যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘লিবারেশন ডে‘ ঘোষণা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। এর আগে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। ২০২০ সালের ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমরা এখন আর যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতে পারি না আমাদের রোগীদের চিকিৎসার জন্য। কোনও যুদ্ধ শুরু হলে, আমরা প্রস্তুত নই।”
ট্রাম্পের ওই মন্তব্যে অনেকেই একমত। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আত্মনির্ভরশীল হওয়া প্রয়োজন—এটা প্রায় সবাই স্বীকার করে। ট্রাম্প যে যুক্তিগুলো তুলে ধরেছিলেন, যেমন: বাণিজ্য ভারসাম্য আনা, রাজস্ব বৃদ্ধি, চুক্তির জন্য কৌশল তৈরি—তার বাইরেও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করা জরুরি বলে ওয়াশিংটনের অনেকেই মনে করেন।
কিন্তু ট্রাম্প সেখানেই থেমে থাকেননি। তিনি চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে শুল্ক আরোপের কথা বললেও, বাস্তবে তিনি দীর্ঘদিনের মিত্র দেশগুলোর উপরও শুল্ক আরোপ করেন। এতে বৈশ্বিক অর্থবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ে।
ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য শুল্ক কার্যকর করা স্থগিত করেছেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না, তবে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাকি বিশ্ব এই উত্তেজনার পরিণতি মোকাবিলা করছে এবং ভাবছে—এই দুই দেশের উপর কতটা ভরসা করা যায়। কিংবা নিজ নিজ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার কি না।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতোই আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন। প্রায় এক দশক ধরে শি জিনপিং চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পণ্যের নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছেন। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকার চেষ্টা করেছে চীনের কাছে উন্নত প্রযুক্তি পৌঁছানো ঠেকাতে। কারণ তাদের শঙ্কা, এসব প্রযুক্তি হয়ত একদিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। তবে এই দুই নেতার মধ্যে মিল শুধু লক্ষ্যেই নয়, ভাবনার গভীরতায়ও। অনেক দিক থেকে তারা একে অপরের শক্তির প্রতি আগ্রহী। ট্রাম্প চীনের শক্তিশালী উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করতে চান। আর শি জিনপিং যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক প্রযুক্তি এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের প্রতি আগ্রহী। নীতিনির্ধারণের ধরনেও তারা একরকম; উভয়েই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত, বাজারের প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই।
২০২০ সালের শুরু থেকে শি জিনপিং বেশ কিছু বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজারে প্রবেশ ঠেকিয়েছেন, সম্পত্তির মূল্যে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ধস নামিয়েছেন, মহামারির সময় মাসের পর মাস সাংহাই নগরী লকডাউন করেছেন। এই সময়ের মধ্যে হাং সেং চায়না এন্টারপ্রাইজেস সূচক প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়। আর একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে।
চীনের এই কঠোর পদক্ষেপগুলো দেশটির ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে, বিশেষ করে আর্থিক খাতে। অনেক মেধাবী তরুণ কর্মীর বেতন কমে গেছে। কেউ কেউ আগে পাওয়া বোনাস ফেরত দিতেও বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যেই দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার হ্রাস পেয়েছে এবং অর্থনৈতিক গতি কমেছে। তবে কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা জনমত দমন করে রেখেছে।
গত কয়েক বছরে শি জিনপিং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘মেইড ইন চায়না ২০২৫’ কর্মসূচি। এই উদ্যোগের ফলে চীন বিশ্বের অগ্রণী কিছু আধুনিক শিল্পখাতে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ব্লুমবার্গ ইকনোমিক্স ও ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, চীন ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির মধ্যে ৫টিতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সৌর প্যানেল, উচ্চ-গতির রেল ও লিথিয়াম ব্যাটারি। বাকি সাতটি প্রযুক্তিতে, যেমন: ওষুধ উৎপাদন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চীন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
এই অর্জনগুলো বেইজিংয়ের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে। তাদের বিশ্বাস দীর্ঘমেয়াদে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলতে পারবে। একইসঙ্গে তারা চীনের শক্তিশালী উৎপাদন খাতকে ধরে রাখতে চায়। যেমন ট্রাম্প মনে করেন, কারখানা ও উৎপাদন খাত জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও বিশ্বাস করে—যদি অর্থনৈতিক সংঘাত কখনো বাস্তব যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে নিজেদের প্রয়োজনীয় সব কিছু নিজেরাই তৈরি করতে পারা দরকার।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সাবেক কর্মী জানান, তারা বুঝতে পারেন না কেন যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ধরে তাদের উৎপাদন খাত ধ্বংস করে কেবল আর্থিক খাতকে সমৃদ্ধ করেছে। তার এই বক্তব্য অনেক অর্থনীতিবিদ ও উৎপাদন বিশেষজ্ঞদের মতের সঙ্গে মিলে যায়। তাদের মতে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিগত পরিবর্তন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন খাতে কারখানা ফিরিয়ে আনা সস্তা ও বাস্তবসম্মত হবে না। আর এমন বাস্তবতার মধ্যেই ট্রাম্প সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ শুরু করেছেন। গত সপ্তাহে তিনি বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করেছেন, তা তার নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতির চেয়েও অনেক বেশি। এই শুল্ক আরোপে তাকে উৎসাহিত করেছেন তার উপদেষ্টা পিটার নাভারো। তিনি ডেথ বাই চায়না বইয়ের লেখক এবং বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন পুনরায় ফিরিয়ে আনার পক্ষে কথা বলে আসছেন।
ট্রাম্প তার শুল্কের বিপরীতে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া দেশগুলোর জন্য ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির ঘোষণা দিয়েছেন। আর চীনের ওপর তিনি শুল্ক বৃদ্ধি করেছেন ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত। এটি তার প্রথম মেয়াদে আরোপিত ২৫ শতাংশ শুল্কের তুলনায় অনেক বেশি।
গত ২ এপ্রিল “পাল্টা শুল্ক” সম্পর্কিত নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প বলেন, শতাব্দীজুড়ে চলে আসা বড় ও স্থায়ী বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রস্তুতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং এটি এখন দেশের অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য “অস্বাভাবিক ও গুরুতর হুমকি” হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে তিনি বলেন, “দশকের পর দশক ধরে আমাদের দেশকে লুট, শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে—কখনো শত্রুর হাতে, কখনো মিত্রের হাতেও।” তবে ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনার একটি বড় সমস্যা আছেছ। তার প্রস্তাবিত শুল্ক হার আসলে ‘পাল্টা’ বা সমান শুল্কহারের ভিত্তিতে নয়, বরং বাণিজ্য ঘাটতির উপর ভিত্তি করে তৈরি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র ও নিরাপত্তা অংশীদার দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের মতো দেশ, যার অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৬০০ গুণ ছোট, তাও এই শুল্কের আওতায় পড়েছে।
ট্রাম্পের দৃষ্টিতে যে কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রে যতটা বিক্রি করে, কিন্তু ততটা পণ্য কেনে না, সেটিই জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি—সে দেশ যত ছোটই হোক না কেন। এমনকি যদি সেটি হয় কোনো দূরবর্তী দ্বীপ বা শুধুই পেঙ্গুইন বসতিপূর্ণ এলাকা, তাও।
গত সপ্তাহে ফেইস দ্য নেশন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক বলেন, “যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছোট ছোট স্ক্রু লাগিয়ে আইফোন বানায়, সেই ধরনের কাজ আমেরিকাতেই আসবে।” তবে প্রশ্ন হলো—এই ধরনের চাকরি আমেরিকানরা আদৌ চান কি না। গত সপ্তাহে ২০১৭ সালের একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়া এক্সে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটিতে কৌতুকশিল্পী ডেভ শ্যাপেল ট্রাম্পের চীন থেকে চাকরি ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনার কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “কেউ ৯,০০০ ডলার দিয়ে আইফোন কিনতে চায় না। এই চাকরি চীনেই থাকুক। আমরা কেউ এত কষ্ট করে কাজ করতে চাই না।” তার কথায় দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়ে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয় চীনেও এই ধরনের কাজের প্রতি আগ্রহ কমছে। শি জিনপিংকেও দেশের ১৪০ কোটির মানুষকে কারখানার কাজের প্রতি আগ্রহী করতে বেগ পেতে হচ্ছে। সরকারি মিডিয়ায় বলা হয়েছে, এখনকার তরুণ অভিবাসী শ্রমিকরা কম বেতনের হলেও পণ্য ডেলিভারির কাজ করতে বেশি আগ্রহী। কারণ তারা আট ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কারখানায় কাজ করতে চান না।
এই বাস্তবতায় শি জিনপিং সরকার গত কয়েক বছর ধরে শ্রমজীবী শ্রেণিকে আরও দায়িত্ববান করার চেষ্টা করছে। সরকার শিশু-কিশোরদের ভিডিও গেম ও অলস জীবনের বিরুদ্ধে সচেতন করছে, যা চীনে ‘লাইয়িং ফ্লাট’ নামে পরিচিত।
২০২১ সালে একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে শি জিনপিং শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেন—তারা যেন শুধু বড় কোম্পানিতে চাকরি করার স্বপ্ন না দেখে, বরং এমন কাজ বেছে নেয় যা দেশের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য পূরণে সহায়ক। তিনি বলেন, “অধিকাংশ মানুষের জন্য কোনো পেশাই ছোট বা বড় নয়। যদি সমাজে আপনার প্রয়োজন থাকে, যদি আপনি সম্মান পান এবং ভালো বেতন পান—তাহলে সেটিই একটি ভালো কাজ।”
ট্রাম্পের সমর্থকদের মতে, অর্থনৈতিক যুক্তি অনুযায়ী না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপ মূলত একটি কৌশল। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা মিত্রদের আলোচনার টেবিলে আনতে চায়। বিলিয়নিয়ার ও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সমর্থক বিল অ্যাকম্যান ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির পক্ষে ছিলেন। রোজ গার্ডেনে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পর তিনি লেখেন: “অনেক সময়, আলোচনায় সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হলো—প্রতিপক্ষকে বোঝানো যে আপনি পাগল।”
কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতায় এমন একটি আঘাত হেনেছে যা সহজে ভুলে যাওয়ার নয়। এমনকি কিছু দেশ ৯০ দিনের সময়সীমার মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক চুক্তিতে পৌঁছালেও, ক্ষতি হয়ে গেছে।
১৯৭০-এর দশকে, মাও সে তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধাক্কায় বিপর্যস্ত ছিল চীন। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল। তখনও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা মিত্রদের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখতে কষ্টসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে ওয়াশিংটনে পাঠানো একটি গোপন বার্তায় সিউলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিখেছিলেন—তৎকালীন দক্ষিণ কোরীয় শাসক পার্ক চুং-হি যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদে নির্ভরযোগ্য মিত্র মনে করতেন না বলেই তিনি নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
প্রায় ৫০ বছর পর একই রকম সন্দেহ আবার দেখা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র রাষ্ট্র—বিশেষ করে নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জাপান এখনও সরাসরি কিছু না বলেনি। তবে ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই এমন সন্দেহ করছে। এসব দেশের নেতারা এখন শুল্ক থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য আলোচনা চালাচ্ছেন। তাই তারা প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন না। তবে বিশ্বের অন্যান্য অংশে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পুরনো মিত্র রাষ্ট্র খোলাখুলি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। জার্মানির বিদায়ী ভাইস চ্যান্সেলর রবার্ট হাবেক ট্রাম্পের শুল্ক নীতিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, “যে মাত্রায় ও দৃঢ়তায় জবাব দেওয়া উচিত, তা এই পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।”
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোম্পানিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বন্ধ রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “যে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ওপর শুল্ক বসাচ্ছে, তখন তাদের অর্থনীতিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করাটা ভুল বার্তা দেবে।”
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেন, “গত ৮০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল, বিশ্বাস ও পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে জোট গড়েছিল এবং মুক্ত বাণিজ্যকে উৎসাহ দিয়েছিল। এই সময় শেষ হয়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও আমাদের এখন এটাই বাস্তবতা।”
মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ট্রাম্প এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যা একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের প্রতিরক্ষা ব্যয় করার সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং অন্যদিকে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন যেকোনো যুদ্ধকে সমর্থন করা তাদের রাজনৈতিকভাবে আরও কঠিন করে তুলেছে।
২০২০ সালে প্রকাশিত “হ্যাজ চায়না অউন?: দ্য চাইনিজ চ্যালেঞ্জ টু আমেরিকান প্রাইমেসি” বইয়ে সিঙ্গাপুরের সাবেক কূটনীতিক কিশোর মাহবুবানি লেখেন, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভুল হলো—চীনের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা ও বিশ্বব্যাপী আস্থা নষ্ট করা। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাকে তিনি আস্থাহীনতার বড় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
এখন চীনকে বৈশ্বিকভাবে একঘরে করার পরিবর্তে, ট্রাম্প এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে—এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্রদের সঙ্গেও—অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের সুযোগ পাচ্ছেন। এসব দেশের মধ্যে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যুদ্ধ কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও অবকাঠামোগত সহায়তা দিতে পারত।
সর্বোচ্চ শুল্কের মুখে পড়া দেশগুলো দ্রুত ট্রাম্পের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাচ্ছে। তবে তারা এও জানে, ট্রাম্প চিরকাল থাকবেন না। তাই যুক্তিসঙ্গত কৌশল হবে—বর্তমানে ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা এবং ভবিষ্যতে এমন অবস্থায় না পড়ার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ এমন প্রস্তুতি নেওয়া যাতে আবার কখনো যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের চাপের মুখে পড়তে না হয়।