কোভিড-১৯ যে কতোটা প্রাণঘাতি এবং এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কত নির্মম ও দীর্ঘস্থায়ি যাদের হয়েছে মূলত তারাই হলফ করে বলতে পারবেন। এবং তার সাথে বসবাস করা স্বজন, পরিবারও এর নির্মমতা অবলোকন ও অনুভব করেছেন।
করোনার দ্বিতীয় ফেইজের আগ থেকে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের সতর্কতামূলক দিক নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করে ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে শিরোনামে থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলগুলো একতরফাভাবে, অনেকে বলছেন ‘একগুয়েমি মনোভাব’ নিয়ে খোলা রেখেছেন। এবং লকডাউন নীতিতেও ছিলনা তারই নিয়োগকৃত হেলথ সাইন্টিফিক এডভাইজারদের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোন কঠোর নির্দেশনা এবং বাস্তবায়নে তদারকি।
ফলত যা হবার- তাই হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা। ব্রিটেন এখন স্তব্ধ। হীম ঠান্ডায় ব্রিটেনের বাতাসে শোকের বোবা মাতম। সরকারকে বাধ্য হয়ে বিশেষজ্ঞ, বৈজ্ঞানিক কর্মকতা, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এর কথা শুনতে হচ্ছে। উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে, বাচঁতে এবং প্রিয়জনদের বাঁচাতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার বিকল্প যেমন নেই। এর ব্যত্যয় হলে কঠোর আইন প্রয়োগ চলবে অনিদৃষ্ট সময় পর্যন্ত।
সোশ্যাল মিডিয়ায় করোনায় আক্রান্তদের খবর প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ !
এনএইচএস এর তথ্য মতে, ব্রিটেনে এখন প্রতি মিনিটে একজনেরও বেশী মানুষ মারা যাচ্ছেন। প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন করোনা রোগী হাসপাতালের স্বরণাপন্ন হচ্ছেন। এই
চিত্র বলে দেয় গোটা দেশ করোনা মহামারিতে কোন পর্যায়ে আছে। মহামারীর চুড়ান্ত সময়ে এ নিয়ে আমাদের মধ্যে করোনা নিয়ে চলছে অতিকথন ও প্রচার প্রচারোণার প্রতিযোগিতা। তবে বিনয়ে, সচেতনভাবে, স্পষ্টত বলছি যে, সিংহভাগ নেটিজেনদের এই দলে নেয়ার কোন সুযোগ নেই ।
ইন্টারনেট দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উন্নত দেশের মানুষের কাছে একটি জনপ্রিয় স্যোসাল হ্যাব। একজন মানুষ প্রাণঘাতি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।তার সুস্থতা কামনায় দোয়া করা এবং অন্যদের কাছে দোয়া চাওয়া একটি মানবিক প্রসংশনীয় কাজ। কিন্তু সেটা যদি হয় প্রকারান্তে নিজের প্রচার ও প্রচারোণার অবলম্বন, তাহলে, এনিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম অসংখ্য বিরক্তিকর, বেদনাময় ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যে চলছে বিরুপ সমালোচনা। ব্যক্তিগত অবলোকন থেকে কয়েকটি সত্য ঘটনা ছন্মনামে এখানে উল্লেখ করতে চাইছি-
ক. মিলন আহমদ ব্রিটেনে বাংলাদেশী রাজনৈতিক দলের একজন নেতা। ইউরোপের একটি দেশে হলিডে শেষে লন্ডনে হোম কোরাইন্টানে আছেন। তার একজন আস্থাভাজন কর্মী ফেইসবুকে তার ওয়ালে লিখেছেন, ‘সাবেক ছাত্রনেতা(……/..…)মিলন আহমদ করোনায় আক্রান্ত। সকলের দোয়া চাই।’
তারপরই শুরু হয় – দোয়া কামনায় কমেন্টস অপশনে অতিকথনে শব্দবৃষ্টি। নেতার অনুসারীদের অনেকে মিলন আহমদের সাথে ফ্রেমবন্দি ছবি দিয়ে দোয়া কামনা করছেন। কেউ কেউ পোষ্টার তৈরী করে নিজেদের ওয়ালে,হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার দিচ্ছেন। রাতের মধ্যেই অতি উৎসাহী কয়েকজন ইউরোপের একটি দেশ থেকে করোনায় আক্রান্ত নেতার রোগ মুক্তির জন্য কয়েকজন মিলে ভার্চুয়াল দোয়ারও আয়োজন করেন। এই পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছিল।
কিন্তু এরই মধ্যে ঐ অনুগত কর্মী নিজেদের ঘরোনার একটি অখ্যাত অনলাইন পোর্টালে ‘ভার্চুয়াল দোয়া’র নিউজটি প্রকাশ করেন।
অনলাইন পোর্টালে তার করোনা আক্রান্তের খবরে নেতা যেন কার্যত মাইনকা চিপায় পড়েন। এদিকে তার ঘনিষ্টজনদের মাধ্যমে জানা গেল মিলন আহমদ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হননি। ভ্রমণজনিত কারণে করোনা সময়ের স্বাস্থ্যবিধি মেনে হোম কোরাইন্টেনে ছিলেন। অতি উৎসাহী কর্মীরা ‘হোম কোরাইন্টেন ’ কে ’করোনা আক্রান্ত’ বলে প্রচার করেছে।
এরপরেও বিষয়টি শেষ হয়নি। নেতাকে নিয়ে শুরু হয় আরেক অন্তর্জাল যুদ্ধ! নেতার অনুসারীদের মধ্যেও গ্রুপ আছে। এবার অন্যগ্রুপ তাকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে সোচ্চার হলেন – ‘করোনায় আক্রান্ত হওয়ার মিথ্যা সংবাদ ‘ প্রকাশ করে নেতাকে বিভ্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে।যথারীতি এই গ্রুপও ফেইসবুকে নেতার ছবি নিয়ে প্রকাশ করলেন প্রতিবাদী শব্দমালা। পরে মিলন আহমদ দু-পক্ষকে এবিষয়ে বাড়াবাড়ি না করে ফেইসবুক থেকে সবকিছু ডিলিট করতে বলেন এবং নেতার কথা কার্যকর হয়।
খ. করোনায় আক্রান্ত হয়ে ব্রিটেনের একজন সংগঠক মারা গেছেন। মর্মান্তিক এই সংবাদটিও ফেইসবুকে যথারীতি প্রকাশ পেয়েছে। ইউরোপের একটি দেশে থাকেন ভদ্রলোকের ফুফাতো ভাই রাকিব ইসলাম (ছন্মনাম) ।বয়সে তরুণ রাকিব ইসলাম সে দেশে নিজ অঞ্চলের প্রবাসীদের নিয়ে গঠিত সামাজিক সংগঠনের একটি সাংগঠনিক পদে আছেন। যেহেতু সংগঠন করেন, তারও অনুসারী বা বলয় আছে। রাকিব ইসলাম তার আস্থাভাজন একজন সাংগঠনিক সদস্যকে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিতে বলেন।‘
অতি উৎসাহী এই ভাইটি লিখলো- ‘করোনায় প্রাণ নিল প্রিয়ভাইর ফুফাতো ভাইর প্রাণ।’ সাথে ‘আমরা শোকাহত‘ একটি পিকসেল পোষ্টারের সাথে রাকিব ইসলামের একটি ছবি সংযুক্ত করে- ফেইসবুকে নিজের ওয়ালে সেটে দিয়ে ট্যাগ দিল – বন্ধু তালিকায় থাকা প্রায় অর্ধশতাধিক বন্ধুকে ।
ইউরোপে গভীর রাতে পোস্ট করে হয়তো ঘুমিয়েছেন রাকিবের বন্ধু। এদিকে এনিয়ে বাংলাদেশে ঘটে যায় অঘটন; রাকিব ইসলামের ছোটভাই ফেইসবুক পোস্ট দেখে পরিবারের সবাইকে দেখায়। ভাই’র ছবি দেখে ভালো করে শেষের শব্দটি [ফুফাতো ভাই’র’] কেউ পড়েনি হয়তো। সাথে সাথে সকলে চিৎকার করে কেদে উঠেন- ফুফাতো ভাই নয়, তাদের ভাই’র মৃত্যু হয়েছে ভেবে। মা চেতনা হারান। পরে ডাক্তার জানালো -রাকিব ইসলামের মা স্ট্রোক করেছেন। এখন থেকে বাকী জীবন সাবধানে, ঔষধকে সঙ্গী করে, মেপে মেপে চলতে হবে।
গ. স্বাস্থ্যকর্মী আশা খান (ছন্মনাম) সেলফ আইসোলেশনে ছিলেন। কাজে তার সহকর্মীর করোনা পজিটিভ হওয়াতে কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই প্রতিষ্ঠান তাকে ছুটি দিয়ে হোম আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়েছে। কেউ একজন বলেছে, তার করোনা হয়েছে এবং আশ্চর্য হয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, এই খবরটি তার বাচ্চার ক্লাসের মা’রা জেনে গেছেন । কারণ আশা খানের মেয়ের ক্লাসের কয়েকজন মা- অভিবাবক তাকে ফোন করে তার অসুস্থতার খবর নিচ্ছিলেন! ‘হোম আইসোলেসনে‘ থাকা মানে ‘করোনায় আক্রান্ত না’ এই বিষয়টি তিনি তাদের ফোনে জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে, একদিন স্কুল থেকে কর্তৃপক্ষ ফোন করে তার ও মেয়ের স্বাস্থ্যের খবর বিনয়ে জানতে চাইল। কয়েকদিন পরে,স্কুলের নিয়মিত ওয়ান- টু- ওয়ান মিটিং এ তিনি জানলেন- তার মেয়ের ক্লাসের এক শিক্ষার্থীর ( শিশু) সর্দি- জ্বর দেখা দিলে, তার মা স্কুলে এসে আশা খান এর নামে কমপ্লেইন করে গেছেন যে, তার মেয়ের মাধ্যমে তাদের মেয়ের শরীরে করোনা ছড়িয়েছে। তারা অভিযোগ করেছেন, কেন আশা তার মেয়েকে স্কুলে পাঠালেন।
ওয়ান- টু -ওয়ান মিটিং এ স্কুল কর্তৃপক্ষ আরও জানালেন, পরে ঐ অভিভাবক স্কুল কর্তৃপক্ষ কে জানিয়েছেন যে, জিপি বলেছে, ‘ তার মেয়ের শীতকালীন সর্দি হয়েছে।এটা করোনার সিমটম নয়’। স্কুল কর্তৃপক্ষ ব্রিটেনের ডাটা প্রটেকশন এ্যাক্ট ও কনফিডেনশিয়ালিটি পলিসি শতভাগ নিশ্চিত করেই আশা খানকে এই বিষয়টি বলেছেন, যাতে করে তিনি এনিয়ে আর দূ:খ বোধ না করেন। এবং ঐ শিশুর মা-ও তাকে সরি বলেছেন বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
তবে দূ:খজনক ঘটনা হলো- আশা খান করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন- এই ‘মিথ্যা তথ্য’টি কিভাবে যেন ইংল্যান্ডে বসবাস করা তার আত্নীয়রা জেনে যান। আসে বাংলাদেশ থেকে ফোনও। এরই মধ্যে জানতে পারেন, তার বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একমাত্র মেয়ে করোনা আক্রান্ত, ‘ভুয়া সংবাদ’টি তার নিখাদ স্নেহ- ভালোবাসার কাছে হয়তো পরাজিত হয়েছে। আশা খান জানলেন, আগে একবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া তার প্রিয় বাবা মেয়ের করোনা আক্রান্তের খবর শুনে শ্বাসকষ্ট ও শরীর অবচেতন যাওয়াতে তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
ফেইসবুক নিউজ ফিড ভাসছে ডাক্তার, তথ্য ফেরিওয়ালায়….
করোনার তৃতীয় ফেইজে ভয়ংকরভাবে কোভিড-১৯ হানা দিয়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার লকডাউন সহ কঠোর বিধি নিষেধ আলোপ করেছে। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা কে যদি বরিস জনসন শুরুতেই আমলে নিতেন, হয়তো, ব্রিটেনবাসী বর্তমান এই করুণ পরিস্থিতির সম্মুখী না হতেও পারতো।
অবাধ তথ্য প্রবাহের এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে যেন বিশেষজ্ঞ হয়ে আছেন। ঘুম থেকে উঠে অথবা ঘুমাতে যাবার আগে বোধকরি এই বিশেষজ্ঞদের যেন অবশ্যই করণীয় একটি কাজ করতেই হবে, তা হলো- ‘আজ ব্রিটেনে সর্বমোট কতজন লোক আক্রান্ত হলেন’, ’কতজন লোক মারা গেলেন,’ কোন হাসপাতালে রোগীদের স্থান সংকুলান হচ্ছেনা,’ ‘আগামীকাল আরও কত ভয়ন্কর অবস্থা হতে পারে’ ইত্যাদি। অথবা হাসপাতালে দাড়ানো এম্বুলেন্স বা হৃদয় বিদারক কোন ফরওয়ার্ডেড ভিডিও নিজের ওয়ালেন সেটে দেয়া। অথচ এইসব সংবাদ, পরিসংখ্যান ব্রিটেনের প্রায় প্রতিটি পরিবার, বিশেষকরে টিভিতে বা অনলাইন পোর্টাল ,সংবাদপত্রে দেখছেন, পড়ছেন।
হলফ করে বলতে পারি, যারা এই কাজটি করছেন, তাদের পরিবারে শিশু অথবা প্রবীণরা আছেন।তাদের অসংখ্য স্বজন প্রতিবেশী আছেন। এদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করেন বলে মোটাদাগে ধারণা করা যায়।
একবার কী আমরা ভাবছি- প্রতিদিন নিজের অজান্তে পরিবারের শিশু অথবা প্রবীণদের মনে এই নেতিবাচক চর্চার মাধ্যমে প্রকারান্তে তাদের মনে কত বড় আতংক, মৃত্যুভয়ের পাহাড় গড়ে দিচ্ছি।
অসংখ্যজন আছেন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের খবর শুনে ঐ ব্যক্তির সাথে যুক্ত নিজের যে কোন ছবি খুজে বের করে( অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো গ্রুপ ছবিতে আক্রান্ত বন্ধু-স্বজনদের গায়ে মার্ক দিয়ে) নিজের মানবিক হৃদয়ের প্রকাশ করছি।
রোগ, শোকে- প্রার্থনায় মানুষের পাশে থাকার বিষয়টি ইসলাম ধর্মে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ আছে। আমার বিশ্বাস সকল ধর্মেও প্রার্থনার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ আছে। একজন অসুস্থ, বিশেষ করে মহামারী সময়ে তার জন্য দোয়া চাওয়াটা অত্যন্ত ভালো মানবিক কাজ।
মোটাদাগে উচ্চারিত প্রশ্ন হলো-আমরা কী সঠিক এবং প্রাসঙ্গিক তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ করছি। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে যাওয়া রোগীর ছবি প্রকাশে তার পরিবার কী আমাদের কে অনুমতি দিয়েছে? হৃদয়বিদারক দৃশ্যের ভিডিওগুলো যাকে দিচ্ছি তার কী উপকারে আসছে, মধ্যরাতে যাকে অথবা গ্রুপে পাঠাচ্ছি তারা ভিডিওটি দেখে, কী স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারবে- এসব বিষয় ফরওয়ার্ডের আগে আমি কী ভাবছি!
ঘটনাটি করোনা মহামারীর প্রথম দিকের….
লন্ডনে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সামাজিক ও সাংগঠনিকভাবে সুপরিচিত কফিল উদ্দিন (ছন্মনাম) করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হোন। অবস্থার অবনতি হলে, তাকে বিশেষ নিবিড় পরিচর্চা ক্যাবিনে স্থানান্তরিত করা হয়। তার ডাক্তার মেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসারত বাবার একটি ছবি ( বিশেষ অনুরোধে, বাবার সাথে সাংগঠনিক কাজে ঘনিষ্ট কয়েকজনকে) শর্তসাপেক্ষে শুধু দেখার জন্য শেয়ার করেছিলেন। মেয়ের বিনীত অনুরোধ ছিল- মেডিক্যাল ইক্যুপমেন্ট লাগানো অবস্থায় তার বাবার ছবিটি যেন অন্য কারো কাছে না যায়। কিন্তু ‘পাবলিসিটি লোভাতুর’ কোন একজন ফেইসবুকে এই ছবিটি প্রকাশ করে দেন। আর সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে জনে জনে- বহুজনের ফেইসবুক ওয়ালে ।
প্রতিটি পোস্টের কমেন্টসে সহানুভূতির বাক্য যে পড়েনি- তা নয়।মানুষ ভালোবেসে দোয়াও যে করেননি তাও নয়। বাস্তবতা হলো- বিশেষ নিবিড় পরিচর্চা ক্যাবিনে থাকা সামাজিক ব্যক্তিত্বের স্ত্রী মারাত্নক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন- স্বজন, পরিজন,বিশিষ্টজনের প্যানিক ফোন কলে। সহানুভূতির প্রায় প্রতিটি ফোন কলে কোন না কোনভাবে উঠে এসেছে তার এই ছবি বা এর পরবর্তি সময়ের প্রসঙ্গ।
বাঙালিদের মধ্যে অনেকে আছেন- দূ:খের গল্প জাবরকাটার মতো শুনতে চায় এবং গল্পকারও সিরিয়াসভাবে উপভোগের মানষিকতা নিয়ে দূ:খমাখা কথাগুলো বলতে ভালোবাসেন।রোগ-শোকের সংবাদ বিবরণে পজিটিভ বা উজ্জিবীত হওয়ার মতো কথামালা থাকে খুব কম। বিশ্বস্তভাবে জানি, বাবার মৃত্যুর অনেকদিন পর পর্যন্ত ঐ পরিবারকে এই ইনসিডেন্ট অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়েছে।
পরিবারে তো শিশু,প্রবীণরাও থাকেন
লকডাউনে বাসায় বসে টিভি ও মোঠফোনে অনেক বড় একটি সময় কাটছে ব্রিটেনবাসীর। টিভি রিমোট বেশীরভাগ সময়ে খবরে নিবন্ধিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতি ঘন্টার সংবাদে করোনা মহামারী সম্পর্কিত দু:খের সংবাদ আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে এবং এই সময়ে- এটাই প্রধান সংবাদ। যদিও ব্রিটিশ গণমাধ্যম সতর্কতার সাথে সামগ্রিকভাবে নিউজ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচার করছে। যাতে করে দর্শক মানষিকভাবে বিপর্যস্ত না হয়।
শিশু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানাচ্ছেন- এই ক্রান্তিকালে বাসায় শিশু ও বয়স্কদের সামনে সব সময় অনুপ্রেরণাদায়ী এবং পজিটিভ চিন্তার এক্টিভিটি ও কথাবার্তা বলতে। যাতে তাদের সাথে কাটানো সময়টা যেন আগের চেয়ে অনেক বেশী সেবাধর্মী হয়।
অথচ বাস্তবতা বলছে- বেশীরভাগ সময়, অনেকে, প্রবীণ ও শিশুদের সামনে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে কতজন মারা গেল, কতজন আক্রান্ত হলো, মোট মৃতের সংখ্যা কত ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছি।
একজন প্রবীণ বা শিশু, একজন যুবক বা সবল মানুষের চেয়ে অনেক দুর্বল- এটা যখন আমাদের মাথায় আসে। তাহলে, তাদের পক্ষে এসব ‘মানষিক চিন্তা ধারণ এবং বহন‘ করে চলা যে কত কঠিন এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর- সেই সহজ হিসাবটি নিজে কেন মেনে চলছিনা।
এই ঘটনাটি একজন মানবিকবোধ সম্পন্ন নিকট আত্নীয়ের মুখে শুনা….
লন্ডনবাসী লিলি বেগম (ছন্মনাম) একজন গৃহিণী। প্রতিদিন সকালে উঠেই তার যেন একটি-ই কাজ- আত্নীয়-স্বজনদের বাসায় ফোন করে খবরা-খবর নেয়া। ভালো-মন্দ খবর কয়েক বাক্যে শেষ হলেও লিলি বেগম ব্যতিক্রম। বিগত দিনে করোনায় তার চেনা- জানা কে কে আক্রান্ত হয়েছেন, কারা হাসপাতালে আছেন, কে ঘরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ইত্যাদি পর চর্চায় তার সময় কাটে বলে তার স্বজনরা বলে থাকেন। এরই মধ্যে লিলি বেগম’র মায়ের করোনা পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। পরের দিন লিলি বেগম শশুরবাড়ীর ঐ পরিবারে ফোন দিয়ে মায়ের অসুস্থতার খবর জানান এবং জানতে পারেন তাদের পরিবারের প্রবীণ সদস্যও করোনা পজিটিভ।
লিলি বেগম এইসময় অনুরোধ করেন , তার মা হার্টের রোগী, বেয়াইনের অসুস্থতার খবর শুনলে মানষিকভাবে আরও ভেঙ্গে পড়বেন।তাই কেউ যেন তার মাকে অসুস্থতার খবরটি না জানায়।
কথাটি শুনে যেন বেটে-বলে পেয়ে যান ছেলের বৌ। বলেন, ‘ভাবি, আপনি-ই তো ফোন করে প্রতিদিন আমাদের বৃদ্ধ মা কে এই সকল সংবাদ জানান। আপনার ফোনে তো সারা লন্ডনের বাংলাদেশীদের খবর থাকে।’
ঝগড়াটি সঙ্গত কারণে এখানে শেষ হয়নি। রাগ-বিরাগে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। অভিযোগের তীরটি লিলি বেগমের উপরই বিধে।
মাল্টিকালচারাল ব্রিটেনে ‘সরি’ ও ’থ্যাংক য়্যু’র ঐতিহ্যগত চর্চার আলোকিত দিকটি বলতে গেলে সারা দুনিয়া জানে।অবশেষে দুই পরিবারে স্বামীদের হস্তক্ষেপে ‘সরি’ ও ’থ্যাংক য়্যু’র মাধ্যমে শেষ হয়।
আলোর খবরও আছে
লকডাউনে ব্রিটেনের প্রতিটি পরিবারের শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে অনলাইনে তাদের ক্লাস করছে। এবং বাকী সময় তারা পরিবারের মধ্যেই থাকছে।
প্রচন্ড কর্ম ব্যস্ততায় পারিবারিকভাবে সকলে এক সাথে বসে প্রতিদিন কথা বলা ও খাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠে না। করোনা সময়ে সন্তানরা তাদের মা-বাবাকে কাছে পাচ্ছে। বাবা-মা সন্তানদের সান্নিধ্যে থেকে তাদের সাথে নানা বিষয় শেয়ার করতে পারছেন।অনেকে সন্তানদের পছন্দের খাবার তৈরী করেও খাওয়াচ্ছেন। মহামারী থেকে মুক্তির জন্য পরিবারে সম্মিলিত প্রার্থনা করছেন অনেকে। সব মিলিয়ে পারিবারিক মেল বন্দনের সুযোগটিকে সংখ্যাঘরিষ্ট বাংলাদেশীরা পজিটিভভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। দেশে এবং স্থানীয় কমিউনিটিতে নানাভাবে চ্যারিটেবল কাজ করছেন এই করোনা মহামারী সময়ে এরকম অসংখ্য পরিবার কমিউনিটিতে উদাহরণ হয়ে আছেন।
লকডাউনে ডমেষ্টিক ভায়লেন্স যে বৃদ্ধি পায়নি তা নয়। কিন্ত বাঙালির চিয়াতর পারিবারিক ঐতিহ্য- সংস্কৃতি চর্চার সুযোগটি যারা পজিটিভভাবে ব্যবহার করছেন তাদের কে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
দূ:খ ও শোক কে পরাজিত করতে প্রত্যয়ী মন ও ভালো কাজের চর্চার বিকল্প নেই- করোনাকাল অন্তত তাই বলছে।
সাতাইশ জানুয়ারী দুই হাজার একুশ, লন্ডন।
আ নো য়া রু ল ই স লা ম অ ভি : কবি , সাংবাদিক
আরও পড়ুন