মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ৩০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
https://blu-ray.world/ download movies
সর্বশেষ সংবাদ
সাংবাদিক আব্দুল বাছিত রফির পিতা হাজী মো: আব্দুল হান্নান এর মৃত্যুতে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব নেতৃবৃন্দের শোক  » «   বাংলাদেশে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের সম্পদ সুরক্ষায় অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে  » «   ইস্টহ্যান্ডস চ্যারিটির উদ্যোগে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং কর্মশালায় বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণ  » «   হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের  বিরুদ্ধে নীতিহীন কর্মকান্ডের অভিযোগ  » «   সাংবাদিক ক্যারলকে গ্লোবাল জালালাবাদ ফ্রান্সের বিশেষ সম্মাননা প্রদান  » «   গ্লোবাল জালালাবাদ এসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক জালালাবাদ উৎসব প্যারিস অনুষ্ঠিত  » «    সাকিব : নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতি  » «   লন্ডনে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী চাটগাঁয়ে মেজবান ৬ অক্টোবর রবিবার  » «   ১১তম মুসলিম চ্যারিটি রান ২০ অক্টোবর ভিক্টোরিয়া পার্কে  » «   ৭৫ শেফ এর অংশগ্রহণে বিসিএর শেফ অব দ্যা ইয়ার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত  » «   ৩০ বছরেও ধরা পড়েনি কোনো আসামী, বিচারের দাবীতে মেয়ের সংবাদ সম্মেলন  » «   ইস্টহ্যান্ডসের ফ্রি স্মার্ট ফোন পেলেন ৪০ জন  » «   সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য পদক ২০২৪’পেলেন কবি, সাহিত্যিক ও সংগঠক ফারুক আহমেদ রনি  » «   টাওয়ার হ্যামলেটসে হোমলেসনেস-এর প্রস্তাবিত নতুন পলিসি সাসপেন্ড করেছেন নির্বাহী মেয়র লুৎফুর  » «   লন্ডনে বিসিএ এ্যাওয়ার্ডস ২৮ অক্টোবর থাকছে নানা চমকপ্রদ আয়োজন  » «  
সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন

বাদল দিনে কক্সবাজারে



সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

লোহাগড়া ছেড়ে এসে একটার পর একটা বাঁক পাহাড়ী পথটাকে সর্পিল রুপ দিয়েছে। পথের দুইপাশ জুড়ে টিলায় টিলায় শতবর্ষী গর্জনের বন মাথার ওপর পত্রপল্লবের ডালি সাজিয়ে যেন টুপর পরে আছে। চুনতি অভয়ারণ্য হয়ে যাওয়া এই পথে কক্সবাজার যেতে যেতে পথে নানা জায়গায় চোখে পড়ে গর্জনের এমন উন্নত শির।
কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ড ছেড়ে এসে ঢালু পথ ধরে শহরে প্রবেশ করার সময়ই আমার দুই ভ্রমণ সঙ্গী হৈ হুল্লোড় করে লাফিয়ে ওঠল। ঐ যে সাগর! ফেনিল ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। কাজিন হাসান আর ভাগ্নে আবু বকর এবারকার ভ্রমণসঙ্গী। দু’জন কিছুদিন থেকে আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরেছিল। কক্সবাজার নিয়ে যাব কবে, সেই আব্দার নিয়ে।

সাপ্তাহিক ছুটির সাথে বাড়তি একদিন ছুটির বন্দোবস্ত করে দিলাম ছুট। বর্ষায় যদিও সৈকতের এই শহরে হোটেল মোটেল নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না; তারপরও চেনা জায়গায় আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম সৈকতের পাশের এক রেঁস্তোরায়। পেঠ এমনিতেই চোঁ চোঁ করছিল। তার ওপর পাতের ওপর ধুয়া ওঠা ভাত আর কোরাল মাছের ভুনা দেখে জীবের জল আটকে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ল!

ভোজনপর্ব সেরে এসে খানিকটা বিশ্রামের পর বের হলাম পড়ন্ত বিকেলে। হেঁটে হেঁটে লাবণী সৈকতের বালুকাবেলার সন্নিকটে যেতেই দু’জন দিল ভোঁ-দৌড়! উত্তাল ঢেউয়ের সম্মুহনী সুরলহরীতে পা আমারও চলে দ্রুতলয়ে। সমুদ্রের বিশালতা ছুঁয়ে কুল-কুলান্ত পেরিয়ে সৈকতে আছড়ে পড়ছে উন্মত্ত উর্মিমালা। বড় ঢেউ, বিশাল ঢেউ, ছোট ঢেউ, ঢেউয়ের কত রকমফের! ঢেউ-ই যেন একেকটা ছন্দ। যেন প্রকৃতির সনেট, অমিত্রাক্ষর কবিতা!

ভেজা বালুর ওপর দন্ডায়মান পদযুগলে ঢেউ এসে সঙ্গী করে আনা বালু দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিল। কখনও নিয়ে আসছিল রং বেরংয়ের ছোট ছোট ঝিনুক। এ যেন অনন্য এক অভ্যর্থনা! সবুজাভ উর্মিমালাকে রক্তিম আভায় সাজিয়ে দূর পাথারে সূর্য টুপ করে ডুব দেয়। রং বদলের ছটা পড়ে মেঘদলের গায়েও। খালি পায়ে সৈকত ধরে হাঁটতে থাকি। সৈকতের এদিকটায় মানুষজন কম। বালু তীর পেরিয়ে উজানে ঝাউবনের ঠাস বুনোট। গোধূলীর আলোকছটা প্রতিফলিত হয়েছে সৈকতের ভেজা বালুকাবেলার বুক জুড়ে। এ যেন এক প্রাকৃতিক আয়না।

দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া দেশের ‘সালার দ্য ইউনি’ কে পৃথিবীর আয়না নামে ডাকা হয়। সৈকতের আয়নার মত তকতকে এই বালুকাবেলা যেন তারই এক ক্ষুদে সংস্করণ! যেতে যেতে থামতে হল। ওপরে ঝাউবনের দিক হতে একফালি খালের মত স্রোতধারা  বেলাভূমির অভুঙ্গরতায় ছেদ কেটেছে। দূর সমুদ্রে আলোদের নিভে যাওয়া দেখতে থাকি। বহুদূর থেকে তাঁরার মত জ্বলজ্বল করে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় একটা দু’টা জাহাজবাতি। এর মধ্যে আঁবছা আঁধার ফুঁড়ে একটা জেলে নৌকো এসে উদয় হল। ঢেউয়ে দুলতে দুলতে চলে গেল সমুদ্রের গভীরে।

কক্সবাজারের নামের সাথে অনায়াসে চলে আসে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের নাম। বৃটিশ এই কর্তাবাবু ১৭৯৯ সনে এখানে এসে থিতু হোন। গোড়াপত্তন করেন একটা বাজারের। কালক্রমে সেই বাজারের সাথে কক্স সাহেবের নাম মিলেমিশে হয়ে কক্সবাজার। হারিয়ে যায় তার আদি নাম পালংকী।

পরদিন ঘুম ভাঙল কিছুটা দেরিতে। নাস্তা সেরে তারপর পথ ধরলাম সৈকতের। ওদের যে আর তর সইছে না, তা হাঁটার ভাবভঙ্গিতেই স্পষ্ট! সৈকতে গিয়েই সমুদ্রজলে ঝাপিয়ে পড়ে দু’জন। নোনাজলে ওদের প্রথম স্পর্শ। সেই উচ্ছাস আকুলতা ছুঁয়ে যায় উন্মত্ত ঢেউয়ের জলকণা জুড়ে। লাফিয়ে ওঠা চিতার মত ধেয়ে আসা ঢেউয়ে ওরা ঝাপিয়ে পড়ছে। ভাসিয়ে দিচ্ছে নিজেদের ঢেউয়ের তালে তালে। আমারও আর তর সইল না! কাপড় বদলে ঝাপ দিলাম। শরীরের ইন্দ্রিয় গুলো যেন টাসকি খেল। প্রতিটি লোমকূপ জুড়ে নোনাজলের শিহরণ। ঢেউয়ের  স্রোতে  ভাসিয়ে দিলাম নিজেকে। জলের তরঙ্গ ভেজা কাগজের মত দুলিয়ে দিতে থাকল। নোনাজলের মোহ কাটিয়ে ডাঙায় ফিরে ফ্রেশ হতে গেলাম। ঢেউয়ের সাথে ওদের উচ্ছাস আনন্দ তখনও চলছে।

বেলাভূমি ধরে একা হাঁটতে থাকি। ঝাউবনের একদম পাশে বাঁশ বেত ছন দিয়ে বানানো এক ঘর। গ্রাম্য কুটিরের নান্দনিকতা নির্মাণশৈলীতে। তবে সেখানে কাউকে দেখলাম না। অনতিদূরে বালুর ওপর শেকড় গজিয়েছে কলমির মত এক জাতের লতা। পাতাগুলো কলমিপত্রের তুলনায় পুরো। লতার ফাঁকে ফাঁকে হালকা গোলাপী ফুল। এর নাম সাগর লতা। ইংরেজিতে ডাকা হয় রেলরোড বাইন নামে।

সৈকতের দিকে ফিরে দেখি ঢেউয়ের একদম কিনারে কে যেন একটা ফুটবল রেখে গেছে। এপাশ ওপাশ তাকালাম। বলের দিকে কারো আগ্রহ দেখছি না। ইচ্ছে হল বলের গায়ে কষে একটা কিক দেই! তবে সে আগ্রহে পানি ঢেলে দিয়ে হঠাৎই এক কিশোর কোত্থেকে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় সেটি। নোনাজলের সাথে মল্ল লড়ে অল্পবিস্তর ক্লান্তি পেয়েছে। তাই লাঞ্চের পর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতা কেউ যেন টেনে ধরল।

সন্ধ্যার পর বেরিয়েই চলে গেলাম বার্মিজ মার্কেটে। মনোহারি পণ্যের দোকানগুলো নানা রকম শামুক ঝিনুকের পণ্যে ঝলমল করছে। রঙিন আলো পণ্যের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে টিকরে পড়ছে যেন। মার্কেটের পাশে ডাবওয়ালার ভ্যানগাড়ি। ডাবের পানিতে গলা ভিজিয়ে হোটেলের পথ ধরতেই শুরু হল গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। পরদিনও সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার।

সকাল সকাল হিমছড়ির উদ্দেশ্যে বের হলাম বৃষ্টি মাথায়ই। কলাতলী ছড়া ছেড়ে এসে বায়ে উঁচু খাড়া পাহাড় আর ডানে সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি রেখে মেরিন ড্রাইভ রোড এগিয়েছে। বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। আর সে বৃষ্টিতে ভিজে নেয়ে একেবারে সতেজ সবুজ হয়ে যাওয়া ঘাস তরুলতা। এ যেন বাদলের জলে চপলা কিশোরীর নাহিয়া কুটিকুটি হওয়া।

সৈকতের ঝাউবনের ফাঁকে বোর্ডে কচ্ছপের ছবি দেখে চালককে থাকতে বলি। জায়গাটি সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণ কেন্দ্রের এলাকা। যেতে যেতে সমুদ্র তীর রক্ষার জন্য ফেলা বৃহদাকার বস্তাগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন একদল তিমি, সৈকতে বিশ্রামের জন্য শুয়ে আছে! হিমছড়িতে পৌছার সময় বৃষ্টি থেমে গেছে।

হিমছড়ির পাহাড়ে চড়ার জন্য টিকিট কেটে সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকি। বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে চূঁড়ায় যখন দাড়ালাম, অনুভবের পৃথিবীতে তখন কেবল সুন্দরের আর পুলকের বসতি। গাছপালা, লতাপাতা, বুনোফুলের গা বেয়ে ঝরে পড়া টপটপ বৃষ্টিফোঁটা। চোখে ঝিম ধরানো সবুজ পাহাড়, এর চেয়ে সবুজ যেন আর হয় না! বৃষ্টিতে ঝাপসা উত্তাল ফেনিল সমুদ্র, সে এক ভয়ংকর সুন্দর! চূড়ার মধ্যখানে হিলটপ রিসোর্টের গা ঘেষে গুল্ম-লতা, ফুল ও ঔষধি উদ্ভিদের ছোটখাটো বাগান। সাগরের উল্টোদিকে যতদূর চোখ যায়, দূর থেকে দূরে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাওয়া পাহাড়শ্রেণী। তার পাদদেশ দিয়ে ফিতার মত চলে যাওয়া সুদীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ রোড।

হিমছড়ি ঝর্ণার অবস্থান চূঁড়ার নিচেই। ঝর্ণার হিম ঠান্ডা জল চোখ মুখে লাগতেই শিহরনের যোগাড়। মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে বালুর ঢিবিতে আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঢেউ। সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা হিমেল বাতাসের স্পর্শ চোখে মুখে। সৈকতের পাশে সামুদ্রিক শামুক ঝিনুক দিয়ে বানানো মালা আর ঝাড় বিক্রি করছিল কয়েকজন বালিকা ও কিশোরী। ওদের একজনকে ডাকলাম। ওর নাম হাফছা। ক্লাস সিক্সে পড়ে। সৈকত থেকে ওর ভাই শামুক ঝিনুক সংগ্রহ করে আনে। তাই দিয়ে দুই বোন মিলে মালা তৈরী করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতে নিয়ে আসে। কিছু মালা আর ঝাড় কিনলাম আমরা। মেয়েটি গল্পের ইতি টেনে অন্য ক্রেতার খোঁজে ছুটে গেল।

ফেরার পথে অটোরিক্সা থামিয়ে নামলাম ‘বিশ্রামরত তিমি’ গুলোর ওপর। অদূরে সমুদ্রজলে মাছ ধরছিল কয়েকটা কিশোর ছেলে। ডাকতেই হাসিমুখে কাছে আসলো, ছবির জন্য পোজ দিল। তারপর বাহনে ফিরি, মনের মধ্যে তখন হোটেলের চেকআউট টাইম ধরার তাড়া!
ছবি; লেখক

লেখক : ভ্রমণ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক এবং ব্যাংক কর্মকর্তা

আরও পড়ুন:

সঙ্কটকালের দিনলিপি


সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন