সকাল ১০ টায় স্কুলে গিয়ে বসে বসে দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করছিলাম। কিছু সময় পরে একজন অভিভাবক আমার কক্ষে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন । যথারীতি অনুমতি দিয়ে বসার অনুরোধ করলে তিনি বসলেন। বললেন, স্যার আমার ছেলের একটি সার্টিফিকেট নেব। আমি বললাম, যিনি সার্টিফিকেট দিবেন তিনিতো আজ নেই, আগামী শনিবার আসতে হবে। তখনই তিনি বললেন, আপনার স্কুলে স্যার ঢুকার মুহূর্তেই গেইটে একটি ধাক্কা খেলাম, তখনই বুঝতে পেরেছি আমার কাজটি আজ হবে না।
এটি একটি কুসংস্কার। তাই মনে হল এই শব্দটি দিয়ে আজকের লেখায় মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করব।
কুসংস্কার হলো অযৌক্তিক যেকোনো বিশ্বাস বা অভ্যাস যা বেশীরভাগ সময় অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়।মানুষের তৈরি যুক্তিহীন এসব ভ্রান্ত বিশ্বাস, কথা, কাজ ও প্রথাকে সহজ বাংলায় কুসংস্কার বলা হয়।
‘কু’ উপসর্গটি মানেই খারাপ বা অশুভ কিছু। ‘কুসংস্কার’ মানেই দাঁড়ায় কু যে সংস্কার অর্থাৎ যে সংস্কার মানুষের জন্য ভালো নয়। এই সংস্কার না মানলে কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই । কুসংস্কার বিশেষ করে, বাঙালিদের অনেক অনেক পিছিয়ে রেখেছে। গ্রামীণ অঞ্চলে কুসংস্কার বেশি মানলেও শহরাঞ্চলেও কম নয়।
কুসংস্কারে বিশ্বাস সত্যের অনুসন্ধানকে খর্ব করে। সাফল্য থেকে পিছিয়ে রাখে। এটির প্রভাব এমইন যে, কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষ বর্তমান সময় আর যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না।
সচরাচর ঘটে যাওয়া অনেকগুলোর মধ্যে কয়েকটি বলা যায়,যেমন- বাসার বাইরে বের হতে গিয়ে ধাক্কা খেলে মনে করা হয় এটি খারাপ লক্ষণ।এটা হয়তো কোনো কারণে বাইরে যেতে দিতে বাধা দিচ্ছে।
জোড়া কলা খেতে গিয়েও আমরা থেমে যাই।ভাবি জোড়াকলা খেলে সন্তানও হবে জোড়া।
গোল্লা পাওয়ার ভয়ে ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিতে এখনো অনেকে যেতে চায় না।
ডান হাতের পাতা চুলকালে খুব আনন্দ লাগে, এই বুঝি এবার হাতে টাকা আসবে। কারণ আমরা জেনে আসছি যে, ডানহাত চুলকালে টাকা আসে।
পথে কালো বিড়াল দেখলে সেটা অশুভ।
কোন কথা বলার সময় টিকটিকি যদি টিক- টিক করে শব্দ করে তাহলে সেই শব্দকে ঐ কথার সত্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যম ধরা হয়।
একসংঙ্গে কয়েকজন বন্ধু গল্প -গুজব করছে তাদের মধ্যে কেউ উপস্থিত না হলে তার সম্পর্কে পরস্পরের আলোচনা হতে থাকে, এমতাবস্থায় সে উপস্থিত হলে অনেকেই বলে- আপনি অনেকদিন বাঁচবেন।
একবার সিলেটের বিজিবি ক্যাম্পের পুকুরের তথাকথিত ‘অলৌকিক পানি‘ পান করে রোগ ভাল হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি সারাদেশে আলোচনা -সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।রোগ ভাল হওয়ার আশায় নোংরা ও কাঁদাযুক্ত পানি পান করার জন্য হাজার হাজার মানুষ ঘটি, বাটি, লোটা, মগ, বোতল ও বালতি নিয়ে পুকুরের পানি নেয়া শুরু করল।এক পর্যায়ে পুকুরের পানি শুকিয়ে যাচ্ছিল। পুকুরের পানি সংগ্রহে হানাহানি সামাল দেয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বিজিবি নিয়োগ দিতে হয়েছিল।পানি পান করে কয়েকশ নারী-পুরুষ,শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এরকম অনেক কথা আছে ও অনেক ঘটনা আছে যা শুনে যেগুলোকে আমরা পালন করি।
যুগ যুগ ধরে কুসংস্কার টিকে থাকে শুধু মানুষের আবেগ নির্ভর বিশ্বাসের কারণে।কেননা যুক্তি দিয়ে বিচার করলে বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায় কুসংস্কার ভিত্তিহীন।
সংস্কার ,কুসংস্কার ও বিজ্ঞান তিনটি বিষয়ই একটি অন্যটির বিরোধী।
সংস্কারের সৃষ্টি মানুষের মঙ্গলের জন্য, নিয়মের মধ্যে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য। আর কুসংস্কার সংস্কারের বিকৃত রুপ।বিজ্ঞান সবসময়ই যুক্তি আর প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত।কিন্তু কুসংস্কার পুরোটাই যুক্তিহীন।
এজন্য আধুনিক উৎকর্ষতার যুগে বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করুন। প্রযুক্তির যুগে এসে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই মানায় না। এসব বিষয়ে যার যার অবস্থান থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন বা কুসংস্কারে মোহাচ্ছন্ন মানুষদের বুঝানো -প্রতিটি সচেতন মানুষের যুক্তিদিয়ে বুঝানো উচিত।
আপনার চারপাশে যে মানুষগুলো টুকি-টাকি কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, আপনার উচিত তাদেরকে এড়িয়ে চলা। এবং নিরন্তর মনে প্রত্যয় লালন করে চেষ্টা করা যুক্তি ও ব্যাখার মাধ্যমে তাদের ভুল ভেঙ্গে আলোর পথে নিয়ে আসা।
লেখক : মো: কবির খান, প্রধান শিক্ষক,সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।