বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রতিবারই প্রাকৃতিক দুর্যোগে রক্ষাকবজ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সুন্দরবন।সেই সুন্দরবনই নানান কারণে বর্তমানে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে।
গত নভেম্বরেও ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। অত্যন্ত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ থেকে ভূখণ্ডকে (বাংলাদেশ) রক্ষায় এবারও বুক পেতে দিচ্ছে সুন্দরবন। তবে ‘বুলবুলের’ তুলনায় ‘আম্ফানের’ ক্ষেত্রে বাড়তি বিপদ আছে।নভেম্বরে সুন্দরবন অতিক্রম করার সময় বুলবুলের বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। আর আম্ফানের ক্ষেত্রে বাতাসের সর্বোচ্চ গতি থাকবে (আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে) ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার। আম্ফানের এখনও বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ থেকে ২২০ কিলোমিটার। ফলে বুলবুলে সুন্দরবনের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, এবার তারচেয়ে অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে জানমাল, বাড়ি-ঘরের ক্ষতি বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।’বুলবুলে’র সময় আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেছিলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তিন দিকেই সুন্দরবন জুড়ে ছিল। সুন্দরবনের কারণে বুলবুলের নিজস্ব শক্তি কমে আসে। আর উপকূল অতিক্রম করতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের দীর্ঘক্ষণ সময় লেগেছে। আর স্থলভাগে গাছ, স্থাপনা দাঁড়ানো থাকে। এগুলোর সঙ্গে সবসময় সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ঘূর্ণিঝড়, বাধা প্রাপ্ত হয়; এ কারণে ওর মধ্যে রিটার্নিং ফোর্সের (বিরোধী শক্তি) কারণে গতি আস্তে আস্তে কমে যায়।’
আম্ফানের বিষয়ে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেছেন, ‘আম্ফানের কেন্দ্র যদি সুন্দরবন হয়, তাহলে তো ওই স্পিডে (১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার) কম ক্ষতি হবে। কেন্দ্র যদি পটুয়াখালী (বা অন্য স্থলভাগ) হয়, তাহলে অনেক ক্ষতি হবে।’
চারটি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে এক হাজার ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান।
বৃহস্পতিবার (২১ মে) বিকেলে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ পরবর্তী সার্বিক বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকার প্রাথমিক হিসাব আমরা পেয়েছি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও কৃষি মন্ত্রণালয় আমদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়েছে। অন্য যারা আছেন তারা রিপোর্ট দিয়েছেন তারা তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দেয়নি।’
বুধবার (২০ মে) বিকেলে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগে উঠে আসে। সন্ধ্যারাত থেকে বাংলাদেশের উপকূলেও শুরু হয় আম্ফানের তাণ্ডব। এটি সারারাত এটি ঘূর্ণিঝড় রূপে থেকেই দেশের দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তাণ্ডব চালিয়েছে। সারারাত তাণ্ডব চালানোর পর বৃহস্পতিবার (২১ মে) সকাল সাড়ে ৭টার পর শক্তি ক্ষয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়। ওই সময় স্থল নিম্নচাপ হিসেবে রাজশাহীতে অবস্থান করছিল আম্ফান।
সকালেই মোংলা, পায়রা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। ঘূর্ণিঝড় এবং দ্বিতীয় পক্ষের চাঁদের সময়ের শেষ দিনের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণসহ ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিসত্ত্বর নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
ইতিমধ্যে রাজশাহীতে ঘূর্ণিঝড় আম্ফামের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে প্রায় একশো কোটি টাকার আম।এমনিতেই করোনার কারণে আম চাষিরা এতদিন ক্রেতা পায়নি তারওপর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত কার্যতঃ তাদের স্বপ্নকে বিনাশ করে দিয়ে গেছে।