বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনের আদেশে ছুটি চলাকালীন সময়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশেই ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করা ট্রেজারার অধ্যাপক ড. জয়নুল আবেদীন সিদ্দিকী বলেন, “এ বিষয়ে অনেক আগেই ডিনবৃন্দ ও সবাইকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এটা সম্ভবত সেই সিদ্ধান্তের কারণেই হচ্ছে। তখন তো অনেকগুলো বিতর্কিত কর্মকাণ্ড হয়েছিল, কেউ কেউ ভাস্কর্যটি নিয়ে তীব্রভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। ফলে ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা, উন্নয়ন দফতরের পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জানান, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভাস্কর্যটি ভাঙা হয়েছে। সিদ্ধান্ত এসেছে উপাচার্য স্যারের পক্ষ থেকেই। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের ফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে চার কোটির বেশি ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পুকুরগুলোর সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের অংশ হিসেবেই নির্মিত হয় ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্যটি। তবে ৫ আগস্ট প্রশাসনিক পটপরিবর্তনের পর নতুন প্রশাসনের নির্দেশেই এটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়েই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভাস্কর্যটি ভাঙ্গার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ। ফেসবুকে ১৭ জুন ২০২৫ এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘‘Can anyone stop them please?
ভেঙে ফেলা হচ্ছে “অঞ্জলি লহ মোর”!
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মূরাল।
যেটি আমার হাতের ছবি থেকে করা হয়েছিল। এটি ভাস্কর্যবিদ মনিন্দ্র পাল করেছিলেন। খুবই দুঃখজনক এই মুহূর্তে সেটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে!’’
ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান তুষার বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে তৈরি ‘অঞ্জলি লহ মোর’ নামক যে স্থাপনাটি, তা আজ প্রশাসনের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হচ্ছে- যা খুবই দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধনের স্থাপনাগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।”
তিনি আরো বলেন, “নতুন-নতুন স্থাপনার ভিড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন নান্দনিক সৌন্দর্যবর্ধনের স্থানগুলো আজকাল আর তেমন দেখা যায় না। ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত ছাড়াও অন্যভাবে এটি নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করা যেত, যা অধিক যুক্তিযুক্ত হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে হতাশ হলাম।”
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে নির্মিত “অঞ্জলি লহ মোর” ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি ছিল নান্দনিক স্থাপনাগুলোর অন্যতম। প্রশাসন চাইলে নতুনভাবে পরিকল্পনা করে এটি রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারতো।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় চারুশিল্প পর্ষদের সভাপতি মো. রাজন বলেন, ‘এই ভাস্কর্যটি যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখনই এটা নিয়ে বিতর্ক ছিল। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এভাবে ভাস্কর্য ভেঙে ফেলাটা আমাদের মতো শিল্পপ্রেমীরা মেনে নিতে পারছে না।’ তিনি আরও জানান, ভাস্কর্যটি ভেঙে না ফেলে এটাকে আরও কীভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করা যায় এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভাবা উচিত ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা করে যদি ভাস্কর্য ভাঙা হয়ে থাকে তবে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন তিনি।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তৎকালীন সরকারের সময়ে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গা শুরু হয়। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনা ও শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন নিদর্শন ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অর্ন্তবর্তী সরকার গঠনের দশ মাস পরও যে তা বন্ধ হয়নি ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা তা প্রমাণ করে।