‘মহান ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরও ভাষাশহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু লোক নিহত হলেও তাঁরা সবাই ভাষাশহীদের স্বীকৃতিও পাননি। এমনকি কতজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন তা-ও নিরূপণ করা হয়নি। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আজিজুল পারভেজ।
ভাষাশহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঁচজন—আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান।
২০০০ সালে তাঁদের রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছিলেন বরকত, জব্বার ও রফিক। ভাষাশহীদদের মধ্যে কেবল সালামই মিছিলে থেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মারা যাননি। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে আহত হয়ে চিকিত্সাধীন অবস্থায় ৭ এপ্রিল মারা গিয়েছিলেন তিনি। আর শফিউর রহমান শহীদ হয়েছিলেন ২২ ফেব্রুয়ারি।
২২ ফেব্রুয়ারি প্রাণ হারানোর তালিকায় আরো দুটি নাম পাওয়া যায়—অহিউল্লাহ ও আবদুল আউয়াল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে ভাষাশহীদ হিসেবে এই দুজনের নাম-পরিচয় উল্লেখ আছে। এ ছাড়া সালাউদ্দীন নামেও একজন ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু একুশের শহীদ হিসেবে তাঁদের স্বীকৃতি মেলেনি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পাঁচজনই ভাষাশহীদ হিসেবে সমাদৃত হচ্ছেন। তাঁদের ছবিই সর্বত্র শোভা পাচ্ছে।
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সংখ্যা সম্পর্কে ভাষাসংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিক বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি সীমাবদ্ধ বৃত্তে গুলি চালনা সত্ত্বেও কমপক্ষে চারজন শহীদ হয়েছিলেন। এ ছাড়া অন্যদের সম্পর্কে কিছু বলা যাচ্ছে না।
কিন্তু ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ব্যাপক গুণবিক্ষোভের মুখে টহলরত পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনী একাধিক স্থানে গুলি চালনার ফলে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন বলা কঠিন। বিশেষ করে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে যেখানে সুযোগমতো লাশ তুলে নিতে দেখা গেছে, সে ক্ষেত্রে শহীদদের সঠিক সংখ্যা কোনো দিন বলা সম্ভব হবে না।’
দৈনিক আজাদের ওই সময়ে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট ৯ জন নিহত’ এবং অন্য একটি সংবাদে ‘পুলিশের গুলিতে গতকল্য ও অদ্য এ যাবত্ ৬ জন নিহত হয়’ উল্লেখ করা হয়।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কবির উদ্দিন আহমদ ‘একুশের ইতিহাস’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আটজনের মৃত্যুর কথা সন্দেহাতীতভাবে জানা যায়।’ এই সূত্র ধরে এম আর আখতার মুকুল আটজন ভাষাশহীদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। তালিকাটিতে ২১ ফেব্রুয়ারি রফিকউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম এবং ২২ ফেব্রুয়ারি শফিকুর রহমান, আব্দুল আউয়াল, অহিউল্লাহ ও অজ্ঞাত বালককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ২১ ফেব্রুয়ারি ‘গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন। জানা যায়, ৬২ জনকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আরো শোনা যায়, পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন।’ ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি লিখেছেন, ‘আজ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল। হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি সূত্র অনুয়ায়ী মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু।’
তত্কালীন মার্কিন দূতাবাসের পাঠানো তারবার্তা থেকেও শহীদের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ঢাকা থেকে তারবার্তাগুলো সরাসরি পৌঁছাতে নাও পারে—এই আশঙ্কা থেকে কনসাল জেনারেল বোলিং ইসলামাবাদে রাষ্ট্রদূত ওয়ারেনের সাহায্য নেন। ওয়ারেন লিখেছেন বোলিংয়ের বরাতেই। সেখানে বোলিং দুই দিনে নিহতের সংখ্যা ১৪-এর বেশি বলে উল্লেখ করেন এবং আহতের সংখ্যা অগণিত।
ভাষাশহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি না হওয়া প্রসঙ্গে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, ‘এই তথ্য চিরকাল অজানা থেকে যাবে যদি সরকার সংরক্ষিত গোপন তথ্যাদি প্রকাশ না করে। সাধারণত নির্দিষ্ট সময় পর এ ধরনের তথ্য জনস্বার্থে প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তান আমলের পর আশা করা গিয়েছিল সরকার এই কাজটি করবে। কিন্তু হয়নি।