বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতার আগে থেকেই সক্রিয় ছিল সাতটি চক্র
– লন্ডন হাই কমিশনের জাতীয় শোক দিবসের স্মারক অনুষ্ঠানে ড. গওহর রিজভী
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসে বাংলাদেশ হাই কমিশন, লন্ডন আয়োজিত এক স্মারক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে কমপক্ষে সাতটি চক্রের সম্মিলিত ও সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, “যারা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের আমরা চিনি। তারা ছিল নিতান্ত সাধারণ সৈনিক। এদের পিছনে দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্রে কমপক্ষে সাতটি চক্র সক্রিয় ছিল। কোনো কোনোটি ছিল ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্র, কোনোটির পিছনে ছিল সম্মিলিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে জাতির পিতাকে হত্যার এই ষড়যন্ত্র বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু হয়েছিল যাতে করে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া পর তিনি জীবিত অবস্থায় আর বাংলাদেশে ফিরে আসতে না পারেন।”
আন্তজার্তিক খ্যাতি সম্পন্ন ঐতিহাসিক ও গবেষক ড. রিজভী আরো বলেন, “বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়াই ছিলো ষড়যন্ত্রকারিদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এসবের পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। যথাযথ সময়ে সেসব প্রকাশ করা হবে।”
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীমের সভাপতিত্বে স্মারক অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, “ভাষা আন্দোলন থেকেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন এবং এ বিষয়ে তিনি কখনোই আপোষ করেন নি। আজ যারা নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেস্টা করছে তারাই এক সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবেই রেখে দিতে চেয়েছিলো। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে সাফল্যের সাথে যেভাবে এগিয়ে চলেছেন তাতে সব ষড়যন্ত্রই মোকাবিলা করা সম্ভব।”
সম্প্রতি শ্রীলংকাকে বাংলাদেশের ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা প্রদানের কথা উল্লেখ করে তিনি ২০৩০ সালে বাংলাদেশ প্রতিবেশি অনেক দেশকেই তেমন সহায়তা প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বলেন, “ঘাতক চক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। জাতির পিতার দুই সাহসী এবং সুযোগ্যা কন্যা রাস্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর নিভৃতচারী সহদোরা শেখ রেহানা ৭৫ পরবর্তী স্বাধীনতা বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন- একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও প্রগতিশীল সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিরন্তর আন্তরিকতার সাথে কাজ করছেন।”
হাইকমিশনার বলেন, ১৯৭২ সালে যুক্তরাজ্যের সাথে বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীল কূটনৈতিক সম্পর্কের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তার ওপরই আজ রচিত হয়েছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সাফল্যের পঞ্চাশ বছর।
১৯৬৯-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রবাসী বৃটিশ-বাঙ্গালিদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আত্মার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে হাইকমিশনার আরো বলেন, “ব্রিটিশ বাংলাদেশি প্রবাসীরাও কোনদিন বঙ্গবন্ধুকে তাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সমর্থন দিতে এতটুকু কার্পণ্য করেন নি।”
বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এক বিশেষ ভিডিও বার্তায় যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি ও বিরোধী দলীয় নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি স্যার হ্যারলড উইলসনের সাথে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডকে স্যার উইলসন সে সময়ে শুধু বাংলাদেশের মানুষেরই নয়, তাঁরও ব্যক্তিগত অপূরনীয় ক্ষতি হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন।
অপর এক ভিডিও বার্তায় বিশিষ্ট কলামিস্ট-সাংবাদিক ও মহান একুশের অমর গানের শ্রষ্টা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ৭১-এর পরাজিতদের সুসংগঠিত অপপ্রচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সবাইকে সচেতন থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব হয়ে আছেন বলেই আজো তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। তবে বাঙ্গালি যতদিন সচেতন থাকবে, ততদিন কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন লন্ডন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের স্পিকার আহবাব আহমেদ ও নির্বাহী মেয়র জন বিগস, বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গাউস সুলতান, ক্রয়ডন কাউন্সিলের মেয়র শেরওয়ান চৌধুরী, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির সিনিয়র ব্যক্তিত্ব জালাল উদ্দিন ও বিশিষ্ট কমিউনিটি সংগঠক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক।
স্মারক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী স্থপতি ও কবি ইয়াফেশ ওসমান-এর স্ব-রচিত কবিতা আবৃত্তির ভিডিও ছিল মর্মস্পর্শী। এছাড়া মাননীয় সংসদ সদস্য, সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের কন্ঠে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে লেখা কবি মহাদেব সাহার প্রখ্যাত একটি কবিতার হৃদয়গ্রাহী আবৃত্তির আরেকটি ভিডিও সবাইকে অভিভূত করে। অনুষ্ঠানে হাই কমিশনার সম্মানিত অতিথি ও মিশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে শোক দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত একটি স্মারক পুস্তিকার মোড়ক উন্মোচন করেন।
যুক্তরাজ্যে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সফরের স্মৃতি-বিজড়িত ও বাঙ্গালি অধ্যূসিত পূর্ব লন্ডনের একটি মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কমের্র ওপর ব্রিটিশ-বাংলাদেশি শিল্পী এস, এম, আসাদুল্লাহ’র আঁকা ছবি নিয়ে “অ ইধহমধনধহফযঁ ইরৎঃয ঈবহঃবহধৎু অৎঃ উবফরপধঃরড়হ” শীর্ষক এক চিত্রপ্রদর্শনী তরুণ প্রজন্মের ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। বঙ্গবন্ধুর কীর্তিময় জীবন নিয়ে নির্মীত একটি তথ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়। কভিড সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ শিথিলের পর প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা মেনে দুইশতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। পরে পবিত্র কোরান, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। এরপর হাইকমিশনার প্রধান অতিথিদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
স্মারক অনুষ্ঠানে হাইকমিশনের মিনিস্টার (কনস্যুলার) মোঃ মঈন খান, সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাহবুবুর রশীদ, মিনিস্টার (প্রেস) আশিকুন নবী চৌধুরী, মিনিস্টার (পলি্িটক্যাল) এ,এফ,এম, জাহিদুল ইসলাম, মিনিস্টার (জনকূটনীতি) সাব্বির বিন শামস, কমার্শিয়াল কাউন্সিলার এস, এম, জাকারিয়া হক, কাউন্সিলার (পলিটিক্যাল) দেওয়ান মাহমুদুল হক, কাউন্সিলার ও দূতালয় প্রধান স্বদীপ্ত আলম, প্রথম সচিব (পাসপোর্ট ও ভিসা) এ, জেড, এম, শরীফ হোসেন, প্রথম সচিব (পলিটিক্যাল) মাহফুজা সুলতানা, প্রথম সচিব (পলিটিক্যাল) এ,কে,এম, মনিরুল হক, প্রথম সচিব (পলিটিক্যাল) মৌমিতা জীনাত ও এ্যাটাসে (কনস্যুলার) এইচ, এম, ফয়সাল আহমেদসহ মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা উপস্থিত ছিলেন।
সকালে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম হাইকমিশন প্রাঙ্গণে মিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের নিয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন । এরপর জাতির পিতাসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ ও জাতির পিতার ও তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি