চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠককে ইতিবাচকভাবে দেখছে না। এনসিপি মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী একটি দলকে খুশি করতে নির্বাচন এগিয়ে আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। এনসিপির আরেক নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, প্রধান উপদেষ্টার যে বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, তাতে তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দায়বদ্ধতা ভুলে গেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে শুক্রবার (১৩ জুন ২০২৫) বাংলাদেশ সময় দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, এপ্রিলের বদলে জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে এনে সব প্রস্তুতি শেষ হলে আগামী রোজার আগে ভোট আয়োজন করা হতে পারে। এ বিষয়ে রাজধানীর বাংলামোটরে দলের কার্যালয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন সাংবাদিকদের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেন।
তিনি বলেন, “যখন সরকার একটি দলের হয়ে কাজ করে, তখন সেটা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। সরকারের লেজিটিমেসি আসে ১৮ কোটি মানুষের কাছ থেকে, একটি দলের কাছ থেকে নয়। তাই এই রাজনৈতিক হিপোক্রিসি (ভন্ডামি) দেশের জন্য ভয়ানক হবে।”
এনিসিপি এই শীর্ষ নেতা বলেন, “লন্ডনে আজ যে মিটিংটি হয়েছে, এতে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং একটি পুরাতন বন্দোবস্তের দিকেই বাংলাদেশকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। নতুন কোনো ব্যবস্থা বা কাঠামোর ইঙ্গিত আমরা ওই মিটিংয়ে দেখতে পাইনি।”
তিনি আরও বলেন, “খুনি হাসিনা একদিকে বার্তা দিচ্ছে, আরেকদিকে একটি রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতা লন্ডনে বসে মিটিং করছে ও বার্তা দিচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে, এই সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের মাটি ও প্রকৃতির কোনো সংযোগ নেই।”
আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া গণ অভ্যুত্থানের নেতাদের দল এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, “দেশের সিদ্ধান্ত দেশের মাটিতেই হবে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ নিয়ে সিদ্ধান্ত হলে সেটি জনগণ মেনে নেবে না। সরকারকে আহ্বান জানাব, দেশের জনগণের সঙ্গে কথা বলুন। গ্রামে-গঞ্জে যান, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের সঙ্গে বসুন। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর বেদনা বুঝতে পারলে আপনারা জুলাই সনদ, বিচার ও সংস্কার বিষয়ে উদ্যোগী হতে পারবেন।”
নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্র, বিচার প্রক্রিয়া, মৌলিক সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন—এই বিষয়গুলো সম্পন্ন না হলে আমরা কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না। বরং তা হলে হয়তো আমরা একটি গণঅভ্যুত্থানের দিকেই যাব।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে যদি কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন না হয়, শুধু রাজার পরিবর্তে রাজা বা রানীর পরিবর্তে রানী হয়, তাহলে সেই পরিবর্তনে এনসিপি বিশ্বাস করে না। অভ্যুত্থানের অগ্নিগর্ভ থেকে যেহেতু আমাদের জন্ম, সেহেতু জনগণের প্রতি আমাদের কিছু কমিটমেন্ট আছে। সেই জনগণকে বলব—যে আশায় আপনারা গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন, সে আশা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রামে এনসিপি আপনাদের পাশে থাকবে।”
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নাসীরুদ্দীন বলেন, “আমরা চাই, বাংলাদেশের দ্রুত গণতান্ত্রিক যাত্রার উত্তরণ ঘটুক। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলো নাকি এপ্রিলে—এটি মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য হলো—জুলাই সনদ, বিচার ও সংস্কার, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট আমলের কালো আইন বাতিল করে নতুন একটি ব্যবস্থার সূচনা।”
তিনি আরও বলেন, “এই যাত্রা যদি শেখ হাসিনার আমলের ধারাবাহিকতাতেই যায়, তাহলে সেটি হবে বাংলাদেশের জন্য গভীর সংকট। আমরা তা হতে দেব না।”
নাসীরুদ্দীন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “সরকার লন্ডনে একটি দলের সঙ্গে বসে যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য অশনি সংকেত। সরকার এই আলোচনা দেশে বসেই করতে পারত। তাহলে আমরা একটি জাতীয় ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারতাম।”
ইউনূস দায়বদ্ধতা ‘ভুলে গেছেন’, ভাবছেন হাসনাত আবদুল্লাহ
যুক্তরাজ্যে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি এসেছে, তাতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ। প্রধান উপদেষ্টার যে বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, তাতে তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দায়বদ্ধতা ভুলে গেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফেসবুকে ক্ষোভ ঝেড়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, “জুলাই সনদের পূর্বে নির্বাচনের মাস আর তারিখ নিয়ে কথা বলা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়বদ্ধতা ভুলে যাওয়ার নামান্তর।”
ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠককে ইতিবাচকভাবে দেখার কথা জানিয়ে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠন বলেন, “জাতীয় ঐক্যমত্যের প্রশ্নে, দেশের স্বার্থে সরকারের সাথে সকল রাজনৈতিক দলের এমন সুসম্পর্কই কাম্য।”
তিনি কেন হতাশ তার ব্যাখ্যা দেন পরেই। হাসনাত বলেন, “হতাশার বিষয় বৈঠকে নির্বাচনের মাস ও তারিখ যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছে অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা বিচার ও সংস্কার সেভাবে প্রাধান্য পায়নি।”
এই সরকার শুধুমাত্র নির্বাচন দেওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো রূপ নয় বলে মন্তব্য করে এনসিপি নেতা বলেন, “বরং একটি অভ্যুত্থানের উপর দাঁড়িয়ে, দেশের মানুষের অসংখ্য ত্যাগের উপর দাঁড়িয়ে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার কাছে দায়বদ্ধ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।”
জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ, মৌলিক সংস্কার, দৃশ্যমান বিচার এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনই জাতীয় নির্বাচনের পূর্বশর্ত বলেও স্মরণ করিয়ে দেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।
জুলাই সনদ রচনার পরেই নির্বাচন বিষয়ক আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলেও মত দেন তিনি।
দেশের স্থানীয় পর্যায়ে এরইমধ্যে চাঁদাবাজি, দখলদারত্ব, প্রশাসনকে প্রভাবিত করা, পেশিশক্তির প্রদর্শনসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা দৃষ্টান্ত প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন হাসনাত। বলেন, “এই অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। যেটা নির্বাচনের অন্যতম আরেকটি পূর্বশর্ত।”
“নির্বাচনের মাস এপ্রিল কিংবা ফেব্রুয়ারি যেটাই হোক না কেন, তার চেয়ে মুখ্য বিষয় হচ্ছে নির্বাচনের পূর্বে জুলাই সনদ দৃশ্যমান বিচার এবং মৌলিক সংস্কার গুলো হচ্ছে কিনা”, লেখেন এনসিপি নেতা।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের আভাস হতাশাজনক বললেন সারোয়ার তুষার
জুলাই সনদ ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করা মানে বিএনপির কাছে আত্মসমর্পণ বলে মন্তব্য করেছেন এনসিপি যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। শুক্রবার লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার বৈঠকের প্রসঙ্গে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সারোয়ার তুষার বলেন, সরকার এখন কার্যত বিএনপির ছকেই দেশ চালাচ্ছে। এসময় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তুষার। বলেন, বিচার ও সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে তা আগামীর জন্য ভালো কিছু হবে না।
নির্বাচনের সময়সীমা, সংস্কার ও বিচার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে টালামাটাল অবস্থায় লন্ডনে তারেক রহমানের সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে বৈঠকের পর এমন সিদ্ধান্ত হতাশাজনক বলেও জানান দলটির এই নেতা।
জুলাই সনদ কার্যকর ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। শুক্রবার (১৩ জুন) রাতে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাতের সই করা এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি ‘সংসদ নির্বাচন’ বিষয়ে দলটির আস্থা আনতে সফল হয়েছে সরকার। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি বলে আমরা মনে করি।
‘বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি। নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি মনে করে, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন, ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ব্যতীত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণঅভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যম হিসেবে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জনআকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে। জনগণের দাবি তথা ‘জুলাই সনদ’ রচনা ও কার্যকর করার পূর্বে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে তা জনগণ মেনে নেবে না।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও জুলাই সনদ রচনা এবং কার্যকর করেই আসন্ন জুলাইকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে জোর দাবি জানাচ্ছে এনসিপি।