিশোর, যার পুরো পরিবার নিহত হয়েছে, আর সে নিজে আহত হয়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছে। “তার মেরুদণ্ডে স্প্লিন্টার ঢুকে গেছে, তাই কোমরের নিচ থেকে কোনও অনুভূতি নেই। সে এখন প্যারাপ্লেজিক।

“সে গাজায় ১৫ বছর ধরে বড় হয়েছে। সে জানে, হুইলচেয়ারে বসা একজন কিশোরের জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে। তার না আছে পরিবার, না আছে ফিজিওথেরাপি। আমরা যেসব সুবিধা স্বাভাবিকভাবে ধরে নিই, তার কিছুই তার নেই। সে হাসপাতালের ভেতর ঘুরে বেড়ায় আর আমাদের জিজ্ঞেস করে, ‘আমি মরতে পারি, প্লিজ?’”

গত এক মাস ধরে ইসরায়েল জাতিসংঘ ও ইসরায়েল-আমেরিকান গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কিছু পরিমাণ খাদ্য প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবুও গাজায় পুষ্টির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তর জানিয়েছে, গত মাসে ৫ হাজার ৪৫২ শিশু গুরুতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

রাহবুর বলেন, “মানুষগুলো একেবারে কঙ্কালসার হয়ে গেছে। মুখের হাড়গুলো দেখা যায়, চোয়াল বেরিয়ে আসে। পুরো মাসে আমি এখানে কোনও ফল, শাকসবজি, মাংস বা মাছ দেখিনি।

“তারা কিছু গুঁড়ো দুধ পায়, যা ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি সাত বছর বয়সী এক ক্ষুধার্ত শিশু আসে, তখন কী হয়? তারা বলেছে, আমরা দুঃখিত, তাকে ফিরিয়ে দিতে হয়—মরে যাওয়ার জন্য।”

ড. রাহবুরসহ গাজায় থাকা অন্য চিকিৎসকরা বলছেন, ক্ষুধা ও গৃহচ্যুতির কারণে গাজাবাসীর স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। ব্রিটিশ সার্জন ড. ভিক্টোরিয়া রোজ তিন সপ্তাহ আগে গাজা ছাড়েন। তিনি বলেন, “দেখা যাচ্ছে শরীরের আর ক্ষত সারিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই।”

তিনি যোগ করেন, “অপুষ্টির কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সবার আগে নষ্ট হয়। শিশুদের শরীরে এখন ক্ষত সারে না, তারা তাঁবুতে থাকে। সেখানে কোনও স্যানিটেশন নেই, নেই পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে, পরিষ্কার পানিও ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফলে কিছুই পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়। আর পরিষ্কার না থাকলে ক্ষত সারবে না—বরং সংক্রমিত হবে।”

ক্ষুধা নিজেই যেখানে ভয়ংকর, সেখানে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে। তারা খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে ইসরায়েলি গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে।

গোহের রাহবুর যখন নাসের হাসপাতালে দায়িত্বে ছিলেন, সেই সময় অর্থাৎ জুনের ১ তারিখ থেকে তিনি লক্ষ করেন—আহতদের ক্ষতের ধরন বদলাতে শুরু করেছে। বিস্ফোরণের ক্ষতের বদলে এখন গুলিবিদ্ধ রোগী আসছে বেশি। কারণ ইসরায়েলি সেনারা ক্ষুধার্ত জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন