রছেনডেল শহরে বাস করতেন এম এ মিয়া। তিনি ১৯৬৩ সনে এসেছিলেন ব্রিটেনে । বিশেষত নর্থ ওয়েষ্ট ইংল্যান্ড তাঁর ছিল এক চেনা এলাকা। রছেনডেল থেকে শুরু করে ওল্ডহ্যাম,হাইড, ম্যানচেষ্টার, রচডেলসহ নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডের বাংলাদেশী অধ্যূষিত শহরগুলোর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল আত্নিক। রছেনডেল শহরের একটা ছোট্ট বাংলাদেশী কমিউনিটিকে তিনি তিল তিল করে বাংলাদেশীদের জন্য গড়ে তোলেছিলেন একটা বাংলাদেশ বান্ধব শহর হিসেবে। বরফ ভেঙ্গে ভেঙ্গে আর কনকনে ঠান্ডা বাতাস ঠেলে এই শহরটাকে তিনি এবং তাঁর সেসময়ের সতীর্থরা নিজেদের আবাস বানিয়েছিলেন । সেখানে বাংলাদেশী এসোসিয়েশন আছে, আছে বাংলাদেশী মানুষের দ্বারা পরিচালিত মসজিদ। সবগুলোতেই আছে তাঁর কর্মস্পর্শ। এসোসিয়েশন এবং মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন দির্ঘদিন। যে ক’জন প্রবীন এখনও আছেন নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডে, একনাম লাল মিয়া নামে তাকে সবাই চিনে।
আমিও এখানে আবাস গড়ার পর সেই লাল মিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল । তাঁর সাথে বসলেই বরফ ভাঙ্গার কথা শোনতাম। একজন পেশাদার দোভাষী হিসেবে বাংলাদেশী মানুষদের তাঁর পেশার বাইরে গিয়ে কিভাবে সহযোগীতা করতেন, তা শুনে হাসতাম আমি। আইন-কানুনের মারপ্যাচে তাঁর স্বজনদের তিনি এদেশে স্থায়ী করেছেন। এগুলো ছিল তাঁর কথার কথা। কোন ঢাকঢোল পিটাতেন না। শুধু আমি তাঁর গল্পগুলো শোনতাম, সেজন্যই বাংলাদেশী মানুষের অস্থায়ী আর স্থায়ী আবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর কাজ করা গল্পকে হার মানানাে কাহিনীও শোনতাম লাল মিয়ার কাছ থেকে।
তাঁর তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে আছে ব্রিটেন বাংলাদেশী মানুষের ভিত্তি গড়ার ইতিহাস । এই মানুষটার সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা হত। তিনি সেসময়ের অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের সাক্ষি। তিনিই বলেছেন, নেতা ছিলেন না তিনি। কোন সভায় তিনি বক্তৃতা করেন নি। তবে নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছেন, সংগঠিত করেছেন, অকাতরে অর্থ দিয়েছেন, তাদের নাম বলতেন দ্বিধাহীনভাবে । তাঁর সেসময়ে উপার্জনও কম ছিল না। অসংখ্য বাংলাদেশীদের মাঝে মাষ্টার হিসেবে খ্যাত এই মানুষটাও চষে বেড়িয়েছেন ম্যানচেষ্টার থেকে বামিংহাম, বার্মিংহাম থেকে হাইড পার্ক, সেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে।
নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডে মাত্র কয়েকজন মানুষের নাম উল্লেখ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে । মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেসময়ের কিছু তরুণ মানুষের সাথে আলাপ-আলোচনায় উঠে এসেছে কারা কাজ করছেন, কারা অর্থ দিয়েছেন এই নর্থওয়েষ্টে। এবং দেখা গেছে সেসময়ে তাদের কেউ কেউ ঐ সংগঠকদের কারো কারো কাছ থেকে পাউন্ড সংগ্রহের চাঁদার রশিদই পান নি। এই লাল মিয়া কোন এক পরিচিতজনের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে ঐ চাঁদা সংগঠককে দিতে গিয়ে তিনি রশিদ চেয়েছিলেন , সেই সংগঠক চাঁদার রশিদ দিতেন না। অথচ এই নর্থওয়েষ্টে মাত্র গুটিকয়েক উল্লেখযোগ্য সংগঠকদের মাঝে তিনিও একজন, যিনি চাঁদার রশিদটা দেন নি অথচ নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের কথা উঠলে যার নাম বার বার আসে। লাল মিয়া বলেছিলেন, এসব মানুষদের প্রতি তিনি শ্রদ্ধা হারিয়েছেন, তবুও সেই সংগঠকের পরীশ্রমের কথা দ্বিধাহীনভাবে উচ্চারণ করেছেন তিনি।
লাল মিয়াকে আমি নির্ভর করতাম । নিজেকে পাবলিকলি তোলে ধরার স্পৃহা ছিল তাঁর খুবই কম। সেজন্যই তাঁর কথায় ইতিহাস আশ্রিত সত্যটুকু থাকত। কারন তিনি নিজের চেয়ে অন্যের কথাই বলতেন বেশী। সেই লাল মিয়ার কাছ থেকে শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও কিছু তথ্য জানতে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাতের সময় নির্ধারন হয় পাঁচ মাস আগে জুলাই মাসের এক রবিবার । মটর ওয়েতে গাড়ী চালানোর মত চোখের দৃষ্ঠি নেই তাঁর, বয়সের ভারে ন্যূজ্য তিনি, তবুও তিনি রাজী হন । তাঁর মেয়ে স্কুল শিক্ষক, সেই দিন মেয়ের ছুটি, তাই মেয়েই নিয়ে আসবে তাঁকে ম্যানচেষ্টার। হঠাৎ খবর পাই, তিনি অসুস্থ। পরদিন হাসপাতাল থেকে আমাকে ফোন করে বলেন, ভাই আমি অসুস্থ, দোয়া করবেন এবং আপনার বন্ধুদের দোয়া করতে বলবেন । দু’তিনদিন পর তাঁর মৃত্যুসংবাদ পাই । পচাশি বছর বয়সে তিনি মারা যান।
অনেক অনুচ্চারিত কথাগুলো আমার জানা হল না। তিনি আমাকে দুএকজন ব্যবসায়ীর নাম বলেছিলেন, যারা প্রতিনিয়ত থাকতেন সভায়। যারা অর্থ প্রদান করতেন সময়ে সময়ে । অনেক তরুন কর্মীদের কথা বলেছিলেন, যাদের জন্য নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চাঁদা সংগ্রহে কিংবা ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরের মিছিল-সমাবেশে উপস্থিত হতে এদের উদ্যোগই ছিল সবসময় । সেসময়ে কাজ করা এখনও যে দু-তিনজন নিভৃতচারী মানুষ আছেন, যারা লাল মিয়ার উচ্চারিত মানুষগুলোর কথা অকপটে স্বীকার করেন। তাঁর মাঝে একজন আব্দুল জব্বার, হাইড শহরে বাস করেন, যিনি এখন বয়সের ভারে নূজ্য। লাল মিয়ার পাশাপাশি তিনিও আমাকে বলেছেন, যাদের গাড়ি-জ্বালানী-অর্থ ব্যবহার হত প্রতিদিন, তাঁদের নামটাও ঐ সংগঠকরাই হারিয়ে দিয়েছেন ।আমি এই মানুষগুলোর নাম উচ্চারন করছি না, কারন লাল মিয়ার উপস্থিতিতেই এই নামগুলোর সাথে আরও নাম সংযোগ করে এগুলো লিপিবদ্ধ করার কথা ছিল। মাত্র তিন-চারটি নাম সংযুক্ত করে তাঁর কথার অসমাপ্ত তথ্য দিয়ে তাঁকে সমালোচিত করতে চাইছি না আমি। কিন্তু যেভাবেই হোক কালের গর্ভে এই মানুষগুলোর নাম হারিয়ে দেয়া হয়েছে। তা নিয়ে ভিন্ন আলোচনা করা যাবে ।
ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ইতিহাসের সাথে প্রথমেই যার নাম আসে, তিনি হলেন আবু সা্ঈদ চৌধুরী। জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দেয়া তৎকালিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবু সাঈদ চৌধুরীর লন্ডন পাড়ি দেয়ার মধ্যি দিয়ে এখানে সংঘঠিত হতে থাকে একশন কমিটি ফর দা পিপল্স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউকে,ব্রিটেনের শহরে শহরে। মুক্তিবাহিনীকে সহায়তার প্রয়োজনে জমা হতে থাকে হাজারো-লাখো পাউন্ড। সাধারন মানুষও যার যার অবস্থান থেকে নিয়েছে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। ঐতিহাসিক হাইড পার্কে হয়েছে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, আওয়ামী লীগ, বামপন্থি দল, বাংলাদেশী পেশাজীবী, নারীদের নিজস্ব ব্যানারে সভা-সমাবেশ প্রভৃতি তাক্ লাগানো সব কর্মসূচী চলে এই ব্রিটেনে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরীতে যার যার অবস্থান থেকে করেছে ব্রিটিশ এমপি-মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক। এমনকি আন্তর্জাতিক সমর্থন আর দৃষ্টি আকর্ষনে কার্ডিফ শহরের ৫ জন বাঙালীর সাহসী আর সময়োপযোগী উদ্যোগ রিতিমত সাড়া জাগিয়েছে তখন। একাত্তুরের ১৩ মে ঐ পাচজন সাহসী বাঙালী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে আলোচনার জন্য তারা অনশন শুরু করে। এবং ১৪ মে আলোচনা অনুষ্ঠিতও হয়। ২০ জন সাংসদ বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫ মে ব্রিটিশ মিডিয়ায় এর গুরুত্ব বাড়ে। সারা পৃথিবীতে প্রতিফলিত হয় বাংলাদেশ। তারপর একে একে চলতে থাকে প্রবাসীদের অপেক্ষা।
সে সময় পাকিস্থান হাইকমিশনে বিক্ষোভ করতে গিয়ে আহত হয়েছে মানুষ। গ্রেফতারও বরন করতে হয়েছে এগারো জনকে। গ্রেফতারকৃতদের মাঝে একজন ইব্রাহিম আলীকে ছয়সপ্তাহের জন্য কারাগারেও যেতে হয়। ক্রমেই জন্ম নিতে থাকে পাকিস্থানীদের প্রতি ঘৃনা। অবিশ্বাস আর ঘৃনার মধ্যি দিয়ে পাকিস্থানী আর বাঙালীদের মাঝে বাড়তে থাকে বিদ্বেষ। দাঙ্গা-কলহ হয়ে উঠে এক নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর এরই নির্মম শিকার হন আব্দুন নুর নামের একজন। বৃহত্তর সিলেটের ঐ আব্দুন নুরই সম্ভবত প্রথম কোন মানুষ, যিনি স্বাধীনতার নাম নিয়ে নিহত হন কোন এক পাকিস্থানীর হাতে প্রবাসে। এই হত্যাকে সাধারন হত্যা বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও এটা কি আসলেও তাই। কারণ এটা ছিলো পাকিস্থানী আর বাঙালী দ্বন্ধ এবং জাতিগত এই দ্বন্ধেরই নির্মম পরিনতিতে স্বাধীনতার বলি হলেন আব্দুন নুর। আর এ অর্থে তিনি প্রবাসে একাত্তুরের শহীদ।
অথচ এই জানা মানুষগুলোর বিসর্জন ত্যাগ-সংগ্রাম একসময় ঐ কয়েকজন চেনা মানুষ নিজেদের উদ্যেগেই হারিয়ে দেন। সেজন্যই দেখেছি এবং দেখছি এখন মুক্তিযুদ্ধের নতুন নতুন সংগটকদের এই ব্রিটেনে। আমি এরকম দুজনকে জানতাম, যারা ইতিমধ্যে প্রয়াত, তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দাবি করতেন, এমনকি প্রবাসে থাকার পরও তাদের নামের শেষে মুক্তিযোদ্ধা সম্বোধন করে সভায়-সমাবেশে পরিচয় করিয়ে দেয়া হত। পরিচিতদের বলতাম, এভাবেতো ইতিহাসকে হারিয়ে দেয়া হবে । তারা বলতেন, বয়স হয়েছে, এদেরকে লজ্জা না দেয়াই ভাল।
গত ক’মাস আগে ব্রিটেনের কিছু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নাম বেরুলো বাংলাদেশে । অথচ এদের এক-দুজন ছাড়া কে কিভাবে সংগঠিত করেছিলেন, তাদের কাজ কি ছিল, কেউ কিছু বলতে পারে নি। অবশ্য সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সেই ১২ জনের নাম স্থগিত করলো আর নতুন করে কোন নাম আসে নি এখনও।
এখনও সময় আছে, আব্দুল জব্বারের মত কিছু মানুষ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে আছেন । তাদের কাছ থেকেই জেনে নিতে হবে, সেই মানুষগুলোর নাম। বাংলাদেশী রাজনীতি করা নেতা-কর্মীদের ছায়ায় একটা গোলটেবিল বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নাম সংগ্রহ করে বই ছাপিয়ে দিলে বিলেতের মানুষের কাছে যেমন, তেমনি আগামী প্রজন্মের কাছেও ভুল তথ্য যাবে, সরকারের কাছে ঐ ১২ জনের মতই আরও কয়েকজনের নাম যাবে । সত্যিকার মানুষগুলোর নাম উঠে আসবে না। আর এর অর্থ দাঁড়াবে বিভ্রান্তির অতলেই হারাতে থাকবে আসল সংগঠকদের নাম।