বিধাতার খেলা বোঝা সত্যিই দুস্কর। তা না হলে নিজের জন্ম মাসে জীবন সঙ্গীর বিদায়, এও কি ভাবা যায়? গত বছর উইন্ডসর রাজপ্রাসাদে রানী তাঁর অনুষঙ্গীকে নিয়ে ৯৪তম জন্মোৎসব পালন করেছিলেন খুব নিরিবিলিতে। করোনার কারণেই রাজকীয় ব্যস্ততা থেকে কিছুটা সময় বের করে দুজন দুজনার কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। অথচ ৯৫তম জন্মদিন আর একসঙ্গে উদযাপন করা হলো না। ভীষণ মায়া হয় রানীর জন্যে! জন্মদিনের কেইক কাটার সময় এবারে পাশে থাকবেন না তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষটি। আচ্ছা, কেইক কেটে রানী কি মনের অজান্তেই তাঁর স্বামীকে কেইক খাইয়ে দিতে এদিক – ওদিক তাকাবেন? সুদীর্ঘ ৭৩ বছরের অভ্যাস কি ক’দিনেই ভোলা সম্ভব? আহারে, রানী কি পারবেন এপ্রিল মাসে তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে অতীতের ন্যায় অফুরান আনন্দে মেতে উঠতে? দীর্ঘদিনের সাথীকে হারিয়ে কেমন আছেন আমাদের মহামান্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ? ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। প্রিন্সেস এলিজাবেথ আলেক্সান্দ্রা মেরীর জন্ম হয়েছিল ভোর ২টা ৪০ মিনিটে। তারিখ ২১ এপ্রিল। ১৯২৬ সাল। বাবা ডিউক অফ ইয়র্ক প্রিন্স অ্যালবার্ট ও মা লেডি এলিজাবেথ আঞ্জেলা মার্গারিট বয়েস লিওন এর প্রথম সন্তান এর জন্ম কিন্তু কোনো রাজপ্রাসাদে হয়নি। লন্ডনের মেফেয়ার এলাকায় ১৭ নম্বর ব্রুটোন স্ট্রিটে নানা – নানীর বাড়িতে আজকের রানী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তখন ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন প্রিন্সেস এলিজাবেথের দাদা রাজা পঞ্চম জর্জ। দাদি, রানী মেরী। প্রিন্সেস এলিজাবেথের কোনো ভাই নেই। ১৯৩০ সালের ২১ অগাস্ট তাঁর ছোটো বোন প্রিন্সেস মার্গারেট রোজ জন্ম গ্রহণ করেন। দু’বোনের মাঝে ছিল নিবিড় সখ্যতা। নানা, ১৪তম আর্ল অফ স্ট্রাথমোর এন্ড কিংহর্ন – ক্লড জর্জ বয়েস লিওন । নানী, সিসিলিয়া নিনা বয়েস লিওন, কাউন্টেস অফ স্ট্রাথমোর এন্ড কিংহর্ন। উল্লেখ্য প্রিন্সেস এলিজাবেথের জন্মস্থান ১৭ নম্বর ব্রুটোন স্ট্রিট দর্শনার্থীদের জন্য যাদুঘর হিসেবে সংরক্ষন করে রাখা হয়নি। বরং একই ঠিকানায় বর্তমানে গড়ে উঠেছে লন্ডনের প্রসিদ্ধ চাইনিজ – ক্যান্টোনিজ রেস্টুরেন্ট “হাক্কাসান মেফেয়ার”। ১৯৩৬ সালের ২০ জানুয়ারি দাদা পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর চাচা অষ্টম এডওয়ার্ড সিংহাসনে আসীন হন। আমেরিকান ডিভোর্সি, প্রেয়সী ওয়ালীস সিম্পসনের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে রাজা হিসেবে বছর না ঘুরতেই শেষতক ১১ ডিসেম্বর সিংহাসন ত্যাগ করেন প্রিন্সেস এলিজাবেথের প্রিয় চাচা। ব্রিটেনবাসী চকিত হয়েছিলেন রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের আকস্মিক সিদ্ধান্তে। ভাইয়ের সিংহাসন ত্যাগের পর প্রিন্সেস এলিজাবেথের বাবা ডিউক অফ ইয়র্ক, প্রিন্স অ্যালবার্ট রাজা ষষ্ঠ জর্জ নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। এরই ফলশ্রুতিতে বড়ো সন্তান হিসেবে প্রিন্সেস এলিজাবেথ রাজ সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারিণী নির্বাচিত হন। এমনিতেই প্রিন্সেস এলিজাবেথ শৈশব থেকেই শান্ত মেজাজের ছিলেন। সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারিণী নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর গতিবিধিতে চলে আসে আরো সীমাবদ্ধতা। অন্যদিকে প্রিন্সেস মার্গারেট ছিলেন সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি ছিলেন ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির। হৈচৈ করা, হাস্য রসের মাধ্যমে লোকজনকে আনন্দ দেয়া, কৌতুক বলা এসব কিছু করে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইতেন। তাইতো তাঁদের বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ প্রায়ই বলতেন “এলিজাবেথ আমার অহঙ্কার আর মার্গারেট আমার পরমানন্দ”।
বাল্যকাল থেকেই পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা প্রিন্সেস এলিজাবেথকে “লিলিবেট” বলে ডাকতেন। ছোটবেলায় তাঁদের দু’বোনের লেখাপড়া দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁদের মা এবং গৃহ শিক্ষিকা ম্যারিয়ান ক্রাউফোর্ড। এছাড়া ব্রিটেনের বিভিন্ন স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষক – শিক্ষিকা রাজপ্রাসাদে গিয়ে প্রিন্সেস এলিজাবেথ ও প্রিন্সেস মার্গারেটকে পড়িয়েছেন। প্রিন্সেস এলিজাবেথের প্রিয় বিষয়ের মধ্যে ইতিহাস, সংগীত এবং ভাষা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁর পছন্দের রং হলো নীল, সবুজ ও বেগুনি। সাদা লিলি (লিলি অফ দ্যা ভ্যালি) ও হালকা গোলাপি রঙের গোলাপ ফুল তাঁর বেশ প্রিয়। ঘোড়ায় চড়তে ভীষণ পছন্দ করেন। ঘোড়দৌড় তাঁর অন্যতম প্রধান শখ। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা – মার সঙ্গে ডার্টমাথে, ব্রিটানিয়া রয়্যাল নেভাল কলেজ পরিদর্শনে গেলে তরুণ ক্যাডেট, প্রিন্স ফিলিপের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। প্রণয় থেকে পরিণয় ২০ নভেম্বর, ১৯৪৭ সালে। তাঁরা ছিলেন দূর সম্পর্কের কাজিন। নিজের মতো করে দাম্পত্য জীবনের ছুটে বেড়ানো দিনগুলো বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। বাবা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর রানী হিসেবে তাঁকে সিংহাসন অলংকৃত করে রাজ সাম্রাজ্যের উত্তুঙ্গ পদে আসীন হতে হয়েছে। রাজকুমারী থেকে রানী – আকাশসম দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে তাঁকে। উপরন্তু যুক্ত হয় “হেড অফ কমনওয়েলথ” এর দায়িত্ব। যার ভার তিনি এখনো অতি দক্ষতার সাথে বয়ে চলেছেন। উল্লেখ্য ব্রিটিশ রাজ পরিবারের ইতিহাসে রানী ভিক্টোরিয়ার দীর্ঘদিনের রাজ শাসনের রেকর্ড ভঙ্গ করে ২০১৫ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
উল্লেখ্য ১৭৪৮ সালে রাজা দ্বিতীয় জর্জ বছরে দু’বার তাঁর জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল নভেম্বর মাসে। কিন্তু সে সময় ব্রিটেনের আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে বিধায়, তিনি “বার্থডে প্যারেড” করার সিদ্ধান্ত নেন সামারে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে। সে থেকে রাজকীয় এ ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণ করে আসছেন পরবর্তী রাজা এবং রানীবৃন্দ। রানী এলিজাবেথ সিংহাসনে বসার পর তাঁর প্রকৃত জন্মদিন এপ্রিল মাসে উদযাপন করার পাশাপাশি তাঁর অফিসিয়াল জন্মদিন জুন মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার পালনের সিদ্ধান্ত নেন। কারন তাঁর বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ একই দিনে তাঁর অফিসিয়াল জন্মদিন পালন করতেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সাল থেকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জুন মাসের দ্বিতীয় শনিবারে তাঁর অফিসিয়াল জন্মদিন পালন করে আসছেন। এপ্রিলের ২১ তারিখে রানী শুধুমাত্র তাঁর পরিবারের নিকটজনদের নিয়ে ঘরোয়াভাবে জন্মদিন উদযাপন করে থাকেন। অবশ্য এদিন দুপুরে লন্ডনে বিভিন্ন ধরণের গান স্যালুটের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যদিও করোনার কারণে গত বছর রানীর ইচ্ছায় তা অনুষ্ঠিত হয়নি।
এমনকি গত বছরের জুন মাসে অফিসিয়াল জন্মদিনে তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ছাড়া পরিবারের অন্য কোনো সদস্য উইন্ডসর রাজপ্রাসাদে উপস্থিত ছিলেন না। কেবল উইন্ডসর রাজপ্রাসাদের ভিতরের সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত চতুষ্কোণ উঠোনে হালকাভাবে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়েছিল। এছাড়া অফিসিয়াল জন্মদিনের দিন চিরাচরিত কায়দায় বাকিংহ্যাম রাজপ্রাসাদের বারান্দায় রানী তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উপস্থিত হয়ে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে থাকেন। ১৬৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বৃটিশ আর্মির সবচেয়ে পুরোনো রেজিমেন্ট এর সদস্যরা লন্ডনে এদিন নানাধরণের কুচকাওয়াজে অংশ নেন। রানী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। যুদ্ধ বিমান থেকে ব্রিটিশ ইউনিয়ন ফ্ল্যাগের বা পতাকার নীল, লাল ও সাদা রঙ আকাশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের কারণে তার কোনো কিছুই করা সম্ভব হয়নি গত বছর। এছাড়া রানী তাঁর অফিসিয়াল জন্মদিনের আনন্দকে জনসাধারণের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য এবং এদিনটিকে আরো অর্থবহ করার লক্ষ্যে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য তাঁর রাজ্যের গুণী লোকজনদের নানা উপাধিতে ভূষিত করে থাকেন।
প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছে শনিবার, ১৭ এপ্রিল। তাঁকে উইন্ডসরের সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে সমাহিত করা হয়েছে। কালো পোশাক পরিহিতা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের সামনে রাজকীয় বেন্টলী গাড়ি থেকে বের হয়ে কয়েক কদম হেঁটে পূর্বের ন্যায় পিছনে ফিরে তাকিয়েছিলেন। কে জানে মনের ভুলে হয়তো স্বামী পিছনে আছেন কিনা তাই দেখার চেষ্টা করেছিলেন! যেমনটা তিনি যথারীতি করতেন প্রিন্স ফিলিপের সাথে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে। রানীসহ রাজ পরিবারের সবাই আগামী শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত শোক পালন করছেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, বুধবার, ২১ এপ্রিল তাঁর জন্মদিনে কোনো জাকজমক থাকবে না। তবে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে নিভৃতে দুপুরের খাবার খেতে পারেন রানী। তাঁদের চার সন্তান, আটজন নাতি – নাতনি কিংবা দশজন গ্র্যান্ডসান ও গ্র্যান্ডডোটারের মধ্যে কে কে উপস্থিত থাকবেন সেদিন তা এখনো জানা যায়নি। উচ্ছ্বাসহীন এবারের জন্মদিনে নিশ্চিতভাবে জীবনসঙ্গী প্রিন্স ফিলিপ থাকছেন না। সোহাগ করে “সসেজ ” বা ” লিলিবেট ” বলে ডাকার মানুষটি আজ আর পৃথিবীতে নেই। কি যে বেদনাদায়ক অনুভূতি! জন্মদিন উপলক্ষ্যে রানীর দীর্ঘ জীবন, সুস্বাস্থ্য আর সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ কামনা করছি। প্রার্থনা করি বিধাতা যেনো জীবনের সব ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সম্পূর্ণ শক্তি মহামান্য রানীকে দিন। শুভ জন্মদিন “হার ম্যাজেস্টি দ্যা কুইন”।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী।
আরও পড়ুন: