
ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে “টি ২০ বিশ্বকাপ” অভিযান সমাপ্ত করেছে কান্ডারী মাহমুদুল্লাহর বাংলাদেশ দল। সুপার ১২ এর , গ্রুপ ১ এ, নিজেদের শেষ খেলায় অস্ট্রেলিয়ার বোলিং তোপের মুখে মাত্র ৭৩ রান করে পরাজয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলো জীর্ণ , শীর্ণ আর ক্লান্ত টাইগাররা। বিশেষ করে এ্যাডাম জাম্পার ঘূর্ণি বলের বিপরীতে কুপোকাত হয়েছেন বাংলাদেশের পাঁচজন খেলোয়াড়। আর এ অর্জনে জাম্পাকে খরচ করতে হয়েছে মাত্র ১৯ রান। নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের আরেকটি পরাজয়। আনুষ্ঠানিকতার খাতিরেই খেলতে নেমে প্রয়োজনীয় রান সংগ্রহ করার লক্ষ্যে শুধু ৬ ওভার ২ বল মোকাবেলা করতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে। দলপতি এ্যারোন ফিঞ্চের ২০ বলে বিধ্বংসী ৪০ রানের ইনিংস অস্ট্রেলিয়াকে পৌঁছে দেয় জয়ের বন্দরে। হতাশা আর লজ্জা নিয়ে মাঠ ত্যাগ করতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে।
অবশ্য টুর্নামেন্টের প্রারম্ভেই হোঁচট খেতে হয়েছে বাংলাদেশকে। স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে অশুভ যাত্রার সূচনা। ভাগ্যিস প্রথম রাউন্ডে গ্রুপ বি এর ম্যাচে ওমান এবং পাপুয়া নিউ গিনিকে হারিয়ে সম্ভ্রম রক্ষা করতে পেরেছে। তা না হলে সুপার ১২ এ যাওয়াটাও ভাগ্যে জুটতো না। তাও আবার ঐ দুই ম্যাচে সাকিব ব্যাটে – বলে ঝলসে উঠেছিলেন বলে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই রাজপুত্রের উপর প্রতিটি ম্যাচে কি সাফল্যের মুখ দেখার জন্য ভরসা করা ঠিক? সে আশা করাটাও অযৌক্তিক। কারন সাকিবের পাশাপাশি বাকি দশজন খেলোয়াড়কেও নিজেদের দায়িত্বটা বুঝে নেয়া উচিত ছিল। ব্যাটিং, বোলিং , ফিল্ডিং – সব সেকশানেই নিজেদের অযোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন লাল – সবুজের খেলোয়াড়রা। বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের ভালোবাসার জমিনে বীজ বপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। দর্শকদের হতাশার নদীতে ভাসিয়ে বিশ্বকাপ কাটালো বাংলাদেশ দল।
সুপার ১২ এর প্রতিযোগিতার প্রতিটি খেলায় পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ইংল্যান্ড, শ্রীলংকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ কারো সামনে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। সে সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে নতজানু পরাজয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্ভাবনাকে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে ৮৪ রানে গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশের ইনিংস। তবে শ্রীলংকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর বিরুদ্ধে খানিকটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা থাকলেও বিশেষ করে বোলিং ও ফিল্ডিং এর করুন পারফরম্যান্স পরাজয় ঠেকাতে পারেনি। টি – টোয়েন্টিতে চার, ছক্কা যেখানে মুড়িমুড়কির রূপ নেয়, রানের ফোয়ারা নথিবদ্ধ রাখতে স্কোরারদের নাভিশ্বাস উঠে যায়, সেখানে এ বিশ্বকাপে “রান” জিনিসটা একেবারে হীরা – জহরতের মতোই দামী ছিলো বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের কাছে। সহজ বস্তূ হিসেবে ধরা দেয়নি।
অথচ বিশ্বকাপ শুরুর আগে স্বদেশের মাটিতে নিউজিলান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জিতে আশার দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন টাইগাররা। তাদের সাফল্য দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন, এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কিছু একটা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে! নিজেদের মাটিতে জয়ের মুখ দেখার জন্য সুবিধামতো স্পিন পিচ তৈরি করে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন না দেখে, তার সঙ্গে বাউন্সি পিচের সংমিশ্রনে একটা ব্যালান্স উইকেট সৃষ্টি করা গেলে আজ হয়তো শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হতো না বাংলাদেশকে। সে কথাই বার বার খেলা চলাকালীন ধারা ভাষ্যকাররা মনে করে দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের কর্তা ব্যক্তিদের। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয়ের পর, এ্যাডাম জাম্পাও রহস্য করে একই বাণী উচ্চারণ করেছেন। তাইতো সিরিজ পরাজয়ের চরম প্রতিশোধ নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি অস্ট্রেলিয়া। সিরিজ পরাজয়ের দু:স্মৃতি ভুলতে পারেনি বলেই প্রতিশোধটা হয়তো এতো নির্মম!
এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের খতিয়ান পাখির চোখে দেখলে দেখবো যে, প্রথম সারির ব্যাটসম্যান ও বোলাররা সবাই নিজেদের যোগ্যতার পাখা মেলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রথম রাউন্ড ও সুপার ১২ মিলে সর্বমোট আট ম্যাচের মধ্যে সাত ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ রান করেছেন ওপেনার নাঈম শেখ। তাঁর সংগ্রহ ১৭৪ রান। দ্বিতীয়স্থানে অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ।করেছেন ১৬৯ রান। তৃতীয়স্থানে আছেন মুশফিকুর রাহিম (১৪৪ রান) এবং সাকিব আল হাসান এর ব্যাট থেকে এসেছে ১৩১রান। আট ইনিংস খেলে আফিফ করেছেন সর্বসাকুল্যে মাত্র ৫৪ রান।ওপেনার লিটন দাস পুরো টুর্নামেন্টে ছিলেন নিস্তেজ।জাদুকরী কোনো ব্যাটিং শৈলী দেখিনি এই ব্যাটসম্যানের ব্যাট থেকে। সৌম্য সরকারও ছিলেন পুরোপুরি ফ্লপ। অন্যদিকে প্রথম রাউন্ড ও সুপার ১২ মিলিয়ে বোলিং এ এগিয়ে আছেন বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান। নিয়েছেন মোট ১১টি উইকেট। মেহেদী ও মোস্তাফিজ নিয়েছেন আটটি করে উইকেট। আর তাসকিনের ঝুলিতে পড়েছে ছয়টি উইকেট। রাজস্থান রয়্যালস এর হয়ে আইপিএলএ আলো ছড়িয়ে বিশ্বকাপে খেলতে এসে সম্পূর্ণ নিষ্প্রভ ছিলেন মোস্তাফিজ। বোলিং নেতৃত্ব সামলাতে পারেননি। দুহাতে রান বিলিয়েছেন। নাসুম, শরিফুলরাও সুবিধা করতে পারেননি।
এদিকে চলমান বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবি ও বাজে পারফরম্যান্সের জন্য ক্রিকেটবোদ্ধারা খেলোয়াড়দের পাশাপাশি বিসিবির নেতৃত্বের ব্যর্থতাকেও সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।বিসিবির বর্তমান সভাপতির অধীনে বাংলাদেশ চার – চারটা বিশ্বকাপ খেলেও কোনো সাফল্যের মুখ এখন পর্যন্ত দেখেনি। দীর্ঘ সময় ধরে সভাপতির পদে থাকা নাজমুল হাসান পাপনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ শোনা যায়। টীম সিলেকশান, সিলেক্টর সিলেকশান, ডিরেক্টর নির্বাচন, টস জিতলে দল প্রথমে ব্যাট না বল করবে, এসব কিছুই নাকি সভাপতি স্বয়ং সিদ্বান্ত নিয়ে থাকেন। অর্থাৎ এসব ব্যাপারে কোচ, দলপতি কিংবা বোর্ডের অন্যান্য কর্মকর্তার মতামতের কোনো তোয়াক্কা বর্তমান সভাপতি করেন না।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতি ঘটাতে হলে অনেকের ধারণা বিসিবিকে ঢেলে সাজাতে হবে, দেশের মাটিতে জয় পাওয়ার আশায় নিজের মতো করে উইনিং পিচ না করে ব্যালান্স উইকেট তৈরি করতে হবে যাতে পেসার, স্পিনার, ব্যাটসম্যান সবাই স্ব – স্ব যোগ্যতা প্রমান করে দেশের বাইরে খেলতে যেতে পারেন।বিদেশী কোচ বাদ দিয়ে দেশের অভিজ্ঞ কোচদের কাজে লাগানো যেতে পারে।বিসিবির কর্মকর্তা, কোচ আর খেলোয়াড়দের মাঝে সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা করতে হবে। এবারের বিশ্বকাপ চলাকালীন মাঠে খেলোয়াড়দের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। “অনুর্ধ ১৯ বিশ্বকাপ জয়ী”স্কোয়াডের খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দেয়ার এখনই সময়।টীম স্পিরিটকে ইতিবাচক করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।কোচ ও দলপতিকে তাঁদের নিজস্ব মতামত রাখার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।বর্তমানে দলের প্রথম সারির সিনিয়র খেলোয়াড় – সাকিব, মুশফিক, তামিম, মাহমুদুল্লাহর ভবিষ্যৎ রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। স্পিন নির্ভর না হয়ে অচিরেই দেশব্যাপী “ফাস্ট বোলার অনুসন্ধান” অভিযান চালাতে হবে। জবাবদিহিতার জায়গায় বিসিবির কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়দের দাঁড় করাতে হবে। প্রয়োজনে সরকারী হস্তক্ষেপ আশা করা যেতেই পারে। শারীরিক ফিটনেসের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের মানসিক ফিটনেসেরউ পর গুরুত্ব দিতে হবে। খেলোয়াড়দের বিশ্রামের বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে চলতি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার সত্যিকার পোস্ট মর্টেম করা জরুরী।
মনে রাখা দরকার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বড়ো কঠিন ঠাঁই।সাফল্য ও ব্যর্থতা এখানে একে অপরের যমজভাই। তাই দলপতিকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি না দিয়ে অথবা কোনো কোনো খেলোয়াড়কে টি ২০ স্কোয়াড থেকে ছুঁড়ে না ফেলে বিসিবির উচিত আলোচনার মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা। কেবলমাত্র খেলোয়াড়দের উপর দায় চাপিয়ে বিসিবি নিজেদের দায়কে আড়াল করতে পারে না।তা মোটেও ঠিক হবে না। সত্যকে আলিঙ্গন করে ব্যাট আর বলের অপূর্ব মিতালীতে খেলোয়াড়রা আবারো যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, সে সুযোগ করে দিতে হবে বিসিবিকেই। অন্যদিকে খোদা প্রদত্ত প্রতিভা, ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিস্ক, প্রবল আত্মবিশ্বাস আর ইস্পাত কঠিন মন নিয়ে খেলোয়াড়দের প্রস্তুত হতে হবে দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে আসন্ন সিরিজে সর্বোচ্চ মেধা দিয়ে, পজিটিভ ক্রিকেট খেলে জাতিকে বিজয় উপহার দেয়া।বিশ্বকাপে ব্যর্থতার দুঃস্বপ্ন যেনো আগামীর জয়রথকে থামিয়ে না দেয়।উল্লেখ্য আগামী বছর অক্টোবর – নভেম্বরে আবারো “টি ২০ বিশ্বকাপের”আসর বসবে অস্ট্রেলিয়ায়। প্রবীণ – নবীনের সংমিশ্রনে জাতীয় দলকে মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাবার এখনই উপযুক্ত সময়। সুপ্রিয় পাঠক,আপনারা কি ভাবছেন?
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অবসান আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা আদৌ কি সম্ভব? সৈয়দ আফসার উদ্দিন