মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে সাভারে বিকেএসপির মাঠে খেলছিলেন তামিম ইকবাল। সোমবার (২৪ মার্চ) সকাল ৯টা থেকে বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে বসুন্ধরা ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ২০২৪-২৫ মৌসুমের চলছিল ম্যাচ। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তামিম। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করায় তাকে বিকেএসপির কাছেই শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন তিনি। দেশের অন্যতম সেরা এই ক্রিকেটারের অগণিত ফ্যান-ফলোয়ার ফেসবুকজুড়ে শুভ কামনা করছেন, প্রার্থনা করছেন। আর সঙ্গে আছে বিস্ময়— একটা ‘যেন-তেন’ হাসপাতালে কীভাবে এই সেলিব্রেটি ক্রিকেটারের রিং পরানো সম্ভব হলো?
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতাল গাজীপুর জেলার কাশিমপুর থানার তেতুইবাড়ীতে অবস্থিত একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ। এটি বাংলাদেশের প্রথম আইএমএস সার্টিফায়েড হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে নির্মিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে মালয়েশিয়ার স্বনামধন্য সেবা সংস্থা কামপুলান পেরুতান জহর (কেপিজে)।
মালয়েশিয়া হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের প্রথমবারের মতো তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসেন মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। সফরকালে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্ত্রী গাজীপুর জেলার এই হাসপাতাল উদ্বোধন এবং কেপিজে হেলথকেয়ার বেরহাদের কাছে হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন।
তামিমের অসুস্থতা ও চিকিৎসা নিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তার সঙ্গে শুরু থেকে থাকা চিকিৎসক, রেফারি ও মেডিসিন ফিজিশিয়ান। সেখান থেকে পুরো ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।
বিকেএসপি’র স্পোর্টস মেডিসিন ফিজিশিয়ান ডা. আ ফ ম সামির উল্ল্যাহ ফেসবুকে তার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, ‘ভেন্যুতে ডিউটি ডক্টর হিসেবে আমি কর্মরত ছিলাম। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে মাঠে ছিলেন তামিম ইকবাল ভাই। প্রতিপক্ষ ছিল শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব। খেলা শুরুর কিছুক্ষণ আগে ফিজিও এনাম ভাই আমাকে ফোন করে জানান যে, তামিম ভাই হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করছেন এবং দ্রুত মাঠে আসতে বলেন। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, ফিজিওর কল পেয়ে আমি দ্রুত মাঠে যাই। তামিম ভাই বলছিলেন, ব্যথাটা বুক থেকে চোয়ালের দিকে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে হালকা কমছে। এনাম ভাই ইতোমধ্যে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা ভেবে কিছু ওষুধ দিয়েছিলেন, কারণ তামিম ভাই নিজেও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা মনে করছিলেন। তবুও সতর্কতার জন্য আমি ইসিজি করার পরামর্শ দিলাম।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘ওষুধ খাওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি পেলেও প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর ব্যথা আবারও তীব্র হয়ে ওঠে। তখন আমরা দ্রুত তাকে বিকেএসপির কাছাকাছি কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে যাই। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ইমারজেন্সিতে পৌঁছে ইসিজি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় টেস্ট করানো হয়। ইসিজি রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সম্ভাব্য হার্ট অ্যাটাকের কথা মাথায় রেখে সমস্ত প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।
হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডা. মনিরুজ্জামান মারুফ শুরু থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং ইতোমধ্যে ভিভিআইপি কেবিনে শিফট করা হয় এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চিফ ফিজিশিয়ান ডা. দেবাশীষ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কল করা হয়। হেলিকপ্টার বিকেএসপির অ্যাথলেটিক্স গ্রাউন্ডে অবস্থান করছিল কিন্তু বিকেএসপিতে ঢোকার পরমুহূর্তেই তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় এবং তিনি পুরো শরীর ছেড়ে দেন। সেই মুহূর্তে তাকে ইমারজেন্সি সিপিআর দেওয়া হয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে রিসাসিটেশন করা পসিবল না। তখন এভারকেয়ার হাসপাতালে পাঠানো হলে খারাপ কিছু একটা ঘটতে পারে এই চিন্তা করে তাকে দ্রুত আমরা কেপিজে হসপিটালে নিয়ে আসি কারণ এক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। পথিমধ্যে কার্ডিওলজিস্ট ডা. মনিরুজ্জামান মারুফ স্যারকে আমি ইমার্জেন্সিতে সব ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফোনে অবহিত করি।’
তিনি জানান, কেপিজে হাসপাতালে পৌঁছানোর পরপরই ইমারজেন্সিতে কোড ব্লু কল করা হয়। ডা. মারুফের নেতৃত্বে একদল নিবেদিতপ্রাণ ও দক্ষ চিকিৎসক দ্রুততম সময়ে চিকিৎসায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাদের অভিজ্ঞতা ও তৎপরতার কারণে প্রয়োজনীয় সিপিআর, ডিসি শক ও বিশেষায়িত চিকিৎসা দ্রুত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। পরবর্তী সময়ে ক্যাথল্যাবে নিয়ে বিশেষায়িত চিকিৎসা সফল হয়। আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং কেপিজে হাসপাতালের ডিরেক্টর ডা. রাজীব ভাই ও তার টিমের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তামিম ভাইকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। আজ সারাটা দিন আমার সাথে বিসিবির ডা. দেবাশীষ স্যার, ডা. মনজুর, আমার কলিগ ডা. শামীম, ডা. আকাশ, জয় এবং অন্য সবাই সবসময় আমার সঙ্গে থেকে বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়ে আমাকে সাহায্য করেছে। এই পরিস্থিতিতে বিসিবির সমস্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিশেষ করে ফারুক স্যার এবং ফাহিম স্যার, সর্বক্ষণিকভাবে পাশে ছিলেন। বিকেএসপির মহাপরিচালক এবং ডাইরেক্টর স্যাররাও সরাসরি এই বিষয়ে সমন্বয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের আন্তরিক সহযোগিতা এবং সময়োচিত পদক্ষেপের জন্য আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘তামিম ভাই বর্তমানে সিসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন।’
পোস্টে তিনি খেলোয়াড়দের জন্য সতর্কবার্তা উল্লেখ করে বলেন, তামিম ভাইয়ের এই ঘটনা আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। একজন পেশাদার খেলোয়াড়ের এমন হার্ট অ্যাটাক আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিকেএসপির দুই কিশোর খেলোয়াড়ের মধ্যেও হৃদরোগজনিত সমস্যা দেখা গেছে। এটি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, খেলোয়াড় হলেই হার্টের সমস্যা হবে না—এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। যেকোনও ব্যথা বা অস্বস্তিকে অবহেলা করা উচিত নয়। বিশেষ করে যখন ব্যথাটি বুক থেকে চোয়াল বা অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাস্ট্রিক ভেবে ফেলে রাখা অনেক সময় মারাত্মক ভুল হতে পারে। তাই প্রতিটি খেলোয়াড়ের উচিত নিয়মিত চেকআপ করানো এবং শরীরে কোনও অস্বাভাবিকতা অনুভব করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
বেলা ১১টা ২০ মিনিটে আবারও কেপিজে হাসপাতালে নেওয়া হয় তামিমকে। অ্যাম্বুলেন্সে যাওয়ার পুরোটা সময় কার্ডিও-পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) শুরু করেন বিসিবির স্ট্রেন্থ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ ইয়াকুব চৌধুরী ডালিম। তিনিও এক ফেসবুক পোস্টে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। সেখানে তিনি তামিম ইকবালকে উদ্দেশ করে লেখেন, ‘সত্যি ভাই, একটা পর্যায়ে মনে হয়েছে আপনাকে হারাতে বসেছি কিন্তু মনটাকে শক্ত করে সমানে সিপিআর অ্যাপ্লাই করে গিয়েছি। বিস্তারিত বলার বা লেখার মতো অবস্থায় নেই। বারবার শুধু অ্যাম্বুলেন্সে পরে থাকা আপনার ওই নিথর দেহটার কথা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে সবটাই স্বপ্নে ঘটে যাচ্ছে। ২৫০-৩০০ সিপিআর চেস্ট কমপ্রেশন করার পর যখন আপনার একটু রেসপন্ডস পেলাম। সত্যি ভাই, মনে হয় কলিজায় একটু পানি পেলাম। শুধু এইটুকু বলবো, আপনি আমাদের মাঝে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।’
ম্যাচ রেফারি দেবব্রত পাল তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি শেয়ার করেছেন হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকালে আমরা দুই ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একসঙ্গে টস করি এবং এরপর তামিমের সঙ্গে প্রায় তিন থেকে চার মিনিট কথা হয়। এর পরেই আমি রুমে চলে যাই, কিন্তু কিছু সময় পরই টিম ফিজিও এনাম ফোন করে জানান, তামিম বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করছে এবং তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘মাঠে আমাদের অ্যাম্বুলেন্স ছিল, তামিমের গাড়িটাও ছিল। আমি দেখলাম, তামিম গাড়িতে উঠে চলে গেলো। আমিও সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলাম। চলে আসার পর খবর নিলাম কী অবস্থা, বললো আসার পর ডাক্তার ইসিজি করালো। ডাক্তারের কাছে শুনলাম, হাসপাতালের ডাক্তার কিছুক্ষণ থাকতে বলছেন, কিন্তু তামিম ঢাকায় যেতে চাইছেন। এরই মধ্যে সে তার পরিবারের সদস্য এবং হেলিকপ্টারের সঙ্গেও কথা বলেছে।’
তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি মাঠে, আমাদের বিকেএসপিতে যে ডাক্তার ছিলেন এবং ট্রেনার ডালিমের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। পরে যখন হেলিকপ্টার আসছে শুনলাম, মোহামেডানের ম্যানেজার ইনফর্ম করলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় ক্লিক করলো, আমার যে গাড়ি ছিল ওটা নিয়ে আসলাম ১ নম্বর মাঠের দিকে। ওখানে যে রানিং ট্র্যাক থাকে, ওখানে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করলো। আমরা যখন কাছে গেলাম, তামিমের কোনও কথা তো নেই, অচেতন অবস্থায়।’
তিনি জানান, ‘তখন আমরা ভয় পেয়ে গেছি। আমরা কি হেলিকপ্টারে তুলবো বা গাড়িতে রেখে কী করবো, ডাক্তারকে সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম। ডালিম পাঞ্চ করছে ওকে, মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে; পালস নেই এমন একটা অবস্থা। ডাক্তার জানান, হেলিকপ্টারে নিলে সে চিকিৎসা বঞ্চিত হতে পারে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতই সে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, জ্যামও ছিল না। ৪-৫ মিনিটের মধ্যে এলাম। এসে দেখলাম ডাক্তারদের পুরো একটা গ্রুপ রেডি হয়ে আছে। ওখানে সম্ভবত লাইফসাপোর্টে নিয়ে যায়।’
কেপিজে হাসপাতালের মেডিক্যাল ডিরেক্টর ড. রাজীব হাসান সোমবার দুপুরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যখন তাকে (তামিম) নিয়ে আসা হয়, তখন চিকিৎসা শুরু হয়। পরে আমরা চিন্তা করি, ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যাবে কি না। বিভিন্ন কারণে আসলে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যায়নি। পরে তার অবস্থা আসলে জটিল হয়ে যায়। জটিল অবস্থাতেই তিনি আসেন এবং জটিল অবস্থায় যত চিকিৎসা প্রয়োজন, সবই করা হয়েছে। আল্লাহর রহমতে পরিস্থিতি অনুকূলে আছে। তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সে জন্য এনজিওগ্রাম, অ্যানজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্ট (রিং) করা হয়েছে। ড. মারুফ তার (তামিম) এই স্টেন্টিং দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। এই ব্লকটা পুরোপুরি চলে গেছে।’
বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী বলেছেন, ‘ফাইনাল আপডেট হচ্ছে, তামিম দ্রুতই রেসপন্স করছেন। সব কিছুই পজিটিভ। ২৪ ঘণ্টার আগে তো শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। তবে অবস্থার উন্নতির হচ্ছে তার। এখনও অফিশিয়ালি কিছু বলা যাবে না। রেসপন্স করছেন তিনি।’