আমাদের পরমপ্রিয়, শ্রদ্ধাভাজন, ‘অংকরস্যার’ খ্যাত জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক শ্রী শ্যামাকান্ত দাস আর নেই। জীবন-মৃত্যুর ধ্রুব সত্যে মৃত্যুই স্বাভাবিক। বেঁচে থাকা অস্বাভাবিক। সবার মতো স্যারের জীবন অবসানও এই স্বাভাবিকতার মধ্যে পড়ে। তবে স্যারের মতো মানুষের চলে যাওয়া আসলে দেহগত। সমাজে আলো ছড়ানো তার কর্ম এবং কর্মসৃজন চিন্তা-চেতনার স্ফোরণ তাকে সংখ্যাঘরিষ্টদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে সন্দেহ নেই।
আমার বিশ্বাস, আমার চেয়ে অনেক বেশী অগণিত ছাত্রের বুক হাহাকার করছে- তাদের প্রিয় স্যারের জন্য। স্যারের নিবেদিত পাঠদান, শিক্ষাদানের অনন্য কৌশল, স্যারের আদর্শিক ব্যবহার ইত্যাদি আমাদের চোখে ভাসছে বার বার।
এবং যে, যেখানেই থাকিনা কেন, যে কোন সময় স্মৃতি রোমন্থনে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যারা শ্যামাকান্ত স্যারে শিক্ষকতা সময়ে শিক্ষার্থী ছিলেন, তাদের মনে স্থান করে নেয়া শিক্ষকদের মধ্যে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন এবং থাকবেন- এবিশ্বাস রাখি।
স্যারের পাঠদানের কৌশল ছিল অনন্য । খুব শান্তভাবে,ভয়ভীতি হীন অভিব্যক্তি নিয়ে প্রমিত ভাষায় স্যার বিষয়ের গভীরে গিয়ে সংক্ষেপে পাঠদান করতেন। স্যার বিজ্ঞান ক্লাস নিতেন আমাদের ব্যাচ এর। অথচ অংকের অগাদ দখলের জন্য ‘অংকরস্যার‘ খ্যাত শ্যামাকান্ত দাস স্যারের কাছ থেকে নাইন-টেন ক্লাসে অংক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে আমাদেরকে।( প্রাসঙ্গিক হলেও শিক্ষাগুরুদের প্রতি নিখাদ সম্মানের জন্য এবিষয়ে সচেতনভাবেই মন্তব্য করতে চাচ্ছিনা…। সকল শিক্ষাগুরুদের প্রতি বরং শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি)।
স্যার বেশীরভাগ সময় সাইকেল চড়ে স্কুলে আসতেন। আবার বর্ষা সময়ে স্যারকে সোনাই নদীর ওপার থেকে অনেকটা পথ হেটে স্কুলে আসতে হতো। ডানে-বামে অহেতুক না চেয়ে তিনি কালো রঙের সিরাজ ছাতা হাতে নিয়ে হাটার মধ্যে ছিল সাদামনের ব্যক্তিত্বের স্পস্ট ছাপ।
ব্যক্তিজীবনে স্যার ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিদে জীবনের অনুকরণীয় মানুষ। তার জ্ঞানের প্রখরতা অনুভব করেছি মূলত স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে। স্যারের সাথে যেখানেই দেখা হয়েছে, মনে হয়েছে, স্যার আমাকে দেখে, আগ থেকে কুশলবিনিময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন! এবং পরবর্তিতে লেখালেখি ও সৃজনশীলকাজে জড়িত হওয়ার সুবাদে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতম হয়েছে। লন্ডনবাসী হওয়ার পরও এই বন্ধন অটুট ছিল। এই হার্দিকবন্ধনে আমি বারবার স্যারের শিক্ষায় আন্দোলিত হয়ে, ঋণী হয়ে, পরম তৃপ্তি নিয়ে বেঁচে আছি।
মনে আছে, একদিন আমাদের ধর্মীয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মাহমুদুর রহমান স্যার স্কুলে আসেননি। শ্যামাকান্ত স্যার ইসলাম শিক্ষার ক্লাস নিয়েছিলেন। মহানবীর জীবন ও আদর্শ নিয়ে তার বিশ্লেষণ সেই বয়সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে রেখেছিল। ‘আদর্শ’ এবং ‘অনুকরণীয়’ বিষয়টি তিনি চমৎকারভাবে বুঝিয়ে ছিলেন। এই শিক্ষার প্রতিফলন ব্যক্তিজীবনে আগলে রাখতে না পারলেও এটা সময় সময় কানে ও বোধে ভাসে এবং ভাবায়ও।
স্যার ছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছে একজন আদর্শ শিক্ষক। সেসময়ে, আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ এমন ছিল যে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বিচারের সহজ সুযোগ বা উপলক্ষ ছিল না। কিন্তু কে আসলেই ‘আর্দশ শিক্ষক’, সবার ‘প্রিয় শিক্ষক‘ তা বুঝার সুযোগ ছিল। ফলত: ‘অংকর স্যার’, ‘বিজ্ঞানের স্যার’, ‘ইংরেজীর স্যার’ এইসব সম্বোধনেই প্রকাশ পেয়েছে আমাদের আত্নিক শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি।
স্যার পারিবারিকভাবে উচ্চবিত্তের ছিলেন না। এটা যেমন বুঝা যেত। তেমনি তার সাদাসিধে জীবনে- মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে স্পস্ট ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল।
স্যার ছাত্রদের ক্লাসেই মনোযোগ দিয়েছেন মানুষ গড়ার কাজে। ক্লাসে পাঠদানের শেষ ঘন্টা বাজার পরেও নিবিষ্ট মনে পড়িয়েছেন, ঘড়ির কাটা মেপে পড়াননি। স্যার সব সময় পেছনে থেকেও অনুপ্রেরণায় ছাত্রদের জন্য উচ্চকণ্ঠ থেকেছেন।
বর্তমান বাস্তবতায় তাই শ্যামাকান্ত স্যার বা তার মতো শিক্ষকরাই প্রকৃত শিক্ষক। এবং এর উল্টো চিত্রও আছে; একজন শিক্ষকের নৈতিক স্খলন কতটুকু নিচে নামলে তার নিজের স্কুলের ছাত্রদের স্কুলে পাঠদানের আগে ও পরে একই বিষয়ে বাণিজ্যিক চিন্তায় প্রাইভেট পড়ায়? বলা যা পড়তে বাধ্য করে! তাও আবার গণহারে।
শিক্ষার নামে ‘মানুষপণ্য’ বানাতে সবচেয়ে বেশী দায়ী প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কতিপয় অর্থলোভী শিক্ষক। যে কোন পরীক্ষার আগে গণহারে কোচিং, পরীক্ষার ফি’র সাথে কৌশলে কোচিং এর অর্থ যুক্ত করে অতিরিক্ত ফি আদায় এর অভিযোগ প্রতি বছরই উঠছে। এবং সংবাদপত্রে সুনিদৃষ্টভাবে এইসব অর্থলোভি শিক্ষকরা অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের কাছে।
একজন সংবাদকর্মী হিসাবে আমার নিজ উপজেলায় এমনও অভিযোগ জমা আছে যে- স্যারের কাছে প্রাইভেট না পড়ার কারণে এসএসসি টেস্ট পরীক্ষায় তাকে সুকৌশলে অকৃতকার্য রেখেছেন শিক্ষক। এবং এই শিক্ষকের পক্ষে পেছনে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান সহ যারা প্রাইভেট কোচিং করেন বাণিজ্যিকভাবে। এমনও তথ্যভিত্তিক অভিযোগ আছে, প্রাইভেট পড়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা আদায়ের প্রতিবাদ করায় ঐ শিক্ষক দাম্ভিকতা নিয়ে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উচ্চকণ্ঠে বলেছেন, যে বা যারা এসব করছো,পরীক্ষার খাতায় দেখা হবে।এবং হয়েছেও তাই। এছাড়াও, নিন্ম আয়ের পিতামাতাকে কোচিং ফি‘র পুরো টাকা না দিতে পারায় তিরস্কার করে শিক্ষার্থীকে আর না আসার ঘটনা প্রমান সহ দেশে বেড়াতে গিয়ে দেখেছি।
খেয়াল করলে দেখা যায়,কিছু সংখ্যক গণ্ডমূর্খ, চাঁদাবাজ,অনৈতিক শিক্ষকরা এইসব করছেন প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর দুর্নাম কুড়াচ্ছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অঞ্চলের মানুষ।
সচেতনভাবে দেখলে দেখা যায়, ঐসব শিক্ষকদের আলাদা আলাদা নামও আছে। কোন নামই শ্লীল নয়। তীব্র ঘৃণা ও অপমাণ যুক্ত কয়েকটি নাম এখানে বলার মতো তীব্র সৎ সাহস আছে। একজন শিক্ষক পরিবারে সন্তান সর্বপরি শিক্ষক সমাজের সম্মান রাখতে বলছিনা। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি- পাঠক হিসাবে আপনি এই লাইনটি পড়ার সাথে সাথেই আপনার আশপাশের বহুল উচ্চারিত জ্ঞানপাপি অমানবিকের চর্চিত নামটি আপনার চোঠের সামনে আছে। চোখে ভাসছে শিক্ষক নামধারী ব্যবসায়ীর ঘৃণিত মুখ।
শিক্ষাকে বানিজ্য বানিয়ে চলা এইসব জ্ঞানপাপীদের অনেক সময় ইনিয়ে বিনিয়ে, নিচু কন্ঠে বলতে শুনেছি- আমরা কী কাউকে বাধ্য করছি প্রাইভেট পড়তে। দলিত ঘৃণা ছড়িয়ে বলা যায়, তাহলে সকাল,বিকাল,রাতের প্রাইভেট বাণিজ্য বাদ দেনা কেন মহাশয়। গায়ে রক্ত-মাংস থাকলে মানুষ হওয়া যায় না- এসব নীতিবাক্য তো ক্লাসে শিক্ষকরাই শিখান। মানবিকবোধের চর্চা আগে শিক্ষাগুরুদের নাকি ছাত্রদের উপরে পড়ে। অভিভাবকরা তো তাদের সন্তানদের মানুষ গড়ার জন্য স্কুলে পাঠান।
উল্টো দিকে, ছাত্রদের সৃজনশীল, মানবিকতা শেখানোর চেষ্টায় ব্রতি শিক্ষকদের চরিত জীবনও সমাজ দেখছে। সমাজে তারা কত সম্মানীত। স্যারদের জীবন ও কাজ কত সুন্দরতম।
যারা শিক্ষার্থী অভিবাবকদের উপর দোষ চাপিয়ে শিক্ষকতাকে পণ্য বানিয়ে আবার নিজেদেরকে ভালোমানুষ ভাবেন,অথবা মানবিকতার প্রকাশ ঘটানোর মানষিক সামর্থ আছে বলে ভাবেন, সেইসব শিক্ষকদের অন্তত স্কুলে ১০/১৫ দিন স্বল্প আয়ের ছাত্রদের বিনে পয়সায় সাপোর্ট দেয়ার সাহস থাকে না কেন?
আপনি নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন এটা আপনার ব্যক্তি জীবনের জন্য কৃতিত্ব হতে পারে। শিক্ষকতা পেশায় আছেন সেখানে সরকার জনগণের টেক্স এর টাকায় আপনার বেতন দিচ্ছে। জানতে ইচ্ছে করে, প্রতিটি বিদ্যালয়ে এদের মতো শিক্ষকদের কারণে যখন স্কুলগুলো সংবাদের শিরোনাম হয় তখন ব্যবসায়ী শিক্ষকরা ছাত্র-অভিবাবক-সমাজে মুখ দেখায় কীভাবে ।
বিবেক ব্যবসায়ী এইসব শিক্ষকদের বহুল উচ্চারিত একটি কথা আছে, অভিবাবক,শিক্ষার্থীরাও আমাদের প্রাইভেট পড়াতে চাপ দেন। ডিম আগে না মুরগী আগে- এই বিচার করার বা ব্যাখ্যা দেবার মতো জ্ঞান ও আচরণ শিক্ষকের আছে বলেই আপনি শিক্ষক। এতএব ডিম বা মুরগীর কে আগে কে পরে সেই খুড়াযুক্তিতে না গিয়ে- ক্লাসে আন্তরিক ও সৎ শ্রম দিয়েই বিচার করুন। এই কথার সত্যটা কতটুকু।
শ্যামাকান্ত স্যার আমাদের আদর্শের প্রতীক। শিক্ষকদের আদর্শের প্রতীক। স্যারের জীবনের সিংহভাগ সময় মানুষ গড়ার কাজে ব্যয় করেছে। শিক্ষক হয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন সমাজে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের বোধে। দয়াময় আল্লাহ ভালোকাজের প্রতিদান তাকে অবশ্যই দিবেন। আপনার পরকালীন শান্তি কামনা করছি।
আমার প্রয়াত শিক্ষক বাবাকে একটি বিষয়ে উচ্চকণ্ঠে দূ:খপ্রকাশ করতে দেখেছি- ‘স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে একটি উন্নত জাতি রাস্ট্র বিনির্মাণে বাংলাদেশকে তৃণমূল থেকে রাস্ট্রের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষকদের অগ্রগণ্য অবদান থাকলেও রাষ্ট্র,সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সমাজ ব্যাবস্থা মানুষ গড়ার কারিগরদের সে অর্থে কখনও মূল্যায়ন করেনি। সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষকদের অবদান কতটুকু তা বুঝা যায় অবসর নেয়ার মূহুর্তে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে জুটে একটি নামসর্বস্ব বিদায় সংবর্ধনা। সেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের উপহার দেয়া হয় ফ্রেমে বাঁধা মানপত্র, বৃদ্ধ বয়সের একটি লাঠি, একটি ছাতা। অথচ শিক্ষকরা সারাজীবন আদর্শে-ব্যক্তিত্বে মেরুদন্ড সোজা করে দাড়াবার শিক্ষা দিয়েছেন। নীতিকথা ফ্রেমবন্দি না করে জাগরণে, প্রত্যয়ে রাখতে শিক্ষা দিয়েছেন। নিয়ন্ত্রণবাদী চিন্তার ছাতায় না থেকে দেশপ্রেম, মুক্তচিন্তা ও চেতনার ছায়া তলে থাকতে শিক্ষকরা প্রতিটি দিন তার শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানে সময় ব্যয় করেছেন।’
প্রিয় শিক্ষকের প্রয়াণের দূ:খগাথা সময়ে সকল জীবিত-মৃত্যু মানুষ গড়ার কারিগরদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। একই সময়ে শিক্ষকতার নামে দেশের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আদর্শের উল্টো স্রোতে হাটা ‘জ্ঞানপাপী’ শিক্ষকদের প্রতি দলিত ঘৃণা প্রকাশ করছি।
আমাদের পরমপ্রিয়, শ্রদ্ধাভাজন শ্যামাকান্ত স্যার( অংকরস্যার) বিনম্র শ্রদ্ধা। পরিবার ও পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা।
আনোয়ারুল ইসলাম অভি : কবি সাংবাদিক,লন্ডন।
আরও পড়ুন:
ব্রিটেনে করোনা সময় : সোশ্যাল মিডিয়ায় মানবতা ও তথ্য ফেরিওয়ালারা