ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। শত শত বছর পরও মানুষের দ্রোহের আগুনে পাথর পানিতে মিশে গেছে। কিন্তু আধুনিকায়নের এই সভ্যতায় এখন শত শত বছরের জন্য অপেক্ষায় থাকবে না মানুষ। আমেরিকা-ব্রিটেন বর্ণের পরিচয়ে মৃত্যু কম হয়নি। ব্রিটেনে বর্ণ পরিচয়ে কিশোরও নিহত হয়েছে, ঢাকা পড়েছে সেই হত্যাকাণ্ডও। কিন্তু হঠাৎ করেই একজন কালো জর্জ ফ্লয়েড মরে গিয়ে এক অদ্ভুত মন্ত্র দিয়ে গেলেন সারা মানব জাতিকে। সেই মন্ত্রে তিনি পাল্টে দিলেন বিশ্ব। এভাবেই জেগে উঠে মানুষ। ভাঙে শৃঙ্খল। দ্রোহের কাছে নত হয় রাষ্ট্র, মানুষের মানবিক আহ্বান জঙ্গিরূপ নিলে এই স্রোতে এভাবেই আকাশছোঁয়া দাপটের মূর্তিগুলো ভাঙতে থাকে, ডুবতে থাকে, পাথর-মানবগুলোর সলিল সমাধি হয়।
হঠাৎ করেই পাল্টে যেতে পারে সমাজ। রাষ্ট্র থমকে যেতে পারে। কিংবা বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠতে পারে একটা দেশ। এই বিদ্রোহের ঢেউ প্রবাহিত হতেই থাকে দেশ থেকে দেশান্তরে। এই করোনাকাল শত বছর আগের স্পেনিশ ফ্লু আর মৃত্যুর হিমশীতলতা মনে করিয়ে দিয়েছে। মানবজাতির অসহায়ত্বের বিষদৃশ্য চারদিকে। অদৃশ্য হাওয়ার ঝাঁঝে মরছে মানুষ, বাঁচার আকুতি নিয়ে লড়ছে মানুষ প্রাণপণ। অর্থ-বিত্ত-বৈভব-প্রভাব-প্রতিপত্তি-মস্তানি সবকিছুই যেন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বিজ্ঞানী-চিকিৎসকরা মানবজাতিকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টায় রত। সংশয়-সংকট-আতঙ্ক চারদিক যেন গ্রাস করছে পৃথিবীর একপ্রান্তে, অন্যপ্রান্তে অন্ধকার টানেলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে আলোর তীক্ষ্ম রশ্মি।
আমরা বলে থাকি সভ্যতা বিকশিত হয়েছে, ইউরোপ-ব্রিটেন-আমেরিকায় পৃথিবীর দেশে দেশে সভ্যতার জয়গান। মানুষ বেঁচে আছে। শ্রমিক তারা শ্রমের মূল্য পাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে যারা অভিবাসী হচ্ছে, তাদের শ্রমে-ঘামে পরের প্রজন্ম এ দেশগুলোতে খুঁটি গেড়েছে। শিক্ষায়-চাকরিতে-অর্থে-বিত্তে আছে শান। কিন্তু তারপরও এরা আমরা সবাই একটা ঘোরের মাঝেই কাটাই সময়। পুঁজির বিকাশ, বাজার অর্থনীতির দ্বার খোলা দুনিয়ায় পথে-প্রান্তরে আমরা হাঁটি, জীবনের জলুসের কাছে অনেক সময়ই আমাদের জাতিগত অসম্মানবোধের জায়গাটুকুর ধারও ধারি না। এভাবেই পেরোয় সময়। যায় বছর শত শত বছর।
আমরা কলম্বাসের আবিষ্কার দেখি আমেরিকায়। ইতিহাসের পাঠ নেই সেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে। সেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় এরাই মহৎ, এরাই যুগের স্রষ্টা। কলম্বাস, যাকে আমরা আজকের আমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে বিবেচনা করি, তিনি ছিলেন দাস ব্যবসায়ী, গণহত্যাকারী, এমনকি আমেরিকার আবিষ্কারকও নন। সত্যি কথা হলো, একজন দাসই এর আবিষ্কারক, অথচ মিথ্যে দিয়ে তিনিই রচনা করেছেন পৃথিবীতে একটা ইতিহাস। ইতিহাস একসময় ফিরে আসে, আসল সত্য উদঘাটিত করে। শুধুই অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় হয়তো।
সেই ইউরোপীয় পর্যটক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্য ভেঙে আগুনে পুড়িয়ে, লেকে ছুড়ে মেরেছে বর্ণবাদবিরোধীরা। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড শহরের বিয়র্ড পার্কে স্থাপন করা ছিল কলম্বাসের মূর্তিটি। তার স্তম্ভে লিখে দেয়া হয়েছে এখন ‘কলম্বাস দাস ব্যবসায়ী, গণহত্যাকারী! ইতিহাস মুছে দেয়া যায় না! ইতিহাস ভোলা যায় না!’ কিংবা আব্রাহাম লিংকন, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে যার গেটিসবার্গের মানবিক বক্তৃতা এখনো পৃথিবীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিংবা গণতন্ত্রকামী মানুষদের উদ্দীপ্ত করে ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’র সেই মানুষটিও আজ প্রশ্নবিদ্ধ, অপসারিত হচ্ছে তার মূর্তি। আব্রাহাম লিংকনের মূর্তিও বস্টন থেকে উঠে যাচ্ছে, কারণ তিনিও দাসদের নিয়ে ওই রাজনীতির নোংরামিটাই করেছেন।
আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড যে ঝড় তুললেন, সে ঝড় যেন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সারা বিশ্বকে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ঢেউটি ধাক্কা দিয়েছে ব্রিটেনেও। মনে হচ্ছে আমেরিকার চেয়ে এ ধাক্কাটা ব্রিটেনে যেন আরো অধিক।
ব্রিস্টলে কলস্টনের মূর্তিটি থেকেছে মাথা উঁচু করে শত শত বছর। যে কলস্টন সেই ১৬ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে সে সময়ের কৃষ্ণাঙ্গদের উৎপীড়ন আর নির্যাতন করে কিংবা কালোদের ধমনির শিরায় শিরায় বয়ে যাওয়া লাল রক্তের ওপর দিয়ে বানিয়েছিলেন তার ভাগ্য, গড়েছিলেন সম্পদের পাহাড়। এডওয়ার্ড কলস্টন ছিলেন রয়াল আফ্রিকান কোম্পানির একজন কর্মকর্তা। তখন ব্রিটেনে দাস ব্যবসার একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল এই কোম্পানির হাতে। ১৬৮৯ সালে কলস্টন এই কোম্পানির ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন। দাস ব্যবসার মতো অমানবিক নৃশংসতার মধ্য দিয়েই তিনি তাকে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটেনের বিশাল সম্পদে ভরপুর মানুষ হিসেবে। সেই দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এডওয়ার্ড কলস্টনের স্মৃতিকে জাগরুক রাখতে ব্রিস্টল শহরে কয়েক শতাব্দী ধরে তাকে সম্মানিত করা হয়েছে তাকে। ব্রিস্টলে শোভা পাচ্ছিল তার মূর্তি। শোভা পাচ্ছিল বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের ডকল্যান্ডে আরেকটি মূর্তি। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের প্রতিবাদী জোয়ারে লন্ডনের ডকল্যান্ড মিউজিয়ামের সামনে স্থাপিত রবার্ট মিলিগানের মূর্তিটি কাউন্সিলের উদ্যোগেই উচ্ছেদ করা হয়। দাসদের দিয়ে কাজ করানো, দাস ব্যবসা প্রভৃতি দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার ভাগ্য। তাই জনতার জেগে ওঠা দেখে ব্রিটিশ প্রশাসন শুধু কেঁপে উঠেনি, একশনে নামে। আর সে কারণে এমনকি মূর্তিটি সরানোর সময় মেয়র জন বিগস পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন।
১৮১৩ সালে স্থাপন করা রবার্ট মিলিগানের সেই মূর্তিটি উচ্ছেদ হয়েছে। ভেঙে দেয়া হয়েছে ব্রিস্টলের আইকন হিসেবে খ্যাত কলস্টনের সেই মূর্তি। টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে কলস্টনকে নদীর গর্ভে।পূর্ব লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট লন্ডন থেকে বুধবার দাস ব্যবসায়ী স্যার জন ক্যাসের মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। সেই ১৬ শতকের আফ্রিকান এবং ক্যারিবিয়ান দাস ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ব্রিটেনে শিক্ষা খাতে তার ব্যাপক অবদান থাকলেও সারাদেশে দাস ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জেগে উঠলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই সিদ্ধান্ত নেয়।
শুরু হয়েছে… ভারতকে নিঃস্ব করে ব্রিটেনের ফরচুন গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান মানুষ ক্লাইভও আছেন রোষানলে। ছড়িয়ে পড়ছে এ আগুন লিডস, লিভারপুল, স্কটল্যান্ড ছাড়িয়ে ওয়েলস আয়ারল্যান্ডে। দাস ব্যবসা থেকে শুরু করে নির্যাতন-উৎপীড়ন করে জলুস গড়া, এমনকি যারা এই ব্রিটিশ জাতিকে সমৃদ্ধ করেছেন, তারাও আজ চরমভাবে অপমানিত হচ্ছেন। তাদের স্মৃতিচিহ্নটুকুও রাখতে চাইছে না ব্রিটেনের বর্ণবাদবিরোধী মানুষ। এ এক বিস্ময়কর জেগে ওঠা।
ইতিহাস সকল সত্যই লিখে রাখে। কখনো আড়ালে, কখনো পাতায় পাতায়। সেই ষোলো শতাব্দীতে যা হয়েছে, আজো তো সেই ইতিহাস লেখা হচ্ছে পৃথিবীর দেশে দেশে। কিন্তু নির্মমতার ইতিহাস ধরে রাষ্ট্রের পালন-পোষণে এ সভ্যতার বণিক-লুণ্ঠক রক্তশোষকদের বর্তমান সত্যগুলো অনেক দেশেই জ্বলজ্বল করছে না, যদিও বই কিংবা কাগজের পাতায় পাতায়, কিন্তু দিনে দিনে জমে ওঠা কষ্টের অগণন পাথরগুলোর কথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংখ্যাহীন মানুষগুলো হৃদয়ের গহীনে লিখে রাখছে তাদের সমকালের কথা। দাসত্বের শৃঙ্খল নয়, রাষ্ট্রের শৃঙ্খলে আটকে থাকা কোটি কোটি মানুষের বন্দিত্ব কোনো প্রকোষ্ঠের মাঝে আবদ্ধ নয় এখন। চলছে-চরছে-ফিরছে মানুষ। চকচক করছে অক্ষরগুলো জ্বালের দুনিয়ায়, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে উঠছে হাজারো লাখ লেখকের লেখনীতে, কিন্তু তারপরও যেন অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে কোটি কোটি মানুষের স্পন্দন। স্বৈরতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়া- কলম্বাস, মিলিগান, কলস্টন, জন ক্যাস কিংবা ক্লাইভ এমনকি আব্রাহাম লিংকনদের মূর্তির জায়গা দেয়া হচ্ছে, মরুর প্রান্তরে কিংবা সবুজ জমিনে।
‘তুমি সব মানুষকে কিছুদিনের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পারবে বা কিছু মানুষ সব সময়ের জন্য হয়তো বোকা থেকে যাবে, কিন্তু সবাইকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পারবে না।’ আব্রাহাম লিংকনের উচ্চারিত কথাটি ইতিহাসের অমোঘ সত্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও তাও সত্য যে, তিনিও রেহাই পেলেন না এই সত্য থেকে।
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। শত শত বছর পরও মানুষের দ্রোহের আগুনে পাথর পানিতে মিশে গেছে। কিন্তু আধুনিকায়নের এই সভ্যতায় এখন শত শত বছরের জন্য অপেক্ষায় থাকবে না মানুষ। আমেরিকা-ব্রিটেন বর্ণের পরিচয়ে মৃত্যু কম হয়নি। ব্রিটেনে বর্ণ পরিচয়ে কিশোরও নিহত হয়েছে, ঢাকা পড়েছে সেই হত্যাকাণ্ডও। কিন্তু হঠাৎ করেই একজন কালো জর্জ ফ্লয়েড মরে গিয়ে এক অদ্ভুত মন্ত্র দিয়ে গেলেন সারা মানব জাতিকে। সেই মন্ত্রে তিনি পাল্টে দিলেন বিশ্ব। এভাবেই জেগে উঠে মানুষ। ভাঙে শৃঙ্খল। দ্রোহের কাছে নত হয় রাষ্ট্র, মানুষের মানবিক আহ্বান জঙ্গিরূপ নিলে এই স্রোতে এভাবেই আকাশছোঁয়া দাপটের মূর্তিগুলো ভাঙতে থাকে, ডুবতে থাকে, পাথর-মানবগুলোর সলিল সমাধি হয়।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম