শিক্ষক মো. সাহাব উদ্দিন সবার কাছে ‘সাহাব স্যার’ নামে পরিচিত। সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার বাগন গ্রামে ১৯৬২ সালের ৭ জানুয়ারী এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ছোটদেশ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু বিদ্যালয়টি বাড়ি থেকে প্রায় ৩ কি.মি দূরে থাকায় একা যাওয়া আসার অসুবিধা থাকায় প্রথম শ্রেণিতে পড়াশুনা শেষ করে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি ।
পরবর্তীকালে বাগন, ফেনগ্রাম ও চন্দগ্রামের অধিবাসীরা মিলে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৯ সালে ফেনগ্রাম-চন্দগ্রাম-বাগন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর বাবার সিদ্ধান্তে চাচাতো ভাই রফিক উদ্দিন (কটন) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করার জন্য স্কুলে নিয়ে যান। কিন্তু স্কুলে গিয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি না করে ২য় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন তিনি । বাবা কৃষক, মা গৃহিণী , স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা শুনে পাশের বাড়ির চাচা বাবাকে কটাক্ষ করে বলেন, ছেলেকে স্কুলে পড়ানোর শখে ধরেছে কিন্ত ছেলেকে কি তুমি পারবে একটি প্যান্ট কিনে দিতে ? তখন-ই মনস্থির করেন লেখাপড়া করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে বাবার মাথা উঁচু করবেন তিনি ।
১৯৭৩ সালে পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯৭৮ সালে মানবিক বিভাগ থেকে তৃতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করেন তিনি । উল্লেখ্য ১৯৭৭ সালে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় টাইফয়েড জ্বরে দীর্ঘ ২ মাস অসুস্থ থাকায় তার পড়ালেখা তখন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ।
স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস ক্যাপ্টেন ও দশম শ্রেণীতে স্কুল ক্যাপ্টেন এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি ।
১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে বিয়ানীবাজার ডিগ্রি কলেজে (বর্তমান সরকারী কলেজ) একাদশ শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৮০ সালে এইচএসসি পাস করেন ।একই কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষার সেন্টার সিলেটের মদন মোহন কলেজে তিন বন্ধু একসাথে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সিলেটের হাসান মার্কেটের পাশের মার্কেটে ইসলামীয়া বোডিং থেকে প্রথমদিন ইংরেজি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় বিকালে রুমে এসে বন্ধু মুজিব-এর পরামর্শে পরদিন আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি তিন বন্ধু।পরবর্তীতে আবার পরীক্ষা দেন কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেন নি।
স্কুল জীবনে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে স্কাউটিংয়ে ভালো অভিজ্ঞতা থাকায় ১৯৮১ সালে সরকারী-বেসরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে সরকার কর্তৃক স্কাউটিং কার্যক্রম চালু হওয়ায় জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ের ততকালীন প্রধান শিক্ষক মরহুম আজির উদ্দিন স্যারের মাধ্যমে ৪ এপ্রিল ১৯৮১ সালে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কাউট শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন ।
১৯৮৫ সালে শ্রী দ্বারকেশ চন্দ্র নাথ( অবসর প্রাপ্ত অধ্যক্ষ, বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়াকালীন সময়ে একদিন বাড়িতে আসলে এক বিকেলে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের মানিক দা’র হোটেলে বসে চা চক্রের ফাঁকে তার উৎসাহে মো. সাব উদ্দিন রেজিস্ট্রেশনের জন্য কাগজ পত্র জমা দেন । অল্প সময়ে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে দেন দ্বারকেশ চন্দ্র নাথ ।
এরপর ১৯৮৬ সালে ২য় বিভাগে বিএ এবং ১৯৯৫ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আহসানউল্লাহ টি.টি কলেজ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে বিএড পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ।
১৯৯০ সাল থেকে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় ইতিহাস বিষয়ে পরীক্ষক ও সিলেট শিক্ষা বোর্ড চালু হওয়ার পর বাংলা ২য় পত্রের পরীক্ষক হিসেবে মনোনীত হয়ে অদ্যাবধি পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি ।
জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকুরীকালীন সময়ে ২০০১ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলা স্কাউটস এর সম্পাদক এই পদে ২০০১-২০১৪ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন তিনি । ২০০৭ সালে লর্ড বেডেন পাওয়েল অব গিলউয়েল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কাউটসের শত তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২০০৭ সালে ২৭ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত ইংল্যান্ডে ২১ তম বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরীতে অংশ গ্রহন করেন । এবং ২০১৯ সালের ২২ শে জুলাই থেকে ২রা আগস্ট পর্যন্ত আমেরিকার উয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে ২৪ তম বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরীতে বাংলাদেশ স্কাউটস বিয়ানীবাজার উপজেলার একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে International service team(IST) এর সদস্য হয়ে আমেরিকায় অংশগ্রহণ করেন।
২০১৪ সালের আগস্টে জেলা স্কাউটস এর কোষাধ্যক্ষ ও একই সাথে উপজেলা স্কাউটস-এর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে মনোনীত হয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ।২০১৭ সালে বিয়ানীবাজার স্কাউটসের কমিশনার হিসেবে মনোনীত হয়ে অদ্যাবধি উক্ত পদে দায়িত্ব পালন করছেন গুনী এই শিক্ষক ।
শিক্ষক মো. সাব উদ্দিন ১৯৮১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩১ বছর জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয় স্কাউট শিক্ষকের পাশাপাশি ক্রীড়া শিক্ষক ও লাইব্রেরী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন । ২০১১ সালের ১ লা নভেম্বর থেকে ৩১জুলাই ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর দেউলগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ১ লা আগস্ট প্রধান শিক্ষক হিসেবে ঘুঙ্গাদিয়া বড়দেশ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করে অদ্যাবধি কর্মরত আছেন গুনী এই শিক্ষক ।
মানুষ গড়ার কারিগর এ মহান ব্যক্তিত্বের পিতা হাজী মাহমদ আলী ও মাতা কুটিনা বিবি। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
পারিবারিক জীবনে তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। আগামী ২০২২ সালের জানুয়ারী মাসে সুদীর্ঘ প্রায় ৪১ বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষে অবসর গ্রহণ করবেন প্রবীন এই শিক্ষক ।
লেখক : ফয়সল আহমদ ( রুহেল ), সাউথ ইস্ট লন্ডন নিউজ করেসপনডেন্ট;চ্যানেল এস টেলিভিশন ,লন্ডন ।