পূর্ব লন্ডনের বাঙ্গালী পাড়া ব্রিকলেনের এক প্রান্তে অত্যাধুনিক এবং ছিমছাম শর্ডডিচ হাইস্ট্রিট ওভারগ্রাউন্ড স্টেশন।
আমার সাবেক কর্মস্থল সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক অফিসের ঠিক পিছনে।
গত ফেব্রুয়ারীর এক দুপুরে অফিস থেকে শর্ডডিচ যাবার জন্য একে ব্যবহারের প্রয়োজন হয়েছিলো।
স্টেশন থেকে বের হতেই রাস্তার অপরপাশে চোখ পড়ে কৃত্রিম ঘাসে মোড়ানো ফাইভ এ সাইড ফুটবল মাঠ।
ছোট এই ফুটবল মাঠটি মূল রাস্তা থেকে জালের মতো তারের বেড়া বা ফেন্স দিয়ে আলাদা করা।
আর এই ফেন্সেই ঝুলানো রয়েছে অসংখ্য তালা। একট দুইটা নয়, শত শত, হাজার হাজার তালা।
যারা এর নেপথ্য কাহিনী জানেন না তাদের জন্য এটি একটি কৌতুহল সৃষ্টিকারী দৃশ্যই বটে!
এর আগে প্যারিস এবং প্রাগের দুটি ব্রীজে এই দৃশ্য দেখলেও লন্ডনে ছিলো প্রথম। শর্ডডিচ যেহেতু পরিচিত তাই বলতে পারি এখানে এর প্রচলন বেশী দিনের নয়। ব্যস্ততার মাঝেও খানিকটা থমকে গিয়ে মনের অজান্তেই মোবাইলে কয়েকটি ছবি তুলে রাখি।
এই করোনা কালে লকডাউন বা তালাবন্দী থাকার প্রয়োজনীয়তা যখন প্রবল হয়ে উঠেছে তখন কেন জানি এই তালার গল্পই বারবার মনে আসতে থাকলো।
এই তালার কাহিনী মজার হলেও এর পিছনে আছে শত বর্ষ পূর্বে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা।
এসব তালার অপর নাম লাভ লক। প্রেমিক প্রেমিকারা একে অপরকে ‘প্রপোজ’ করার পর একটি তালায় নিজেদের নাম লিখে এখানে এসে ঝুলিয়ে দেন। হানিমুন কালেও এই কাজটি করেন কেউ কেউ। এরপর ইচ্ছে করেই তারা চাবিটা হারিয়ে ফেলেন।
এর মাধ্যমে তারা তাদের ভালবাসাকেই মূলত বন্দী করেন চিরদিনের জন্য।
এই লাভ লকের প্রচলন পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে। বলা যায় উন্নত দেশগুলোতে এটি মহামারী আকারে দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে।
সব নগর পিতারই এটি একটি রোমান্টিক মাথা ব্যাথা।
প্যারিসে ‘রিভার সাইন’ এর উপর নির্মিত ‘পন্ত দ্যাঁ আর্টস’ ব্রিজের দুপাশের রেলিং লাভ লকের ভারে ধ্বসে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। ২০১৫ সালে কতৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ব্রিজটি রক্ষার জন্য তালাগুলো সরিয়ে ফেলেন। সরানোকৃত তালার মোট ওজন ছিলো ৪৫ টন। নদীর তলদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৭ লাখ চাবি খোঁজে বের করার কোন প্রচেষ্টার কথা অবশ্য জানা যায়নি। এর পুনরাবৃত্তি রোধে ব্রিজের ফেন্সের ডিজাইনেও পরিবর্তন আনা হয়।
তারপরও প্যারিসজুড়ে এই ভালবাসার কারাগার বানানো বন্ধ হয়নি। এখন পুরো শহরেই তা ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে এই শহরের প্রায় ১১টি ব্রিজে এর অস্তিত্ব রয়েছে। সারা বিশ্বের হাজার হাজার প্রেমিক প্রেমিকা কিংবা নবদম্পতি তালা ঝুলাতে প্রতিবছর প্যারিসে হাজির হন। এই তালার জন্য প্যারিসকে এখন ভালবাসার শহরও বলা হয়।
প্যারিসে এর প্রসার ঘটলেও এর শুরুটা হয় সার্বিয়াতে এবং ঘটনাটাও সেখানকার।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে সার্বিয়ার বানজা নামের এক গ্রামের এক জোড়া তরুন তরুনী প্রেমে পড়েন। মেয়েটির নাম ছিলো নাধা আর ছেলেটির রিলজা। স্থানীয় একটি ব্রিজ ছিলো তাদের নিয়মিত সাক্ষাতের স্থান। প্রতিদিন একই জায়গায় তাদের মিলিত হবার দৃশ্য অনেকেরই নজর কাড়ত এবং এই প্রেম কাহিনী স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জানাজানি ছিলো।
তাদের প্রেমের মধ্য গগনেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। পেশায় সৈনিক ছেলেটির সামনে এই যুদ্ধে যোগ দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না তখন। গ্রীস ছিলো তার যুদ্ধ ক্ষেত্র। কিন্তু যাবার আগে সে কথা দেয় ফিরে এসে তারা বিয়ে করবে।
ছেলেটি যুদ্ধে চলে যাবার পরও পেশায় স্কুল শিক্ষিকা নাধা নিয়মিত ব্রিজে দাঁড়িয়ে তার জন্য প্রার্থনা করতো। প্রার্থনা করতো সুস্থ দেহে রিলজা যাতে ফিরে আসে।
একদিন যুদ্ধ শেষ হয়। সৈনিকরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরতে থাকেন।
ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে মেয়েটি মনে মনে তার আসন্ন মিলন উৎসবের সানাই বাজাতে থাকে।
এক সময় বেঁচে যাওয়া সব সৈন্যেই ঘরে ফিরে আসেন। বেঁচে থেকেও ফিরেনা শুধু প্রেমিক ছেলেটা।
একদিন খবর আসে এক গ্রীক কন্যার প্রেমে পড়ে সেই মেয়ের দেশেই রিলজা থেকে গেছেন।
‘পুরাতন প্রেম ডাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে…’। নাধার অপেক্ষার অবসান ঘটে।
চিরদিনের নীড় গড়ার স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা সার্বিয়ান মেয়েটির স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নেয়। নিভৃত ক্রন্দন আর পথ খুঁজে পায় না।
একরাতে আবার সে ফিরে যায় সেই চেনা পথে। এইতো সেদিন! ব্রিজ ব্রিজের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত নদীর প্রবাহিত জলধারা, আশে পাশের পত্রপল্লব, সুখ শ্রান্ত নির্জন জোৎস্নাও আছে আগের মতো। কেবল অসীম ভালবাসাকেই মিথ্যা মনে হতে থাকে। কলরবহীন বিস্তৃত আকাশের নীচে অশান্ত চিত্তের কোমল হৃদয়ের পক্ষে এই মিথ্যা অসম্ভব হয়ে উঠে! পিছনে পরে থাকে মিছে আশা…।
পরদিন সার্ব কন্যার আত্মহত্যার খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়।
একই দিন গ্রামবাসী ব্রিজে ঝুলানো একটি তালা আর চিরকুট উদ্ধার করেন।
মেয়েটির আত্মত্যাগের কাহিনী আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
ব্রিজটি পরিনত হয় প্রেমিক প্রেমিকাদের তীর্থ স্থানে। নাম পাল্টে হয় ‘Bridge of Love’ ।
ভবিষ্যতে কোন প্রেমের পরিনতি যাতে বিচ্ছেদে না গড়ায় এজন্য প্রেমিক প্রেমিকারা শপথ করে ব্রিজে তালা ঝুলিয়ে চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে থাকেন নদীতে।
ভালবাসাকে বন্দী করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে ঝুলিয়ে রাখা তালা আর চিরকুট নিয়ে বিখ্যাত সার্বিয়ান মহিলা কবি ডেসানকা ম্যাকসিমভিস একসয়ম লিখেন ‘Prayer of Love’ শিরোনামের কবিতা। বহু ভাষায় অনুদিত হয় কবিতাটি। ‘Three meters above the sky’ এবং ‘I Desire you’ নামে ইটালিয়ান ভাষায় দুটি রোমান্টিক উপন্যাসও আছে এই কাহিনী নিয়ে। আছে অনেকগুলো বিখ্যাত চলচিত্র। রোমান্টিক লেখালেখির উপর ‘The Golden Padlock’ নামে পুরষ্কারেরও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারী বিশ্ব ভালবাসা দিবসে ইটালীতে এই পুরষ্কার দেয়া হয়।
আরো কতকিছু!
এসব কারনেই মূলত এই তালার বিশ্বায়ন ঘটে।
লন্ডনের বাঙ্গালী পাড়া ব্রিকলেন থেকে শুরু করে প্যারিস, নিউইয়র্ক, টোকিও, মস্কো, বার্লিন, প্রাগ, রোম, সিডনি, মেলবোর্ন, বেইজিং, সিউল – সব বড় বড় শহরেই আজ নব প্রেমে অশ্রু হয়ে ঝরে এই পুরাতন প্রেম। শত বছর আগে এক সার্বিয়ান সুন্দরীর অতৃপ্ত আত্মার স্মৃতি নিয়ে মানুষ নীড় খুঁজে, উষ্ণতায় বন্দী থাকতে চায় চিরজীবন।
দূ:খের তিমিরে মঙ্গলের শপথ হয়ে আজও ভালবাসার প্রেরণা দেয় এই তালা।
তথ্যসূত্র এবং ছবি: গার্ডিয়ান এবং গুগল
লন্ডন ৬ জুন, ২০২০
লেখক :পলিটিক্যাল এডভাইজার, মেয়র অব টাওয়ার হ্যামলেটস জন বিগস