নিউ ইয়র্কের মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে বড় ধরনের অঘটন ঘটিয়ে জয়ের পথে রয়েছেন তরুণ রাজনীতিক জোহরান মামদানি। অভিজ্ঞ ও কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোকে পেছনে ফেলে নিজের বিজয় ঘোষণা করেছেন তিনি। যদিও ভোট গণনা পদ্ধতির কারণে চূড়ান্ত ফল পেতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে, তবে মঙ্গলবারের প্রাথমিক ফলাফলে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় ৩৩ বছর বয়সী এই ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট প্রার্থীই যে মূল নির্বাচনে দলের প্রার্থী হচ্ছেন, তা প্রায় নিশ্চিত।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মামদানি একজন মুসলিম। নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন এ শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র।
সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে মামদানি বলেন, “আজ রাতে আমরা ইতিহাস তৈরি করেছি। আমিই হতে চলেছি নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদে আপনাদের ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী।”
৯৩ শতাংশ ভোট গণনার পর দেখা গেছে, অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি মামদানি পেয়েছেন ৪৩.৫ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে, ক্যুমোর ঝুলিতে গেছে ৩৬.৪ শতাংশ।
পরাজয় স্বীকার করে ক্যুমো বলেছেন, “(মামদানি) সত্যিই একটি বুদ্ধিদীপ্ত, ভালো এবং প্রভাবশালী প্রচারণা চালিয়েছে। আজকের রাতটি তার। এই জয় তার প্রাপ্য।”
নিউইয়র্কে ‘র্যাঙ্কড-চয়েস’ বা পছন্দের ক্রমানুসারে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি চালু রয়েছে। কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে দ্বিতীয় পছন্দের ভোট গণনা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৃতীয় স্থানে থাকা প্রগ্রেসিভ প্রার্থী ব্র্যাড ল্যান্ডারের ভোটগুলো মামদানির পক্ষেই বেশি আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মামদানির এই উত্থানকে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ক্যুমোর পেছনে বিল ক্লিনটনের মতো প্রভাবশালী নেতাদের সমর্থন এবং বড় অংকের তহবিল থাকলেও মামদানি তরুণদের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছেন।
ক্যুমো জানিয়েছেন, তিনি মামদানিকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছেন, নভেম্বরের মেয়র নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথাও ভাবছেন।
যদি প্রাইমারির এই ফল চূড়ান্ত হয়, তাহলে ৪ নভেম্বরের মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট অধ্যুষিত নিউ ইয়র্কে মামদানিই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হবেন এবং শহরের ১১১তম মেয়র হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন।
কে এই জোহরান মামদানি?
নিউইয়র্ক সিটির সবচেয়ে কনিষ্ঠ ও প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়ার দ্বারপ্রান্তে জোহরান মামদানি। ৩৩ বছর বয়সী মামদানির মোট সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক দুই লাখ থেকে তিন লাখ ডলারের মধ্যে।
মামদানির জন্ম উগান্ডায়। সাত বছর বয়সে বাবা–মায়ের সঙ্গে নিউইয়র্কে আসেন তিনি। তাঁর বাবা প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানি—হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। জন্মগতভাবে ভারতীয়। মা মীরা নায়ার, একজন খ্যাতনামা ভারতীয়-মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা।
মামদানি ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কুইন্স এলাকা থেকে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। মাত্র চার বছর তিনি সিটি কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দুই দফায় দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমো পরপর তিন দফায় এ রাজ্যের গভর্নর নির্বাচিত হন। বিভিন্ন অনিয়ম ও তাঁর অধীনস্থ একাধিক নারীকে যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগে ২০২১ সালে পদত্যাগের আগে কুমোকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মেয়র পদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি মার্কিন রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলেন।
মামদানির অভাবিত বিজয়, যাকে এককথায় একটি ‘রাজনৈতিক ভূমিকম্প’ বলা যায়। এটি ২০০৮ সালে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনকে মনে করিয়ে দিয়েছে। দেশের প্রথাগত রাজনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে প্রধানত অশ্বেতাঙ্গ, বহিরাগত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের সমর্থনে দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ওবামা।
মামদানির প্রার্থিতা নিউইয়র্কের বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দক্ষিণ এশীয় মানুষদের মধ্যে বিপুল আলোড়ন তোলে। সে কথা মাথায় রেখে মামদানি এবং এ শহরের একমাত্র নির্বাচিত বাঙালি কাউন্সিলর শাহানা হানিফ যৌথভাবে বাংলায় একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করেন।
ট্রাম্পের ‘সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন’ জোহরান মামদানি
ইকোনমিক টাইমস-এর মতে, নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে জোহরান মামদানির উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা টানা শুরু হয়ে গেছে। এর কারণ শুধু তাঁদের বিপরীতমুখী আদর্শের জন্য নয়, বরং মামদানি নিজেই তাঁর প্রচারকে ট্রাম্পের ধারার রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
মামদানি ঘোষণা করেছেন, ‘আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন—একজন প্রগতিশীল মুসলিম অভিবাসী, যে সত্যিকারের বিশ্বাস থেকে লড়ে।’ এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে মামদানির প্রার্থিতা ট্রাম্পের রাজনীতির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, যা গত কয়েক বছরে জাতীয় ও নগর রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
এই তুলনাটা কেবল কথার তুলনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মামদানির জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তৃণমূলভিত্তিক প্রচারাভিযান প্রচলিত ধারাকে ভেঙে দিয়েছে। ট্রাম্পও এভাবে প্রচলিত ধারাকে ভেঙেছিলেন, তবে মামদানির বার্তা ও সমর্থক জোট ট্রাম্পের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।