দেখিতে দেখিতে আমার ভুবন হইতে প্রায় ৯২ টি বসন্ত পার হইয়া গিয়াছে । আজ অপরাহ্ন বেলায় বসিয়া ফেলে আসা দিনগুলোর কতই না কথা মনের মাঝে আন্দোলিত হইতেছে।
শতাব্দীর বিচারে আমাদের বিয়ানীবাজার উপজেলার জলঢুপ এলাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্য বহু পুরাতন হলেও এর প্রসার ঘটে মূলত ১৯৩২ সনের পরে।
এ সংসারে মাঝেমধ্যে এমন দুই একজন মহামানবের জন্ম হয় যারা সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করিলেও উত্তর কালের সাধারণ মানুষের জন্য স্বদেশ ও স্বজাতির তথা স্ব এলাকার মঙ্গলের জন্য নিজেকে তিলে তিলে দান করে কালের বুকে অক্ষয় পদচিহ্ন রেখে যান এবং মানব হৃদয়ে স্হায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করে যান। জলঢুপ বড়বাড়ি নিবাসী স্বর্গীয় সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা এমনই একজন মহান ব্যক্তিত্ব ।
অত্র এলাকার মানুষ যখন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত মানুষে মানুষে হানাহানি তখন স্থানীয় জমিদার স্বর্গীয় সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা ( সতেবাবু) দেশকে ভালোবাসেন বলে প্রথমে ১৯৩২ ইং সনে একটি বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিলেন। জলঢুপ কমলাবাড়ি নিবাসী স্বর্গীয় দেবেন্দ্রনাথ শর্মা, স্বর্গীয় নৃপেন্দ্রনাথ শর্মা, স্বর্গীয় বেনওয়ারী লাল শর্মা, স্বর্গীয় বংকবিহারী শর্মাদের যৌথ বৈঠকে মদনমোহন স্টেট এর পক্ষ থেকে দেড় একর জমি দানের মাধ্যমে মধ্য ইংরেজি স্কুল নামে আমার জন্ম।
৩০-৩৫ জন ছাত্র নিয়ে হবিগঞ্জের সাতাউক নিবাসী স্বর্গীয় সারদাচরণ অধিকারী ( বিএ)কে প্রধান শিক্ষক ও একজন সহকারি শিক্ষককে নিযুক্ত করে আমাকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুইজন শিক্ষক দ্বারা বিদ্যালয় চলেনা বলে গোপেন্দ্র বাবুর দ্বারা বাকি শিক্ষকের পদ পূরণ করা হয়। ১৯৪৪ থেকে ৫২ পর্যন্ত শ্রীজিতেন্দ্র লাল শর্মা ( ফালু বাবু) শিক্ষকের খালি পদ পূরণে নিজের শ্রমের মাধ্যমে বাকি পূরণ করে গিয়েছেন।
আমার ২য় প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন করিমগঞ্জ খলাছড়া নিবাসী স্বর্গীয় দীনেশ চন্দ্র শর্মা। তৃতীয় প্রধান শিক্ষক শ্রীমঙ্গলের প্রীতি রঞ্জন শর্মা, চতুর্থ প্রধান শিক্ষক শ্রী সুরেশ চৌধুরী তিনি ভুরুঙ্গা বালাগঞ্জের লোক তার আমলেই আমি হাই স্কুলে পরিণত হই। পঞ্চম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী গুরুদয়াল পাল তিনি হবিগঞ্জের লোক ছিলেন। ষষ্ঠ প্রধান শিক্ষক ছিলেন দত্তপাড়া বালাগঞ্জ নিবাসী শ্রী রসময় দেব। সপ্তম প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু কৃষ্ণ কুমার আদিত্য তিনিও হবিগঞ্জের লোক ছিলেন। অষ্টম প্রধান শিক্ষক বড়দেশের জনাব আজির উদ্দিন,নবম প্রধান শিক্ষক জনাব আকমল আলি তিনি জলঢুপ এলাকার লোক। দশম প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব আব্দুল হাসিব, তিনি আব্দুল্লাপুরের লোক। একাদশ প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব জালাল উদ্দিন তিনি পাড়িয়াবহরের লোক এবং দ্বাদশ প্রধান শিক্ষক জনাব মো মুছব্বির আলী তিনি জলঢুপ পাটুলী এলাকার লোক।
আমাকে যারা লালন পালন করেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে অষ্টম প্রধান শিক্ষক জনাব আজির উদ্দিন কে, যিনি ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে আদর যত্ন করে আমাকে বড় করার দায়িত্ব পালন করিয়াছেন।
আমার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৩২ সনে। ৩০হাত×৯ হাত বাঁশের বেড়া ও টিনের চাল দিয়া আমার জন্ম।কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমার পরিবর্তন ঘটিলো। বাঁশের বেড়া ভাঙ্গিয়া ইটের দেওয়াল তৈরি করা হলো বর্তমানে ছাত্র/ ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৮০০ জন।ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। কোমলমতি বালক বালিকারা বই খাতা লইয়া আমার বুকের উপর যখন হাটাহাটি করে তখন আমার মন খুশিতে ভরিয়ে যায় আমি তাদেরকে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। যখন তাদের মধ্যে কয়েকটি ছেলে আমার দরজা জানালা ডেস্কবেঞ্চ ধরিয়া ধাক্কাধাক্কি করে,তখন আমার মেজাজ একেবারে খারাপ হইয়া যায়।
প্রত্যেক বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পূর্বে আমার বুক কাঁপিতে শুরু করে আমার সব ছাত্রছাত্রিরা যখন শুনি ভালো ফল করিয়াছে তখন আমি খুশিতে আত্মহারা হইয়া পড়ি। যখন কেউ কেউ পরীক্ষায় খারাপ করিয়া থাকে তখন কষ্টে আমার চোখে পানি আসে। 1963 সালে আমারই লালিত শ্রী বিজয় চন্দ সমগ্র কুমিল্লা বোর্ডের মধ্যে যখন নবম স্থান অধিকার করে সমগ্র দেশবাসীর নিকট আমাকে পরিচিত করিয়াছিল, তখন আমার বুক গর্বে ফুলিয়া উঠে।
গত ১৯৮৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আমার বুকের উপর দিয়ে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে চলিয়া গেল তাহা এখন আমার মনে হইলে আমার সমস্ত শরীর শিহরিয়া ওঠে। আহা! কি করুন স্মৃতি। এই দুর্যোগে আমার ২/৩ টা অঙ্গ বিধ্বস্ত করিয়ে দিয়া যায় আমার সেই বীভৎস মর্মান্তিক দৃশ্য দেখিয়া আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা বেদনায় মূহ্যমান হইয়া পড়িলেন। তখন আমার মাথা গুজিবার জায়গা ছিল না। কোথায় আমার ছাত্রছাত্রীদের রাখিবো কি করিব তখন আমি একেবারে দিশাহারা হইয়া পড়িলাম। তখন আমার এই অবস্থা দেখিয়া আমার পরিচালকও( প্রধান শিক্ষক জনাব আজির উদ্দিন) আমার সাথে দিশেহারা হইয়া পড়িলেন। তিনি এলাকার অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছে আমার পুনর্বাসনের জন্য হাত পাতিলেন।
তখন অনেকেই দূরে সরিয়ে দাঁড়াইলো এবং কেউ কেউ লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিয়া পাশ কাটিয়া পড়িল। এ সময় আমার মনে খুব দুঃখ হইলো এবং শুনিয়া আমার কর্ণ দুটি শ্রবন ক্ষমতা হারাইবার উপক্রম হইল। আমি মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম তাদের সেবার জন্য আমার জন্ম,আজীবন তাদের সেবা করিব এই ছিল আমার ধর্ম, আজ তাহারা আমার দুর্দিনে আগাইয়া আসিল না। আমি ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়িয়া যখন লন্ডভন্ড তখন আমার মনে একটা কল্পনার সৃষ্টি হইল আমার তো অনেক ছাত্রছাত্রী আজ বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ ব্যারিস্টার হইয়াছে তাহারা আমার চিকিৎসার জন্য আগাইয়া আসিল না। সেজন্য আমার হৃদয় দুঃখে ভরিয়ে গেল- আমি কি করিব অসহায় হইয়া পড়িয়া রইলাম।
শেষ পর্যন্ত কাঁদিতে শুরু করিলাম আমার এই কষ্ট দেখে আমার পরিচালকের( প্রধান শিক্ষক আজির উদ্দিন) চেষ্টায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তখন ইউএনও আসিলেন বিভিন্ন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, স্কুল কলেজের শিক্ষকরা আসিলেন সবাই বিভিন্ন হারে চাঁদা দেওয়ার জন্য নাম লিখাইলেন। ৭/৮ জন ছাড়া বাকি সকলের নাম বৃথা খাতায় লেখা রইল।
যাহোক অনেকের চেষ্টায় ও আল্লাহর মেহেরবানীতে আমার বিধ্বস্ত হওয়া একটা অঙ্গের চিকিৎসা হইল এবং বাকি একটা অংশ এবং আমার পরিচয় বহনকারী ফটক এক হৃদয়বান বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তি আমারই প্রাক্তন ছাত্র আব্দুল্লাহপুর নিবাসী জনাব কমর উদ্দিন আমার পুনর্বাসন করাইয়া তাহার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করিলেন। আমার বিধ্বস্ত অঙ্গ চিকিৎসা করে তার বাবা জনাব হাজী রইছ আলী সাহেবের নামে একটি একটি ভবন তৈরি করে দিলেন তৎসঙ্গে আমার পরিচিতির জন্য নামের একটি ফটক( গেইট) তৈরি করে দিলেন। তিনি সহ যাহারা আমার পুনর্গঠনে সক্রিয় সহযোগিতা দান করিলেন তাদের কথা আমার মনের খাতায় চিরদিনের জন্য সমুজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।
এখন আগের চেয়েও আমার সৌন্দর্য অনেক বাড়িয়াছে। অন্য দশটা স্কুলের তুলনায় আমি অনেক সুন্দর বটে। নিজের মুখে নিজের প্রশংসা ঠিক হইল না। তবে যাহা সত্য তাহা প্রকাশ করিলাম।
বিকাল ৫টার পর ছাত্রছাত্রীরা যখন তাদের নিজ নিজ বাড়ি চলিয়া যায় তখন আমি একেবারে একা হইয়া পড়ি।
মাঝে মাঝে আমার দুঃখ দেখিয়া বিভিন্ন ধরনের লোকজন আসিয়া আমার কোমল ঘাসের উপর বসিয়া বিভিন্ন ধরনের আলাপ আলোচনা করে, আমি কিন্তু সব শুনতে পাই এবং খুব খুশি হই। যখন তাদের মাঝে কেউ কেউ আমার ভিতরে ঢুকিয়ে পড়ে এবং আমার ফুল গাছগুলো ছিড়িয়া ফেলে কিংবা দেওয়ালে লেখালেখি শুরু করে তখন আমার হৃদয় দুঃখে ভাঙ্গিয়া পড়ে। মনে মনে চিন্তা করি আমিতো তাদেরই নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। আমার সুন্দর অসুন্দর তাদেরইতো দেখাশোনা কর্তব্য। তারা কেন আমার সহিত এইরুপ ব্যবহার করে? তাহারা মানুষ হইয়া কেন বুঝেনা।
আমার পাশের মসজিদটি আমার সাথে যার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যয় ঘটিয়াছিল ছিল তা এখন আর কারোও নজরে পড়ে না। এখানে যে একটি মসজিদ ছিল তা হয়তো বর্তমান প্রজন্ম জানেইনা।
পরিশেষে এইটুকু বলে শেষ করি, আমি তোমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আমাকে দেখাশোনা তোমাদেরই কর্তব্য ।তাহলে আমার জীবনী শক্তি আরো বৃদ্ধি পাইবে এবং আমি তোমাদের আরো সেবা করিতে পারিব। এই আশা ব্যক্ত করে সহস্র ভালোবাসা জানিয়ে বিদায় নিলাম। ধন্যবাদ। (তথ্য সংগৃহীত)
মো. কবির খান : প্রধান শিক্ষক ( অবসরপ্রাপ্ত) সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। সাবেক সিনিয়র শিক্ষক ও জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থী।