আহতদের ঠেলা গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
নিহদের মধ্যে ১২ জন আমেরিকান সেনা
জলাভূমিতে মরদেহের স্তুপ
ইসলামিক স্টেট -আইএসের দায় স্বীকার
বিশ্বনেতাদের নিন্দা
দিন পার না হতে আশঙ্কাই সত্যি হলো। তালেবান দখলে থাকা আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে এবার ভয়ংকর জোড়া বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেই সঙ্গে বিমানবন্দর চত্বরে এলোপাথাড়ি গুলিবৃষ্টি ঘিরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক ও তুমুল উত্তেজনা।
একটি সংবাদসংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাবুলের জোড়া বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ জনে। তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, কমপক্ষে ৬০ জনের মতো মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া কমপক্ষে আরও ১৪০ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১২ জন আমেরিকান সেনা ও বেশ কয়েকজন তালেবান সেনাও রয়েছে। িএ ঘটনায় বিশ্ব নেতারা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। খবর বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স ও গার্ডিয়ানের।
এরই মধ্যে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট- আইএস এ হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো আগে থেকেই ওই বিমানবন্দরে হামলার আশঙ্কা করে আসছিল। ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলা চালাতে পারে বলে জানানো হয়েছিল।
ইসরায়েরের নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নাফতালি ব্যানেটের সঙ্গে প্রথম বৈঠক ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দুজনের প্রথম ভার্চুয়াল বৈঠকের আগ মুহূর্তে এ হামলার ঘটনা ঘটলো। এ বৈঠক মুহূর্তেই বাতিল করতে বাধ্য হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এ ঘটনার পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তালেবানের সঙ্গে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির পর আফগানিস্তানে এই প্রথম মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটল।
প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টায় বিমানবন্দরের কাছে ব্যারন হোটেলের ধারেপাশে। এই হোটেলে যুক্তরাজ্যে যারা যেতে চাইছিলেন তাদের নথিপত্র ব্রিটিশ কর্মকর্তারা যাচাই বাছাই করছিলেন। প্রথম বিস্ফোরণের পর বন্দুকের গুলি হয় এবং এরপরই দ্বিতীয় বিস্ফোরণ হয় বিমানবন্দরের ঢোকার প্রধান একটি গেট – অ্যাবে গেটের কাছে।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বিস্ফোরণ দুটি আত্মঘাতী হামলা হতে পারে। তালেবান দখলে চলে যাওয়ার পর প্রাণ হারানোর আশংকায় অনেক নাগরিক দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে কাবুল বিমানবন্দর এলাকার ভেতরে-বাহিরে ভিড় করছে। বিমানবন্দরে অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র নেটো জোটের সেনা ও তাদের স্থানীয় সহযোগী ও সমর্থকরা। এ পরিস্থিতির মধ্যে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলো।
বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) রাত পৌনে ৮টার দিকে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগন। সন্ত্রাসী হামলার সতর্কতা জারির পর বন্ধ হয়ে যাওয়া বিমানবন্দরের অ্যাবি গেইটে এই বিস্ফোরণ ঘটে। এ প্রবেশ পথে ব্রিটিশ সৈন্যরা জড়ো হয়েছিল এবং সেখানে নিরাপত্তা দেখভাল করছিল।
পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বিমাবন্দরে আত্মঘাতী হামলার আশঙ্কা রয়েছে জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিক ও আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছেন।
হামলার পর বিমানবন্দরের আশপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা জানিয়েছে, কাবুল থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কাবুল পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠকের পর বলেছেন, তাঁরাও বিমানবন্দর থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া অব্যাহত রাখবেন।
কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে হতাহত হয়েছেন অনেকে। ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এক আহতকে। ছবি: সংগৃহীত
কাবুল বিমানবন্দরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ‘ভয়াবহ’ হামলা হতে পারে বলে যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী জেমস হ্যাপির আশঙ্কা প্রকাশের পরই এ হামলার খবর সামনে এলো। এদিকে আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মঘাতী বিস্ফোরণের পর বিমানবন্দরে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা। বিমানবন্দর চত্বরে আমেরিকার সেনাদের ঘিরে থাকা যে এলাকায় আফগানিস্তান ছাড়তে চেয়ে ভিড় জমিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ, সেখানেই এই বিষ্ফোরণ ঘটানো হয়।
কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে ‘আত্মঘাতী’ হামলার সময় সেখানে বিদেশি নাগরিকসহ অন্তত চারশ থেকে পাঁচশ জন মানুষ ছিল বলে দাবি করেছেন ঘটনাস্থলে থাকা একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
সেখানে ‘শক্তিশালী’ বিস্ফোরণই হয়েছে বলে একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন তিনি। ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আমরা আহতদের স্ট্রেচারে সরিয়ে নিয়েছি। আমার কাপড় রক্তে একদম ভিজে গেছে।
কাবুলের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে তালেবানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো না হলেও আফগান সাংবাদিকদের শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা গেছে, কাবুল বিমানবন্দরের কাছে মানুষের এক জটলায় ১২ জনের মৃতদেহ পড়ে আছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের পাশে একটি জলাভূমিতে মরদেহের স্তুপ পড়ে আছে। সেখান থেকে কজনের মৃতদেহ বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে। স্বজনের মৃতদেহের সন্ধানে কাবুল বিমানবন্দরে জড়ো হওয়া মানুষের গগনবিদারী আহাজারিতে সেখানে এক মর্মন্তুদ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ভয়াবহ সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আফগান পুরকৌশলী জুবায়ের রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি আমার এক কাজিনের সঙ্গে বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমেরিকাগামী বিমানে উঠব… ঠিক এমন সময় আমার ঠিক ৫০ মিটার সামনে এক ব্যক্তিকে দেখলাম দৌঁড়ে যেতে। তারপর তিনি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটান। এরপর চারিদিকে শুধু লাশ। এখানে ওখানে পড়ে আছে মানুষের মৃতদেহ। কোথাও নারী, কোথাও পুরুষ আবার কোথাও শিশুর ছিন্নভিন্ন দেহ। কয়েকটা প্রাইভেটকারে করে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই নারকীয় দৃশ্য সহজে ভোলার নয়।’
তালেবানের অন্যতম মুখপাত্র সুহেইল শাহীন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই দোষীকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’
আফগানিস্তানের সংবাদ মাধ্যম টোলো নিউজ টুইটারে বিস্ফোরণের স্থান থেকে আহতদের ঠেলাগাড়িতে সরিয়ে নেওয়ার বেশ কয়েকটি ছবি পোস্ট করেছেন। সেখানে দেখা যায়, রক্তমাখা কাপড়ে আহত কয়েকজনকে ঠেলাগাড়িতে করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নারী ও শিশুসহ বহু মানুষকে নিজেদের মাথায় কাপড়ের ব্যান্ডেজ বেঁধে পালাতে দেখা গেছে।
এদিকে, কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে ‘আত্মঘাতী’ হামলার স্থানে ‘লাশের স্তূপ’ দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক সেকান্দার কেরমানি। তিনি বলেন, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে লাশের স্তূপ দেখা গেছে। তাই ওই বিস্ফোরণে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
এর আগে একই দিনে কাবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের সেখানে ভ্রমণ না করার জন্য সতর্ক করা হয়। যারা এর মধ্যে বিমানবন্দরের বাইরে রয়েছেন তাদের অবিলম্বে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার একটি চলমান এবং অত্যন্ত উচ্চ হুমকি রয়েছে বলে জানান অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী মারিস পেইন।
তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর গত ১১ দিনে ৮৮ হাজারেরও বেশি মানুষকে দেশটি থেকে বিমানে করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখনও হাজার হাজার আফগান দেশ ছাড়ার জন্য বিমানবন্দরের বাইরে ও ভেতরে অপেক্ষা করছে। আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে প্রত্যাহার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দ্রুত কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলো।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন জানান, ৩১ আগস্টের নির্ধারিত সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়টি তালেবান নাকচ করে দিলেও এই সময়ের পর দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিক ও আফগানদের দেশত্যাগে বাধা দিবে না তারা।
আগের দিন বুধবার এক নিরাপত্তা বিষয়ক সতর্কবার্তায় জানানো হয়, আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অ্যাবেই গেট, পূর্ব গেট এবং উত্তর গেটে অপেক্ষারত মানুষকে অবিলম্বে সরে যেতে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।
এর আগে একই ধরনের পৃথক একটি নির্দেশনায় যুক্তরাজ্য সরকারও সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে পরামর্শ দেয়। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায় , আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ এবং যেকোনো সময় সেখানে সন্ত্রাসী হামলার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কি ধরনের নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা করা হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য।