এই হেন পরিস্থিতিতে শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ঢাকায় প্লটের জন্যে আবেদন করেন। ১৯৫৭ সালে ২ হাজার টাকা এককালীন জমা দিয়ে তাঁর নামে ধানমন্ডিতে পিডব্লিউডি-র কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা মূল্যে ১ বিঘার একটি প্লট বরাদ্ধ পান। বাকি ৪ হাজার টাকা ছিল কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য।
১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধু আলফা ইনস্যুরেন্সে ৩ হাজার টাকা বেতনে উচ্চপদে চাকরি পান। উচ্চ বেতনের টাকা থেকে বঙ্গবন্ধু ১৯৬১ সালে বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। সেই বছরই তিনি সপরিবারে নির্মাণাধীন বাড়িটিতে ওঠেন। তার পরেরটা ইতিহাস, বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ীটি।
এই বাড়িতে থেকেই তিনি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬ সালের দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, একাত্তরের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষী এই বাড়ি। এসব আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৩২ নম্বরের এই বাড়ি।
এখান থেকেই ট্রাঙ্ককলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিলেন কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড ও লাল সবুজের পতাকা। এই বাড়িতেই শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। এই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
এই বাড়ি থেকেই একাত্তরের ২৫ শে মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অবরুদ্ধ নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই বাড়িতে কোন আঁচল লাগায়নি।
এ বাড়িতেই ঘাতকেরা ঘটিয়েছে মানবেতিহাসের এক কলঙ্কময় ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত এই বাড়িটি সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্যকেই এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে ফিরলেও সেদিন তাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
বাড়িটি নির্মাণে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক হাউস বিল্ডিং থেকে নেয়া। তৎকালীন সরকার প্রায় ১২ হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় ওজুহাতে নিলামে চড়ায় বাড়িটি। সে টাকা পরিশোধ করে বাড়ি বুঝে নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের জুন মাসের ১০ তারিখে বাড়িটি বুঝে নেওয়ার পর দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘোষণা করেছিলেন ঐতিহাসিক এই বাড়িটি হবে জনগণের। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। ট্রাস্টিই বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দেয়।
এ বাড়ি একটি ইতিহাস। এ বাড়ির প্রধান ওই ইতিহাসের স্রষ্টা। ইতিহাস যেখানে সৃষ্টি হয়, সেটিই তো তীর্থস্থান। বাঙালি জাতির তীর্থস্থান ধানমন্ডির এ বাড়ি। এই বাড়ির সঙ্গে মিশে আছে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা।
এই বাড়ীর অপরাধ – এই বাড়ীর মালিক পাকিস্তান ভেঙে বাঙালিকে স্বাধীন সার্বভৌম একটা দেশ দিয়েছিল – একটা পতাকা দিয়েছিল যেটা এখানে উত্তোলন করা হয়। একটা মানচিত্র দিয়ে ছিল। পলাশীতে যে স্বাধীনতার সূর্য ডুবে যায় – সেটা ৩২ নম্বর থেকে উদয় হয়। এখান থেকেই দেয়া হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাই তো সেই পরাজিত শক্তির আক্রমণ এই বাড়ীতে। এরা আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধিকারের সংগ্রামকে মুছে দিতে চায়। এরা আমাদের সকল অর্জন ধ্বংস করে, তাদের মত ইতিহাস বানিয়ে আমাদের শাসন করতে চায়।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তিনতলা বাড়ির প্রতিটি কক্ষ। নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় ১৫ আগস্ট এর নির্মমতার চিত্র এবং বঙ্গবন্ধুর সাধারণ জীবন যাপনের নিদর্শনগুলো। বিনষ্ট করা হয় ভবনের সামনের দিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশে রাখা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও।
জাদুঘরে রূপান্তরিত বাঙালি জাতির ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি পূর্ব ঘোষণা দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয় ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে।