গত সাত বছর ধরে ‘মন কী বাত’ অনেক শুনিয়েছেন, মি. প্রাইম মিনিস্টার! এবার কাজের কথা বলুন। দেশবাসী কাজের কথা শুনতে আগ্রহী। স্বকপোলকল্পিত কাহিনি শুনিয়ে দেশবাসীকে আর বিক্ষুব্ধ করবেন না, প্লিজ! ক্ষুধার পেট বাক্য দিয়ে পরিপূর্ণ করার খাহেশ অনেকের-ই মিটে গেছে! প্রায় একশত ত্রিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে ‘মন কী বাত’ শুনার মতো লোকের অভাব হয়তো নেই, কিন্তু যাঁরা শুনছেন, তাঁদের কত জনের সংসারে নিত্য দিন অভাব লেগে আছে, সেই খবরটি কি রাখেন? এখন আর নুন আন্তে পান্তা ফুরোয় না। অনেকের নুনটুকু ক্রয় করারও সাধ্য নেই! তাই, নুন ছাড়া-ই পান্তা খেতে হয় অনেককে! দু/চারজন ব্যক্তির সঙ্গে দূরআলাপন করে এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে নানাবিধ সমস্যা সম্পর্কে অবগত হওয়া অসম্ভব। নানা মত ও পথের অনুসারি জনগণ এ-দেশকে আবহমান কাল ধরে সৃজন করে এসেছেন। একদিনে সৃষ্টি হয়নি ‘এই ভারতের মহামানবের সাগর’ তীর! এক জাতির দ্বারাও সৃষ্টি হয়নি এই ভারতবর্ষ নামক ‘তীর্থক্ষেত্র’টি! ‘শক-হুন-দল-পাঠান-মোগল’ এক দেহে লীন হতে কত শত শতাব্দী লেগেছে! কে বলতে পারে! আপনি তো পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচনি জনসভায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারত তীর্থ’ কবিতা থেকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতার কিয়দংশ আবৃত্তি করেছিলেন! কিন্তু কবিগুরুর ‘অপমানিত’ কবিতাটি পড়ে দেখেছেন কি কোনও দিন? কবিগুরু অপমানিত কবিতায় লিখেছেন,”মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে/ ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।/ বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে/ ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।।” কবিতার অন্যত্র লিখেছেন, ”তবু নত করি আঁখি, দেখিবারে পাওনা কি/ নেমেছে ধুলার তলে হীনপতিতের ভগবান।/ অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান।।”
কবি গুরু তাঁর দিব্য চক্ষে ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষকে দেখতে পেয়েছিলেন! তাই, এমন অমোঘ বাণী উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন! কবিগুরু তাঁর বিখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’ তে সন্দীপ নামক যে চরিত্রটি চিত্রিত করেছিলেন, সেই খল-চরিত্রটির সঙ্গে আজকের শাসক দলীয় নেতৃবর্গের কী আশ্চর্য ‘মিল’! মি. প্রাইম মিনিস্টার! আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন, তাই, রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দিলাম। কাজি নজরুল ইসলামের ‘ভাঙ্গার গান’ কিংবা ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতাটি পড়েছেন কি না জানি না। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যখন দেশবাসী উদ্বুদ্ধ, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘ঐক্য’ ভেঙে দিতে নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে দেখা দিল খেয়োখেয়ি! তখন-ই গর্জে উঠলেন কবি নজরুল। তাঁর বিখ্যাত ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,”অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,/ কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।/ ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ এই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তার মোর মা’র!” নজরুল তাঁর ‘বিদ্রোহী বাণী’ কবিতার প্রথম দুটি পংক্তিতে বলেন,”দোহাই তোদের! এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল!/ ঢের দেখালি ঢাক ঢাক গুড় গুড়, ঢের মিথ্যা ছল।/ এবার তোরা সত্য বল।।/ পেটে এক আর মুখে আরেক—এই যে তোদের ভণ্ডামি,/ এতেই তোরা লোক হাসালি, বিশ্বে হলি কম-দামি।”
দু’ বছর ধরে কোভিড-এর জাঁতাকলে দেশের সিংহভাগ মানুষ অসহায়ভাবে প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন! গণমানুষের সমস্যাকে নিত্যদিন দূরে ঠেলে দিয়ে আমাদের শাসকদলীয় নেতৃবর্গ পক্ষান্তরে হীনপতিতের ভগবানকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছেন! ‘বিধাতার রুদ্ররোষে’ আজ ‘দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে’ উচ্চ-নীচ সবাইকে ভেদাভেদ ভুলে একসাথে অন্ন গ্রহণ করার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন চোখ নত করার সময়! শাসকবর্গ শাসিতদের দেখভালের দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পাদন না-করার দরুন ভগবান আজ রুষ্ট! গণমানুষের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা নেই! এদিকে, সর্বত্র সারি সারি লাশ! শ্মশানে-গোরস্থানে স্থান সংকুলান হচ্ছে না! পবিত্র গঙ্গা-যমুনা আজ লাশের মিছিলে কাতর! এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না। মানুষ বিপন্ন! মি. প্রাইম মিনিস্টার! মানুষ আজ অসহায়! মানুষের পাশে দাঁড়ান। মন কী বাত অনেক হয়েছে। এবার কাজের কথা বলুন। দেশবাসীর জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করুন। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে সমগ্র দেশবাসী আজ জিম্মি!দেশবাসীকে এঁদের অক্টোপাস থেকে উদ্ধার করুন।