শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
https://blu-ray.world/ download movies
সর্বশেষ সংবাদ
সাংবাদিক ক্যারলকে গ্লোবাল জালালাবাদ ফ্রান্সের বিশেষ সম্মাননা প্রদান  » «   গ্লোবাল জালালাবাদ এসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক জালালাবাদ উৎসব প্যারিস অনুষ্ঠিত  » «    সাকিব : নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতি  » «   লন্ডনে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী চাটগাঁয়ে মেজবান ৬ অক্টোবর রবিবার  » «   ১১তম মুসলিম চ্যারিটি রান ২০ অক্টোবর ভিক্টোরিয়া পার্কে  » «   ৭৫ শেফ এর অংশগ্রহণে বিসিএর শেফ অব দ্যা ইয়ার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত  » «   ৩০ বছরেও ধরা পড়েনি কোনো আসামী, বিচারের দাবীতে মেয়ের সংবাদ সম্মেলন  » «   ইস্টহ্যান্ডসের ফ্রি স্মার্ট ফোন পেলেন ৪০ জন  » «   সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য পদক ২০২৪’পেলেন কবি, সাহিত্যিক ও সংগঠক ফারুক আহমেদ রনি  » «   টাওয়ার হ্যামলেটসে হোমলেসনেস-এর প্রস্তাবিত নতুন পলিসি সাসপেন্ড করেছেন নির্বাহী মেয়র লুৎফুর  » «   লন্ডনে বিসিএ এ্যাওয়ার্ডস ২৮ অক্টোবর থাকছে নানা চমকপ্রদ আয়োজন  » «   বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৩২নং বাসভবন ভস্মীভূত এবং ভাস্কর্য ভাংচুরের নিন্দা ও প্রতিবাদ  » «    অদ্ভুত দেশপ্রেম ও খাঁটি ব্যক্তিগত স্বার্থ  » «   বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরাবারে বঙ্গবন্ধু লেখক সাংবাদিক ফোরামের স্মারকলিপি প্রদান  » «   দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়  » «  
সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন

সেই ছোট-খাটো মানুষটি



সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

আজ জ্ঞান-তাপস ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ১৩৫তম জন্মবার্ষিকী। জন্ম তাঁর ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটের পেয়ারা গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন কলকাতা ও প্যারিসের সরবন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
ড: শহীদুল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা কিংবদন্তী পর্যায়ের। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী শাসকচক্রের সব রকমের আঘাতের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী প্রতিরোধের পুরোধা ছিলেন ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করে দেয়া কিংবা আরবী হরফে বাংলা লেখার পাকিস্তানী অপপ্রয়াস তাঁর বিরোধিতার কারনে ফলপ্রসূ হতে পারে নি।
ড: শহীদুল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। তাঁর জীবনীও লভ্য নানান জায়গায়। সে নিয়ে কথা বলাও বাহুল্য মাত্র। তার চেয়ে আজ ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনের তিনটে মজার ঘটনা বলি – তার প্রথম দু’টো পড়া আর তৃতীয়টি শোনা।
বোধকরি ১৯২৫-২৬ সালের কথা – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরের কথা। স্যার ফিলিপস জে হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার, আইনজ্ঞ অধ্যাপক নরেশ সেনগুপ্ত, ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অলঙ্কৃত করে আছেন। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার তখন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত।
একদিন আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। পথে ঘাটে লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের বালক পুত্রটি প্রাধ্যক্ষ ভবনের একতলার জানালার আলসে্তে বসে বাইরের বৃষ্টি দেখছে। হঠাৎ সে মহা উত্তেজিত হয়ে রসুইঘরে রন্ধনরত তার মা’কে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘মা, মা, দেখে যাও, রাস্তা দিয়ে একটা ছাতা হেঁটে যাচ্ছে। আসলে প্রাধ্যক্ষের ভবনের সামনে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। মানুষটি খর্বকায় এবং জোর বৃষ্টির কারনে তিনি বেশ বড় একটি ছাতা নিয়েছিলেন। দূর থেকে দেখলে অবশ্য মনে হবে যে একটি ছাতাই পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে।
ষাট দশকের কোন এক সময়ের কথা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান আইয়ুব খান বিদেশ সফররত এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাজ করছেন তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার ফজলুল কাদের চৌধুরী। প্রস্তাবিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত কোন কাজে তিনি ঢাকায়। কোন একটি অনুষ্ঠান শুরুর আগে পেছনে বিশেষ অতিথিদের কক্ষে অপেক্ষা করছেন ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও ফজলুল কাদের চৌধুরী।
হঠাৎ করে অস্হায়ী ছদরে পাকিস্তানের মনে হল, সঙ্গের অতিথির সাথে কিছু সৌজন্য দেখানো আবশ্যক। সেটা ভেবে ধূমপানরত চৌধুরী পকেট থেকে সিগারেটের বাক্স এগিয়ে দিলেন। ড: শহীদুল্লাহ নাক কুঁচকে বললেন, ‘আমি সিগারেট খাই না’। চৌধুরীর হঠাৎ মনে পড়ল তার সঙ্গের মানুষটি শিল্প-সাহিত্যের লোক। ঢাকায় তখন ‘চান্দা’ ছবিটির রমরমা। অস্হায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ড: শহীদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি চান্দা সিনেমা দেখেছেন’? একইভাবে নাক কুঁচকে ড: শহীদুল্লাহ জবাব দিলেন, ‘আমি সিনেমা দেখি না’। তারপরে কি ঘটেছিলো, সে সম্পর্কে শহীদুল্লাহ-পুরাণ নীরব।
১৯৭৫ সালের শেষদিকের কথা। আমাদের এম.এ. পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে, ফল বের হয় নি। তার আগেই আমাকে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমার দিনের অনেকটা সময়ই কাটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রণ্হাগারে শিক্ষকদের জন্যে রক্ষিত ছোট ছোট পাঠ খুপরিতে। গ্রন্হাগারের বহু পুরাতন কর্মী জয়নাল ভাই মাঝে মধ্যেই টহল দিয়ে যান, এটা সেটা কথা হয়ে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ভাঙ্গা ডাঁটির চশমা আর মুখভর্তি পান চিবানোর এ মানুষটিকে আমার ভালো লাগে।
নানান গল্প করেন তিনি। আগের কালের শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের কালের শিক্ষকদের তুলনামূলক আলোচনা করেন তিনি। একদিন উঠল ড: শহীদুল্লাহ প্রসঙ্গ এবং সেদিনই গল্পটি করলেন তিনি। পঞ্চাশ দশকের কেন এক সময়। জয়নাল ভাই তখন গ্রণ্হাগারের তরুন কর্মী। তাঁর মূল দায়িত্ব হচ্ছে রাতে গ্রণ্হাগার বন্ধ হওয়ার সময় হলে সবকিছু দেখে শুনে, সব বাতি নিভিয়ে গ্রণ্হাগারে তালা দিয়ে দেওয়া।
শীতকালের সময় সেটা। এক রাতে প্রচন্ড শীত পড়েছে। বেশ তাড়াহুড়ো করে সবকিছু বন্ধ করে জয়নাল ভাই রাস্তায় নামলেন। চাদর-নাফলার দিয়ে নিজেকে বেশ ভালো করে ঢেকে পা চালালেন তিনি। কিছুদূর যাওয়ার পরে মনে হল, তাঁর টাকার ব্যাগ ফলে এসেছেন তিনি তাঁর দেরাজে। অতএব, ফিরতে হল তাঁকে গ্রণ্হাগার ভবনে। সেখানে এসে তাঁর মনে হল যে দোতলার ছোট একটি ঘরে যেন বাতি জ্বলছে।একটু ধন্ধে পড়ে গেলেন তিনি – তবে কি সব বাতি তিনি নেভান নি। দেতলায় উঠে দেখলেন, যে ছোট্ট পাঠ-কুঠুরীতে বাতি জ্বলছে, সেটা ড: শহীদুল্লাহর ব্যক্তিগত পাঠকক্ষ।
জ্ঞানতাপস ড: শহীদুল্লাহ গভীরভাবে মগ্ন তাঁর জ্ঞানচর্চ্চায়। কখন গ্রণ্হাগারের সময়সীমা শেষ হয়েছে, কখন সব বাতি নিভে গেছে, কখন অন্য সবাই চলে গেছেন – কেন কিছুই খেয়াল নেই তাঁর। বিশ্ব চরাচর তাঁর কাছে লুপ্ত হয়ে গেছে। এ ঘটনাটি যখন তিনি বলছিলেন, তখন জয়নাল ভাইয়ের চোখে জলধারা নেমেছিল। সেই সব শিক্ষকেরা আইজ কই?’, আর্ত শুনিয়েছিল জয়নাল ভাইয়ের ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর।
শেষের কথা বলি। আমরা যখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র, তখন আমাদের বাংলা পাঠ্যবইতে ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি প্রবন্ধ ছিল – ‘ভবিষ্যতের মানুষ’। প্রযুক্তির যুগান্তকারী উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের মানুষের অবয়ব, তার আকার-প্রকৃতি, আচার-আচরন কেমন করে বদলে যাবে, তার একটি সরস বর্ণনা। রচনাটির সবকথা মনে নেই। তবে একটি লাইন মনে আছ, ‘ভবিষ্যতের মানুষের শুধু একটি আঙ্গুল থাকবে, বোতাম টেপার জন্যে’।এখন যখন এক আঙ্গুল দিয়ে মুঠোফোনে এ লেখাটি লিখছি, তখন মনে হচ্ছে এর চেয়ে অমোঘ বাণী আর হতে পারে না। ক্ষণজন্মা ড: শহীদুল্লাহর মতো মানুষেরা ভবিষ্যত দ্রষ্টাও তো বটেন!
ছবি: প্রথমটি ড: শহীদুল্লাহ প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি.লিট. করার কালে; দ্বিতীয়টি ষাটের দশকে ঢাকায় এক সাহিত্য সভায় পৌরহিত্য করছেন ড: শহীদুল্লাহ।
সেলিম জাহান : অর্থনীতিবিদ ও লেখক

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

"এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব " -সম্পাদক