ফুটবল দুনিয়ায় ‘হুলিগান’ খ্যাত ইংলিশ ফুটবল সমর্থকেরা আবারো খবরের শিরোনাম হলেন রোববারের ইউরো ফাইনালের পরে। টাইব্রেকারে ৩ – ২ গোলে হারের পর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কিছু ইংলিশ ফুটবল সমর্থক চড়াও হয়েছিলো ওয়েম্বলিতে আসা ইতালীয় সমর্থকদের ওপর। ‘হুলিগান’ বলে তাদের যে পুরোনো বদনাম রয়েছে, খেলা শেষ হবার পর ইতালীয় দর্শকদের ওপর শারীরিক আক্রমণ চালিয়ে আবারো তা তারা জারী রেখেছে। কোনো কোনো ইতালীয় দর্শক বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন। ম্যাচ শেষে ইতালীয় দর্শকদের হাত থেকে পতাকা কেড়ে নিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়া, পতাকায় থুথু ছিটানো, পতাকার ওপর দাঁড়িয়ে দানবের ন্যায় উল্লাস করার মতো নানান ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে ইংলিশ হুলিগানরা। এ থেকে রেহাই পাননি যে তিনজন ইংলিশ খেলোয়াড় পেনাল্টি শুটআউট মিস করেছেন তাঁরাও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় মার্কাস রাশফোর্ড, বুকায়ো সাকা এবং জেডন সাঞ্চো। এনিয়ে তীব্র নিন্দার ঝড় বইছে ফুটবল বিশ্বে।
দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছর অপেক্ষার পর ইংলিশ ফুটবল সমর্থকরা এবার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন ইংল্যান্ডের শিরোপা জয় নিয়ে। কারণটা একদম পরিষ্কার। আর তা হলো ১৯৬৬ সালের পর এবারের ইউরোতেই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল গ্যারেথ সাউথগেইট এর দল। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ১-১ সমতার পর টাইব্রেকারে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে ইংলিশদের। আনন্দের সমুদ্রে আর স্নান করা হলো না। বরং বেদনার সাগরে ডুবতে হলো আবার। অন্যদিকে শিরোপা জিতে পুরো ফুটবল চিত্র নাট্যকে পাল্টে ইংলিশ সমর্থকদের শ্লোগান ‘ইটস কামিং হোমকে’ ইতালীয়রা এখন বলছেন ‘ইটস কামিং টু রোম’।
তারুণ্য নির্ভর ইংলিশ দলকে নিয়ে কোচ গ্যারেথ সাউথগেইট নিদ্রায় – জাগরণে বারবারই হয়তো ভেবেছিলেন শিরোপা জয়ের। কারন ১৯৯৬ সালের ইউরো টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর পেনাল্টি শুটআউট মিস করার বদলা নেয়ার এবারই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। সেবার তাঁর হৃদয়ে যেমনি রক্ত ঝরেছিলো, তেমনি ঝরেছিল চোখের জল। ফুটবল রণাঙ্গন থেকে পরাজিত সৈনিকের মতো বিদায় নিলেও পঁচিশ বছর পর সেখানেই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো জয়ের গল্প লেখার সুযোগ খুব কাছে এসেও ধরা দেয়নি। যেনো ‘শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ’। তার পরও ফুটবল বোদ্ধাদের মতে, ইংলিশ দলের খেলোয়াড়রা পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে চমৎকার ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেছেন। হয়তো কোনো কারণে ভাগ্যদেবতা তাদের প্রতি সুপ্রসন্ন ছিলেন না।
অন্যদিকে সুইডেনের বিপক্ষে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং প্লে – অফে হেরে ইতালীয়ান ফুটবলের শেষকৃত্য প্রায় সারা হয়ে গিয়েছিলো।চারবার বিশ্বকাপ জয়ী ইতালির অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে বিশ্বকাপের আসরে ছন্দ পতন ঘটিয়েছিলো তা বলাই বাহুল্য। তবে শেষকৃত্য পুনর্জন্মে রূপ নিতে বেশি সময় লাগেনি। দলের পোস্টমর্টেমের দায়িত্ব দেয়া হয় সাবেক জাতীয় দলের খেলোয়াড় ও তিন সন্তানের জনক রবার্টো ম্যানচিনির ওপর। নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে চলেছেন ইতালি জাতীয় ফুটবল দলের জন্যে ম্যানচিনি । তাঁর নেতৃত্বে বর্তমান দলে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলটাই এবারের ইউরো টুর্নামেন্টে ইতালিকে আলাদা করে দিয়েছে অন্যদের থেকে। ইতালীয় ফুটবল খেলার পুরো ধরণটাই পাল্টে দিয়েছেন ম্যানচিনি।তাইতো গত টানা ৩৪টি ম্যাচে ইতালির অপরাজিত থাকার ঈর্ষণীয় রেকর্ড মনে করিয়ে দেয় ম্যানচিনির ম্যাজিক্যাল কোচিং দক্ষতার কথা। ফুটবল খেলার সাফল্য নির্ভর করে টোটাল টিম ওয়ার্কের উপর। তা সত্বেও কোচ ম্যানচিনি জয়ের পিছনে কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার বলে ইতালির গোলকিপার জিয়ানলুইগি ডোনারুমার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সেমিফাইনালে স্পেনের বিরুদ্ধে এবং ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পেনাল্টি শুটআউট এ তাঁর চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্স ইউরো কাপের ইতিহাসে প্রথম গোলকিপার হিসেবে প্রতিযোগিতার সেরা ফুটবলার হবার বিরল সম্মান এনে দিয়েছে তাঁকে। সে সাথে ১৯৬৮ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো নিজ দেশকে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব এনে দিলেন।
এদিকে ইংল্যান্ডের পরাজয়ের নেপথ্যে কেউ কেউ কোচ গ্যারেথ সাউথগেইট এর কিছু সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের মতে, ফাইনাল খেলার দ্বিতীয়ার্ধের অনেকটা সময়জুড়ে খেলা দেখে মনে হচ্ছিলো ইংল্যান্ড দল যেনো অতিরিক্ত সময়ে খেলাকে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করেই খেলছিলো, ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের সাড়া জাগানো মিড ফিল্ডার জ্যাক পিটার গ্রিলিশকে অনেক আগেই মাঠে নামানো উচিত ছিলো, বদলি খেলোয়াড়দের মাঠে নামিয়েছেন অনেক দেরি করে। যে ভুলটি কিন্তু ম্যানচিনি করেননি। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে মার্কাস রাশফোর্ড ও জেডন মালিক সাঞ্চোকে মাঠে নামানোর জন্য সাইড লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেলেও শেষতক তাঁদের শেষ বাঁশি বাজার দুই – তিন মিনিট আগে মাঠে নামানো হয়। দলে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় থাকা সত্বেও তিনজন তরুণ খেলোয়াড়কে পেনাল্টি শুটআউটের জন্য নির্বাচিত করা হয়। যদিও খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে গ্যারেথ সাউথগেইট দলের পরাজয়ের পুরো দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই তুলে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। রোববার পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৩০.৯৫ মিলিয়ন ফুটবল অনুরাগী টিভিতে ফাইনাল ম্যাচ উপভোগ করেছেন। উল্লেখ্য ১৯৯৭ সালে টিভিতে সম্প্রচারিত প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটি ৩১ মিলিয়ন দর্শক দেখেছিলেন। অর্থাৎ প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানের পর রেকর্ডসংখ্যক সবচেয়ে বেশি ফুটবল রসিক দর্শক রোববার টিভির সামনে বসেছিলেন।
যা হোক , এখন অপেক্ষার পালা ২০২২ সালে অনুষ্ঠিতব্য কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে তারুণ্য নির্ভর ইংল্যান্ড দল আবারো শক্তি সঞ্চয় করে পাখা মেলে কতোটা উড়াল দিতে সক্ষম হবে তা দেখার। জয়ের আনন্দ যেমন দুকূল প্লাবিত করে সমর্থকদের ভাসিয়ে নিতে পারে, তেমনি পরাজয়ের বেদনা নীল থেকে গাঢ় নীল হয়ে কাঁদাতে পারে সমর্থকদের। তবে শেষ অবধি এটাই বলবো খেলা তো কেবলি খেলাই মাত্র। এ সহজ অংকটি ইংলিশ ‘হুলিগানদের’ বুঝতে আরো কত সময় লাগবে কে জানে!
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী ।
আরও পড়ুন: