বিশ্বব্যাপী করোনার তাণ্ডব নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই! নিত্যদিন বিশ্বব্যাপী করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাড়ছে ভারতেও। সংক্রমণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। উন্নত, অনুন্নত দেশ বলে কথা নেই। কোবিড-১৯ কাউকে রেয়াত করছে না! সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ থেকে শুরু করে স্বনামধন্য চিকিৎসক, করোনার রোষানল থেকে বাঁচতে পারছেন না কেউই। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত– সকলেই করোনার নেটওয়ার্কের মধ্যেই পড়েন। মাটির কাঁচা ঘরে যেমন করোনার অবাধ প্রবেশাধিকার, তেমনই পঞ্চাশ তলাবিশিষ্ট সুরম্য প্রাসাদেও অবাধ প্রবেশাধিকার। আম জনগণের ক্ষেত্রে করোনার যেমন রক্তচক্ষু, তেমনই রক্তচক্ষু জাঁদরেল সরকারি আধিকারিক থেকে মন্ত্রীর প্রতিও। কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ কাজে লাগছে না। যাঁকে যখন ইচ্ছে টেনে-হিঁচড়ে হাসপাতাল নামক আদালতে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক ঘণ্টার পরোয়ানা জারি করে। কাউকে অব্যাহতি দিচ্ছে, আবার কাউকে মৃত্যুদণ্ড!
বিশ্বে এখন করোনা-ই একমাত্র পরাশক্তি, যার বিরুদ্ধে অস্ত্র-হাতে লড়াই করার মতো ধৃষ্টতা কারও হয়নি। করোনার একাধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সঠিক রণ-কৌশল এখনও আবিষ্কৃত হয়নি শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, করোনা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ভূগোল দেখে কাউকে আক্রমণ করেনি কোথাও। করোনা প্রয়োজনে ছদ্মবেশ ধরলেও মুখোশধারী মানুষের মতো ছদ্মবেশী নয়। জীব কুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত মানুষ একটি অদৃশ্য জীবাণুর কাছে কত অসহায়, বিপন্ন। আক্রান্তরা সব নিকটজন থাকা সত্ত্বেও কত একা, সকলেই যার যার নিরাপত্তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, কারও কাছে ঘেষার অবকাশ নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেভাবে মানুষের কাজে লাগছে কোথায়! এক অর্থে বিজ্ঞানও অসহায়। বৈজ্ঞানিক বক্তব্য বলে যা যা জনমনে প্রচার করা হচ্ছে, তারও কোনও সঠিক ভিত্তি নেই। একবার বলা হচ্ছে, উপসর্গহীনদের মাধ্যমে সংক্রমণের কোনও আশঙ্কা নেই, পরদিন আবার বলা হচ্ছে, সংক্রমণের আশঙ্কা আছে। একবার বলা হচ্ছে, শীতপ্রধান অঞ্চলে করোনার প্রভাব বেশি, তো আরেক বার বলা হচ্ছে, গরমপ্রধান অঞ্চলেও তার প্রভাব সমান। একবার বলা হচ্ছে, কোয়ারিন্টাইনে থাকতে হবে চৌদ্দ দিন, আবার বলা হচ্ছে তার দ্বিগুণ। এভাবে, বিজ্ঞানও মানুষকে সঠিক দিশা দেখাতে ব্যর্থ, না-হলে কোটি কোটি টাকার মালিক যাঁরা, যাঁদের চিকিৎসার ব্যয় সংকুলান করার মতো কোনও আর্থিক সংকট নেই, তাঁরা সংক্রমণে মারা যাবেন কেন। খ্যাতনামা চিকিৎসকরা সংক্রমণে মারা যাবেন কেন! তাঁদের মৃত্যুর জন্য তো আর্থিক দৈন্যতা দায়ী নয়। সুচিকিৎসার অপ্রতুলতা দায়ী নয়। আসলে, করোনা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সচেতনতা-ই বাঁচার একমাত্র পথ। কিন্তু করোনাকে একদিকে ‘আমন্ত্রণ’ করা হবে, আর অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করা হবে, এ হয় না। এ তো কোনও তথাকথিত ‘শান্তি চুক্তি’ নয়।
একদিকে শান্তির পায়রা ওড়ানো হবে, আরেক দিকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষকে বেঘোরে হত্যা করা হবে। কোবিড-১৯ এমনই প্রতিপক্ষ, যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। এ কে ফোরটি সেভেন তাক করে অবলীলায় হত্যা করা যায় না। বোমা নিক্ষেপ করে ধ্বংস করা যায় না। ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া যায় না তাকে লক্ষ্য করে। এমন সম্ভব হলে আমেরিকাসহ ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো এতো দিনে করোনার বিরুদ্ধে বিজয় হাসিল করে নিত। প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্য, কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী, কোথাও তাকে প্রতিহত করার সাধ্য কারও নেই, তার নেই কোনও এলওসি। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণরেখা— করোনার কাছে ভারত-পাকিস্তান-চিন-নেপাল-বাংলাদেশ বলে আলাদা কোনও রাষ্ট্রীয় সীমা নেই। সমগ্র বিশ্বব্যাপী তার রাষ্ট্র একটিই। আর সেই রাষ্ট্রের অঘোষিত কর্ণধার করোনা নিজেই। তাকে প্রত্যাহ্বান করার শক্তি কারও নেই। আমেরিকার মতো তথাকথিত পরাশক্তিরও নেই। নেই বিজ্ঞানেরও। করোনা নিজেই একটি পরাশক্তি। তাই, তাকে ‘পরাজিত’ করার চেয়ে তাকে প্রতিরোধ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমেরিকা-ইউরোপের উন্নত রাষ্ট্রগুলো যখন করোনার চ্যালেঞ্জ নিতে অক্ষম। তখন আমাদেরও উচিত, আলগোছে থাকা, করোনাকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ না ভেবে, ‘সমকক্ষ’ না ভেবে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়া।