ইদ এলে পরস্পর ইদের শুভেচ্ছা বিনিময় একটা প্রথা। পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য বিনিময় ছাড়া আর কিছু নয়। এই শুভেচ্ছা বিনিময় হলেই যে, কেউ উদ্ধার হয়ে যাবে, এমন নয়। আর শুভেচ্ছা বিনিময় না-হলেই যে কেউ নিঃস্ব হয়ে যাবে, তা-ও নয়। এই শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে থাকা মানসিক দূরত্ব অনেকটা ঘুচে যায় বটে! কিন্তু ইদ-উল-ফিতরের তাৎপর্য কি শুধু এই শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যেই নিহিত আছে! নাকি এর চেয়ে অধিক কিছু? আসলে, এই শুভেচ্ছা বিনিময়টা হচ্ছে আগাগোড়া পোশাকি! অন্তরের দোয়া বা শুভাশিস যদি এই শুভেচ্ছার সমার্থক না-হয়, তাহলে, এই শুকনো শুভেচ্ছা আরেক জনের মনকে জারিত করতে সক্ষম হবে না। তাই তো দেখা যায়, প্রতি বছর ইদ আসে। পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয়ে থাকে। কিন্তু ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় হয় না! কারণ, এই শুভেচ্ছার সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ নেই!
চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী বছরে মাত্র দুটি ইদ। ইদ-উল-ফিতর ও ইদ-উল-আজহা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার শেষে আসে ইদ-উল-ফিতর। এই ইদ ও সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মোমেনদের সংযম, সহনশীলতা, দান ইত্যাদি বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে! দীর্ঘ এক মাস অভুক্ত থেকে নিরন্নদের ক্ষুধার জ্বালা কী, তা উপলব্ধি করার অবকাশ মিলে! তৃষ্ণার্তের নিকট জলের কী মর্ম, তা ক্ষণে-ক্ষণে উপলব্ধি করা যায় রমজান মাসে! লোভ সংবরণ করার প্রশিক্ষণও হয় দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে! আসলে, রমজানের যাবতীয় অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁদের হৃদয়ের সংযোগ ঘটে, ইদের আগের রাতে তাঁদের জন্য ঘোষিত হয় ঈর্ষণীয় পুরস্কার! এ-রাতে মোমেনদের ঢালাওভাবে মুক্তি দেয়া হয়ে থাকে!
সমগ্র রমজান মাসকে তাৎপর্যের দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম দশককে বলা হয়, রহমতের দশক। দ্বিতীয় দশক হচ্ছে, মাগফেরাতের দশক ও তৃতীয় দশককে বলা হয়, নাজাতপ্রাপ্তির দশক! ফলে, যাঁরা প্রকৃতই রমজান মাসের তাৎপর্য অনুযায়ী নিজেদের বিনির্মাণ করার চেষ্টা করেন, তাঁদের জন্য ইদ-উল-ফিতর নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দ! কিন্তু মহিমামণ্ডিত এই রাতেও এক শ্রেণির রোজাদার থেকে যায় আল্লাহর করুণাবঞ্চিত! যারা সমগ্র মাস সিয়াম সাধন করেও কোনও পুরস্কার তাদের ভাগ্যে জুটে না! এরা হচ্ছে, মা-বাবার অবাধ্য, হিংসুক, সুদখোর, আত্মীয়তা ছিন্নকারী ইত্যাদি!
রমজান মাস উপলক্ষ্যে সম্পন্ন মোমেনদের উপর ফিতরা ও জাকাত দেয়া ওয়াজিব অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য। সম্পন্ন ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ফিতরা প্রদান ও ধনীদের পক্ষ থেকে সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ আড়াই শতাংশ জাকাত প্রদান অবশ্যই করণীয়। এই জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদের মধ্যে কিছুটা হলেও সাম্য আসে। একজন যত বড়ো সম্পদশালী হোন না কেন, তাতে অপরের হিংসা করার অবকাশ থাকে কম। কারণ, এই অপরিমিত সম্পদে গরিবেরও আড়াই শতাংশ অংশ নির্ধারিত হয়ে আছে! ধরা যাক, একজন মুসলিম একশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এতে বিনা পুঁজি খাটিয়ে ও বিনা শ্রমে আড়াই কোটি টাকার সম্পদের মালিক তাঁর প্রতিবেশী ও আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে থাকা গরিব ও দুঃস্থ জনগণ! এতে ধনীর অপরিমিত ধন বৃদ্ধিতে গরিবের হিংসে করার অবকাশ কম! অন্তত ইদের নামাজের উদ্দেশ্যে ইদগাহে যাওয়ার আগেই ফিতরা ও জাকাত আদায় করা কর্তব্য। কারণ, একজন দুঃস্থ ফিতরা ও জাকাত থেকে প্রাপ্ত অর্থে ইদ উপলক্ষ্যে কেনাকাটা করে ধনীদের সঙ্গে ইদের খুশিতে সামিল হবে। ইদগাহে ধনীর পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে দাঁড়িয়ে ইদের নামাজ আদায় করবে! এটাও ইদ-উল-ফিতরের অন্যতম তাৎপর্য।
এবারের মতো নিঃসঙ্গ ইদ স্মরণাতীত কালের মধ্যে কেউ প্রত্যক্ষ করেননি! ঝড়-বৃষ্টির দরুন ইদের আনন্দ সাময়িক ম্লান হয়েছে বটে। কখনও ইদের নামাজ মসজিদে আদায় হয়েছে। কিন্তু তা কখনও আর্থ-সামাজিক-ভৌগোলিক বিপর্যয়ের পর্যায়ে পৌঁছয়নি। কোনও একটি বিশেষ অঞ্চল দুর্যোগপূর্ণ থাকলেও সামগ্রিকভাবে বিশ্বের মানব সভ্যতা এমন ভয়াবহ সংকটে পতিত হয়নি। কিন্তু বর্তমান করোনাকালে সমগ্র বিশ্ব থমকে দাঁড়িয়েছে! যেন ভাইরাস আক্রান্ত কম্পিউটার সিস্টেমের মতো বিশ্বব্যবস্থা হ্যাং হয়ে বসে আছে! ফরমেট করতে হচ্ছে! সেই ফরমেট করতে গিয়ে দরকারি কিছু ফাইলও ধ্বংস হচ্ছে!
ইদ উপলক্ষ্যে পরস্পর হাত মেলানো, কোলাকুলি করার প্রথা দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। কিন্তু এবারই ব্যতিক্রম! ইদগাহের বৃহৎ সমাবেশ বাদ দিয়ে ছোটো ছোটো সমাবেশ করে ঘরোয়াভাবে ইদের নামাজ আদায় করা হবে। হাত মেলানো বা কোলাকুলির অবকাশ নেই। দূর থেকে সামাজিক মাধ্যমেই ইদের শুভেচ্ছা বিনিময় হবে! এবারের ইদে তাই অ্যাকচুয়ালের চেয়ে ভার্চুয়ালের গুরুত্ব কম নয়! ইদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে তথা প্রাত্যহিক জীবনে হৃদয়ের সংযোগ নেই বলেই কি স্রষ্টা এমন বিমুখ হয়েছেন! কে জানে! তবু ইদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে ৫২বাংলার সর্বস্তরের পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও সহকর্মীদের জানাই শুভেচ্ছা। অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসুক ইদের সকাল। ভালোবাসার উষ্ণতায় নির্মূল হোক করোনাকাল।