‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়
বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়
মুখ ঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায়
মানুষকে কি দেখে চিনবে বলো।‘
গীতিকার আজাদ রহমান কী চিন্তা-চেতনা বোধে লিখেছিলেন জানিনা। সুরকার ফজলে খোদার সুরেও এতো দরদ ফুটে উঠার পেছনে নিশ্চয় মৌলিক কারণ ছিল- ব্যক্তিগতভাবে আমার বিস্ময়াবহ আগ্রহ আছে ।
জন্মভুমি বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনেরর ইস্যুটি খুব স্বাভাবিকভাবে প্রবাসে পরাগায়িত হয়েছে। প্রায় আট হাজার নটিকেল দূরের লন্ডনে থাকি,আমার মতো অগণন যুগে যুগে প্রবাসী, অভিবাসী হয়েছেন, হলফ করে বলা যায় সবার কাছে তার জন্মমাটি সবচেয়ে আপন, বোধেরঘনিষ্টভূমি। আরেকটি বিষয় – প্রবাসীরা এখানে শুধু টাকা রোজগারের জন্য কাজ করেনা। প্রাতিষ্ঠানিক,বুদ্ধিভিত্তিক,অনুকরণীয়,অনুসরণীয় ও প্রেরণাদায়ি কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশকেও আলোকিতভাবে তুলে ধরার মতো সবচেয়ে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি প্রতিনিয়ত করে।
অন্নদাশঙ্কর রায় এর বিখ্যাত একটি কথা আছে- ‘মাটি যে আমাদের কত বড় আশ্রয়স্থল সমুদ্রের উপর অসহায়ভাবে ভাসমান না হলে হৃদয়ঙ্গম হয় না।‘
দুই যুগের বেশী সময় থেকে লন্ডন আমার দ্বিতীয় আবাস ভূমি। অন্নদাশঙ্কর রায় থেকে ধার নিয়ে আমার মতো করে, মনকে বুঝাতে বলি – মাতৃভূমি যে কত আপন তা প্রবাসে বাস না করলে বুঝা যায় না।
বলতে গেলে দেশকে নিয়ে সবচেয়ে বেশী ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলাম ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় নিয়ে। বাঙালীর স্বাধীনতাকে খাবলে খেয়ে পরাধীন রাখতে চেয়েছে যারা, ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ বীর মাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার বিপক্ষে যারা প্রমাণীতভাবে ছিল; তাদের আদালত কর্তৃক সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবির বিরুদ্ধে যারা লন্ডনে দাড়িয়েছিল। যারা আলতাব আলী পার্কে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা করেছিল। এই সবে মোটাদাগে স্বাধীনতা পরবর্তি প্রজন্মরাই ছিল। এসব মেনে নেয়ার বিষয় নয়। এসবে ‘যদি‘ বা ‘কিন্তু‘ নেই বলেই বুকে দহন জ্বলেছিল।
আমাদের লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের চরম বিকৃত সময়। যা জেনেছি স্পষ্টতই পারিবারিকভাবে, শিক্ষক বাবা,মা, স্বজনদের কাছ থেকে। বলতে দ্বিধা নেই, মাতৃভূমির তাগিদে আমাদের একটি স্পষ্ট প্রতিবাদ ছিল। লন্ডনে ‘তুই রাজাকার’ শিরোনামে একটি বড় প্রতিবাদ সভার মাধ্যমে আমাদের অবস্থান ও প্রতিবাদ ছিল। এই লন্ডনে কাফনের প্রতীকী কাপড় সহ ভয়বার্তা লেটার বক্সে পেয়েছি। কাজে কাদের পাহারায় ভোরে যেতে হয়েছে অনেকদিন- ডাটা প্রটেকশন এক্টের কারণে এখানে বলছিনা । কয়েক বছর পরে, বাংলাদেশে শিক্ষক বাবার মৃত্যুর সময়ে ফজরের নামাজে একা যাবার সাহস মোটেই ছিলনা। তবে সচেতনভাবেই এসব নিয়ে রাস্ট্রের সুযোগ নেইনি।
‘ রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের জন্য লিখেছেন-
‘‘ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা
তবু জানিনে যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা
আমার জনম গেল বৃথা কাজে।’’
দুই।।এই সুযোগটি আসলে কে দিয়েছে?
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আগে- পিছে ‘রাজাকার‘ শব্দটি বহুল উচ্চারিত হওয়ার সুযোগটি আসলে কে করে দিয়েছে? এটার সহজ উত্তর সবার জানা। একইভাবে কোটা পদ্ধতির দাবীটিও যে স্পষ্টত যৌক্তিক সেটাও আমাদের জানা। এবং বাংলাদেশের চোখ খোলা অন্ধচোখের রাষ্ট্রযন্ত্রও খুব ভালো করে জানে। এই দাবীটি উঠেছে বাংলাদেশের মেধাভিত্তিক ভবিষ্যত বিনির্মাণের জন্য। গণতান্ত্রিত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পিয়নের চারশত কোটি টাকার মালিক হওয়ার মতো অযোগ্যদের অসংখ্য উদাহরণ যখন গণমাধ্যমে উঠে আসে। এবং তাদেরকে বিচারের আওতায় না এনে নিরাপদে দেশ ত্যাগের সুযোগ করে দেয়া হয়, তখন ছাত্রসমাজের দাবীটি মূলত দেশের জন্য অনন্ত ‘ফটিক জল’ ছিল বলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ মনে করেছে। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত নয়- কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্ফোরণ তাই বলছে।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখতে ইন্টারন্টে সংযোগ বন্ধের বিষয়টি দেশে-বিদেশে তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। নেটিজেনরা বলছেন- একই সাথে দেশ প্রেমের বিপরীতে ইগো, ক্ষমতা, দাম্ভিকতা যে দীর্ঘদিনের চর্চিত সম্মানিত সন্মোধন- আপা, মমতাময়ী, মানবতার মা ইত্যাদি বিশেষণকে লজ্জা দিয়ে লীন হতে পারে- সেই উদাহরণ ছাত্রসমাজ তাদের যৌক্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে করে দেখিয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে শুরু থেকে। তেমনি দেশের এলিট শ্রেণীর পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীদের নিষ্ক্রিয়তা এবার তুমুলভাবে আমজনতার বিবেককে জাগিয়েছে। এর আগে রাষ্ট্রযন্ত্রকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে রাখা আমলাদেরকে ‘দুনীর্তির অন্যতম কামলা‘ স্বীকৃতি দিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন সংসদে আইন প্রনেতারা। এবার ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে জাতির শিক্ষাগুরুদের আদর্শচুত্য, দলকানানীতি সুস্পস্ট করলো – এরাই জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে ডুবানোর জন্য যথেষ্ট।
একই সাথে এটাও স্পষ্টভাবে উঠে আসল যে, ছাত্রদের নায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে কে বা কারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টায় লিপ্ত । নেতাহীন দল বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীতে চলা দলগুলো কোটা আন্দোলনে ঢুকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কৌশলটি সাধারণ মানুষও আন্দাজ করতে পেরেছে বলে মনে করা হয়।
আবার নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন সেনাবাহিনী কী করছে- তাও বুঝতে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দরকার নেই !
ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা নিলে সরকারের সমন্বয়হীন ও বাস্তবতা বিবর্জিত বহুমুখী কথামালা, স্কুল ছাত্রের রিমান্ড এসব অতি উমসাহি সিদ্ধান্ত সাধারণ জনগণকে বুঝতে ধাধায় ফেলছেনা যে- সরকারের ভিতরে একটি “বারমুডা ট্রায়াঙ্গল “ আছে!
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বিটিভি আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে বলে এর সাথে সংশ্লিষ্টরা জানায়নি এখনও। তবে ছায়া বিটিভি হয়ে সামাজিক যোগাযোগে আবিভূর্ত সময় টিভি ভবিষ্যতে খন্দকার মোস্তাকের পথ অনুসরণ ‘করবে নাকি করবে না’ – তা বিলেতের রাজনীতি সচেতনদের চায়ের আড্ডার প্রধান অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে ।
তিন ।। লন্ডনে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এই ক্ষতটি বহুদিন থাকবে
বলা হয়- যেখানে মানুষের বসতি সেখানে বাঙালিদেরও বসবাস। এবং বাঙালি যেখানে যায় তার শিকড়, সংস্কৃতি ,ঐতিহ্য নিয়েই যায়। আমরা যারা প্রবাসে থাকি, প্রায় সবার মনোজগতের বড় অংশ জুড়ে –মা-মাটি-স্বজনরা হার্দিক প্রশান্তি নিয়েই থাকে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতার খবর সামাজিক যোগাযোগে ছড়িয়ে পড়ায় প্রবাসীরাও এই ইস্যুতে নানাভাবে যোগ দেন। যদিও যুক্তরাজ্যে কোটা আন্দোলন ইস্যুটি প্রথমে কোন রাজনৈতিক ব্যানারে ছিল না। পরবর্তিতে যুক্তরাজ্য বিএনপি ও জামাতের অঙ্গ সংগঠন নানা সাংগঠনিক ব্যানারের মাধ্যমে আন্দোলনে নেমে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সমাবেশ করে এখন প্রকাশ্যে লীড দিচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সভায় গিয়ে হামলা, ভাঙ্গচুর, গ্রেফতার ও সংবাদের শিরোনাম হওয়াতে ডাইবার্স কমিউনিটিতে বাংলাদেশীদের জন্য একটি কলঙ্কিত ঘটনা হিসাবেই থাকবে। এর দায় বিএনপি-জামায়াত এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই বলে কমিউনিটির সচেতন মহল মনে করে।
অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও জাতীয় ইস্যু নিয়ে পাল্টাপাল্টি যুক্তরাজ্যে বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে। এনিয়ে তর্ক-বিতর্ক-বাকযুদ্ধও কম হয়নি। এসব ইতিবাচক না হলেও মোটাদাগে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা কমিউনিটিকে এভাবে এর আগে অপমান, অপদস্থ হতে হয়নি। মাত্র কয়েক সপ্তাহ পূর্বে চার বৃটিশ-বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রাজনীতিক শুধু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যাননি। এদের দুজন মন্ত্রীও হয়েছেন। কমিউনিটিতে আলো ছড়ানো সময়ে যেন অনেক কিছু ম্লান করে দিল – এই কলংকিত সংবাদটি। শতাধিক পুলিশ ও তাদের হেলিকপ্টারের প্রদক্ষিণ দৃশ্যটি দেখে হাজার হাজার মানুষ এর কারণ জেনে নিজেদের ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত বাজেভাবে। যা আমাদেরকে লজ্জিত করেছে এবং বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এই ক্ষতটি বহুদিন থাকবেও।
চার।। ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয় ’
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এখন টক অব দ্যা টাউন হলো – সামাজিক যোগাযোগে আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনে কিছুদিন আগেও যারা অতি নিবেদিত ও এক্টিভ রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নিজের পরিচয় বহন করে মন্ত্রী,এমপিদের এয়ারপোর্ট থেকে ফুল দিয়ে আনা থেকে শুরু করে সভা, সমাবেশ ও সামাজিক যোগাযোগে সবর থাকতেন । সরকারের এই দু:সময়ে তাদেরকে কেন সভা, সমাবেশ , সামাজিক যোগাযোগে দেখা যাচ্ছে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলে ভুয়া তথ্য ও গোজব ছড়ানোর অভিযোগ করছে আওয়ামীলীগ। এবং জনগণকে এবিষয়ে সঠিক তথ্য জেনে সচেতন হতে বলা হচ্ছে বারবার। কিন্তু খোদ নিজ দলের নেতাকর্মীদের তাদের -ভাষায় প্রকৃত সত্য অথবা সত্যাশ্রয়ী তথ্য নিয়ে আগের ঐ সরব নেতৃবৃন্দকে এখন কেন দেখা যাচ্ছে না? হাতে গুনা দু একজন নেতা,কর্মী ছাড়া কেন তারা নিরব দর্শকের ভূমিকায় !
যুক্তরাজ্যে আওয়ামীলীগের প্রগতির শ্লোগাণ বাহি ঐসব অতিরাজনৈতিক নেতা- কর্মীদের হাতে অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগটি আছে। তারা কেন যুক্তি, তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগে এর প্রতিবাদে নেই। শত শত কর্মীদের নেতা হওয়ার দৌড়ে তারা কী নিজেকে এখনও প্রস্তত করতে পারেননি।
নচিকেতার গাণে নিজেকে খুজতে হচ্ছে-
কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়?
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার ডানা?
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা
পাচ।। অদ্ভুত দেশপ্রেম ও খাঁটি ব্যক্তিগত স্বার্থ
বিগত প্রায় এক দশকে লন্ডনে প্রবাসী বাংলাদেশী কিছু প্রগতিশীল তকমা লাগানো তারুণ্যকে খুব সিরিয়াস মানবাধিকার কর্মী ও লেখক হয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখেছে কমিউনিটির সচেতন মহল। বিলেতে বাংলাদেশীদের সাফল্য, সমস্যা কিংবা সম্ভাবনা তাদের লেখার বিষয় ছিলনা। তারা শুধুমাত্র কনসার্ন ছিলেন- বাংলাদেশের ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে। সরকারের দুর্নীতি,প্রশাসনে আমলাতন্ত্রের অবাধ বিচরণ, প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস, সাগর –রুনি হত্যাকান্ড, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে প্রকাশ্য দুর্নীতি, সিন্ডিকেট বাণিজ্য এমনকি প্রশাসনে পুকুর চুরি থেকে সাগর চুরি প্রবাদের সংস্করণেও তাদের কলম চলেনি। ওই একটি বিষয় অর্থাৎ ধর্মীয় উসকানীমূলক লেখা ছাড়া। তাদের ভাষায় বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জঙ্গী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জঙ্গী, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠান মানেই দেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আফগানিস্তান হয়ে গেছে ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগে এসব নিয়ে রীতিমতো সোচ্চার ক্যাম্পেইন করেছেন কেউ কেউ। অথচ এরাই প্রগতিশীল দলের ছায়া তলে ছিলেন,আছেনও। যদিও আওয়ামীলীগের অনেকে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের দ্বি-মুখী আচরণ বিষয়ে কথাও বলেছেন শুনেছি। কিন্ত দমানো যায়নি।
বৃটেনে ডাটা প্রটেকশন আইনের স্বচ্ছ ও কার্যকর ব্যবহারের কারণে আইন বিষয়ে যারা কাজ করেন অথবা যাদের জানা- শোনা আছে কিন্তু এসব বলতে পারেন না প্রকাশ্যে। এসব দূরভিসন্ধি চেতনাধারীরা মূলত বিশেষ স্পর্শকাতর একটি ইস্যুকে সামনে নিয়ে অর্থাৎ বৃটেনে এসাইলাম আবেদন করে স্থায়ি হওয়ার চিন্তা নিয়ে করেছেন। এবং এভাবে তারা তাদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ সফলভাবে করেছেন। দেশকে উলঙ্গ করে, মিথ্যার বেসাতি করে তাদের অনেকে দ্রুত বৃটেনে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পাওয়ার বিয়ষটি – ইস্ট লন্ডনে নাকি অনেক পুরনো ও বহুল উচ্চারিত। মজার কথা হলো- এসবে এমন অনেকে সহায়তা করেছেন কিন্তু স্থায়ী হওয়ার পর তাদের সাথে ঐসব প্রগতিবাদিদের সুসম্পর্ক থাকেনি বিধায় তাদের মুখ থেকেই নাকি তলের বিড়াল বের হয়েছে সবচেয়ে বেশী!
এইসব অতি দেশ প্রেমিকরা মাতৃভূমিতে যাওয়া তাদের জন্য অনিরাপদ দেখিয়ে স্থায়ি হলেও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পাশ্ববর্তিতে দেশগুলোতে গিয়ে স্বদেশী মেয়ে বিয়ে ও হানিমুন করেছেন। অনেকে বেড়া ডিঙ্গিয়ে দেশে স্বজনদের সাথে থেকে এসে তা বন্ধুদের সাথে গর্ব করে শেয়ার করার গল্পও নাকি আছে অনেক।
তো এই দেশপ্রেম বিলি করে নিজের আখের গোছানোরাই বলতে গেলে সামাজিক যোগাযোগে কোটা বিরোধী আন্দোলন পূর্ব সময় পর্যন্ত সবর ছিল। কোটা আন্দোলন ইস্যুর এই দু:সময়ে বৃটেনের এইসব লেখক, মানবাধিকার কর্মীদের নিখোঁজের বিষয়টি দলের ত্যাগী নেতৃবৃন্দের কাছেও নাকি এখন স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে।
অপরদিকে, যুক্তরাজ্য বিএনপি-জামাতের ছায়া তলে থেকে এসাইলাম প্রার্থী হয়েও অনেকে প্লেকার্ড শ্লোগানে সক্রিয় থাকছেন সভা সেমিনারে। যারা প্রকৃতপক্ষে এইসব দলের অনুসারী নয়। দেশের দু:সময়ে, ব্যক্তি স্বার্থে দেশকে ছোট করার কাজটিও কোনভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। এটি বড় অপরাধ। নিজের জায়গা থেকে বলি- স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম হিসাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনার- আমার সরাসরি অংশগ্রহণ নেই। তাই বলে লাল-সবুজের পতাকাকে, ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে, জন্মভূমিকে খাটো করার অধিকারও আপনার- আমার নেই।
ইতিহাস বলে –যুগে যুগে দেশে দেশে দু:সাশন, নৈরাজ্য অমানবিকতা , পাশবিকতা এসেছে। সময়কে ধারণ করে অনেক শ্লোগানও সৃষ্টি হয়েছে। এবং এসব ম্লোগান সময়কে ধারণ করে কালজয়ী হয়েছে। কিন্তু একটি শ্লোগানও পাবেন না যা দেশপ্রেমহীন। ইউরোপের ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক‘ থেকে বাংলার ‘ জয় বাংলা‘ শ্লোগাণ রাজনৈতিক দলের বা কোন ব্যক্তিগত নেতার শ্লোগান হিসাবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত নয়।
‘তুই কে, আমি কে- রাজাকার রাজাকার’ বলার আগে একবার বুকে হাত দিয়ে ভেবে দেখুন- ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত কী আপনার শিরা- উপশিরায় বহমান নয়! দুই লাখ বীর নারীর ত্যাগ কী আপনার মনে বিধেনি।
আলো আছে বলেই অন্ধকারে কথা কই বার বার। বলতেও হবে বার বার। তাই বলে দেশ- মাকে বলাৎকারের মতো নির্মম অপমানের আচরণ করে নিশ্চয় নয়।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি- গাইলে যদি গায়ের লোমকুপ দাড়িয়ে যাওয়া অনুভূতি হয় আপনার, তাহলে –‘তুই কে, আমি কে , রাজাকার রাজাকার‘ শ্লোগান শুনলে মগজে কী অনুরণ হয়- জানতে মন চায়।
‘‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়
দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি জানা আছে জগৎময়’’- গানটির গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠ শিল্পী আব্দুল লতিফ আসলে তো আমার -আপনার বোধের কথাই বলেছেন।
ছয়।।
মানুষ তার মুলের দিকেই ধাবিত হয়- বহুল চর্চিত কথাটি সময়ের পেরেকে আটকে আছে- বাংলাদেশের করপোরেট সাংবাদিকতায়। বেশীরভাগ সময় আমরা আসলেই ‘দেখি না‘, ‘তাকিয়ে থাকি‘। জাতির বিবেক বলে পরিচিত বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিক আসলেই ‘তাকিয়ে আছেন, দেখছেন না‘।
এলিট সাংবাদিকদের সংগঠন এডিটসর গিল্ড এর ভূমিকার কথা বলতে নেই- কারণ এটাও তো সত্য যে বেশীভাগ সময় আমরা আসলে ‘বুলি আওড়াই, কথা হয়ে প্রকাশ পায় না’। অবাধ্য তথ্য প্রবাহের এই যুগে সামাজিক যোগাযোগ বন্ধের চিন্তাকে নাকি বলা হয় তথ্য-সম্প্রচার সন্ত্রাস। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা নিয়ে এডিটসর গিল্ড ও করপোরেট সাংবাদিকতার নজির নিরবতার কারণ কী হতে পারে সেটা নিয়ে ভাবনার কী সময় আছে দেশের মানবাধিকার সংগঠন ও জ্যেষ্ঠ সুশীলদের?
পৃথিবীতে নির্মম মৃত্যু , হিংস্রতা , বিভৎসতা, স্বৈরাচারী আচরণ করে কেউ সফল হতে পারেনি। ঠিকতেও পারেনি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এটা নির্যাতিতদের চেয়ে ভালো জানে নির্যাতনকারীরা।
আনোয়ারুল ইসলাম অভি, কবি, সাংবাদিক
লন্ডন, আঠাশ জুলাই, দুই হাজার চব্বিশ