সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
https://blu-ray.world/ download movies
সর্বশেষ সংবাদ
বাংলাদেশে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের সম্পদ সুরক্ষায় অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে  » «   ইস্টহ্যান্ডস চ্যারিটির উদ্যোগে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং কর্মশালায় বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণ  » «   হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের  বিরুদ্ধে নীতিহীন কর্মকান্ডের অভিযোগ  » «   সাংবাদিক ক্যারলকে গ্লোবাল জালালাবাদ ফ্রান্সের বিশেষ সম্মাননা প্রদান  » «   গ্লোবাল জালালাবাদ এসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক জালালাবাদ উৎসব প্যারিস অনুষ্ঠিত  » «    সাকিব : নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতি  » «   লন্ডনে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী চাটগাঁয়ে মেজবান ৬ অক্টোবর রবিবার  » «   ১১তম মুসলিম চ্যারিটি রান ২০ অক্টোবর ভিক্টোরিয়া পার্কে  » «   ৭৫ শেফ এর অংশগ্রহণে বিসিএর শেফ অব দ্যা ইয়ার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত  » «   ৩০ বছরেও ধরা পড়েনি কোনো আসামী, বিচারের দাবীতে মেয়ের সংবাদ সম্মেলন  » «   ইস্টহ্যান্ডসের ফ্রি স্মার্ট ফোন পেলেন ৪০ জন  » «   সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য পদক ২০২৪’পেলেন কবি, সাহিত্যিক ও সংগঠক ফারুক আহমেদ রনি  » «   টাওয়ার হ্যামলেটসে হোমলেসনেস-এর প্রস্তাবিত নতুন পলিসি সাসপেন্ড করেছেন নির্বাহী মেয়র লুৎফুর  » «   লন্ডনে বিসিএ এ্যাওয়ার্ডস ২৮ অক্টোবর থাকছে নানা চমকপ্রদ আয়োজন  » «   বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৩২নং বাসভবন ভস্মীভূত এবং ভাস্কর্য ভাংচুরের নিন্দা ও প্রতিবাদ  » «  
সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন

সীমানা ছাড়িয়ে



সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা ব্যক্তির সীমানা ছাড়িয়ে জাতিসত্তার প্রতীক হয়ে ওঠেন। শেক্সপিয়র যেমন ইংরেজ, নেলসন যেমন কালো মানুষদের, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু যেমন বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক, তেমনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০) বাঙালি জাতির মনন, মনীষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। ব্যক্তিত্ব, মনীষা, দায়িত্ববোধ আর কর্মতৎপরতায় হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি বৃদ্ধিবৃত্তিক জগতের অভিভাবক। বাঙালি জাতিসত্তা গঠনের প্রতিটি বাঁকবদলে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন, কোনো কোনো সময়ে অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি অতিক্রম করেছেন ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশের তিনকাল। এই প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতিসত্তা আর বাংলাদেশ গঠনে নিয়েছেন অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্রন্টে তিনি শুধু নেতৃত্বমূলক অংশগ্রহণ করেননি বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর এ রাষ্ট্রের সংবিধান রচনা থেকে শিক্ষানীতি প্রণয়ন সর্বত্রই রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মৃত্যুর আগ অবধি বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির প্রতিটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংকটে দাঁড়িয়েছেন স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে সামনের কাতারে। এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তির সাথে জড়িত যে কোনো মানুষ যে কোনো সংকটে প্রথমেই তাঁর কথা স্মরণ করতেন। মতামত, পরামর্শ নিতেন।

স্যারের সাথে আমারও প্রথম যোগাযোগ স্থাপিত হয় মতামত নিতে গিয়ে, সাংবাদিকতা সূত্রে। সংবাদপত্রের রিপোর্টার হিসেবে আমি সব সময়ই ‘কালচারাল বিট’ করতাম। ফলত সংস্কৃতির নানা কৃত্যে স্যারের মতামত নেওয়া হতো। অবশ্য তখনও আমি ছাত্র। স্যারের সাথে একাডেমিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় আরও পরে। স্নাতকোত্তর পাস করার পর আমি যোগদান করি করি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র গবেষণার রীতিপদ্ধতি বিষয়ে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করত। নাম ছিল ‘গবেষণার রীতিপদ্ধতি’। এখনও পরিচালনা করে কিনা জানি না। স্যার একদিন সাহিত্য নিয়ে গবেষণার বিভিন্ন দিক এবং তাঁর নিজের গবেষণা নিয়ে কথা একটি সেশনে এলেন। আমি তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র জানতাম এবং এ বিষয় নিয়ে আমার খানিকটা অপছন্দ ছিল। অপছন্দ ছিল তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রের শিরোনাম নিয়ে। তাঁর পিএইচডি গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’। আমার আপত্তি ছিল শিরোনামে ‘বাঙালি মুসলমান’ শব্দ প্রয়োগ নিয়ে। এ শব্দবন্ধটি প্রথম প্রয়োগ করেন তাঁর গুরু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। তারপর তিনি সেটা ব্যবহার করতে শুরু করেন। আমার মত ছিল মানুষের মন আর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মূলত অর্থনৈতিক আর ভৌগোলিক অবস্থা। এ হিসেবে পূর্ববঙ্গের হতে পারত। ফলত স্যার যখনই তাঁর গবেষণা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন আমি শুরুতেই হাত তুলে ধরলাম। স্যার যেহেতু আমাকে আগে থেকে সাংবাদিক হিসেবে চিনতেন, ফলত তাঁর স্বভাবসুলভ কৌতুক ভঙ্গিতে বললেন, সাংবাদিক এখানেও হাত তুলেছে নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু জিজ্ঞাসা করবে। আমি বললাম, স্যার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব না স্যার মন্তব্য করব। কোর্স পরিচালক বললেন তাহলে স্যারের ক্লাসের প্রশ্নোত্তর পর্বে বলুন। স্যার বললেন, হাত যেহেতু তুলেই ফেলেছে শুনে নিই। আমি যা বললাম তাতে তাঁকে একজন স্ববিরোধী মানুষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফেললাম। মর্মার্থ হলো- তিনি সারাজীবন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে লড়াই করলেও তাঁর গবেষণা শিরোনামটি সাম্প্রদায়িক চেতনা দোষে দুষ্ট। স্যার একটুও অপ্রসন্ন হলেন না। কিন্তু প্রসঙ্গটা টানতে চাইলেন না। বললেন, আমরা বিষয় নয়, রীতি নিয়ে মূলত এখানে আলাপ করব। প্রয়োজনে এটা নিয়ে তোমার সাথে পরে আলাপ হবে। স্যারের বিরুদ্ধ পক্ষ বেশ আমোদ পেল। বিশেষত উপস্থিত শিক্ষক, তাঁরই সহকর্মী অধ্যাপক সাঈদ উর রহমান। তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে শব্দ করে হাসলেন।

আমার মন খারাপ হলো। স্যার আমার জন্য অনেকটা হেনস্তা হওয়ার জন্য। পরে স্যারের সাথে এসব প্রসঙ্গ নিয়ে নানা সময় খোলাখুলিই আলাপ হয়েছে। তিনি সকল বিষয়ে তাঁর মত খুব দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ করতেন। সে মত কখনই ব্যক্তিগত হতো না। তাঁর মতের পেছনে সবসময়ই নৈর্ব্যক্তিক যুক্তি থাকত। আরেকবার মনে আছে- স্যার তখন নির্দিষ্ট দিনগুলোতে বিমানবন্দর রোডে কালি ও কলম অফিসে বসতেন। একদিন শিক্ষা বিষয়ক একটা গবেষণা প্রবন্ধ স্যারকে দেখাতে নিয়ে গেছি। বিষয় উনিশ শতকের বাংলা অঞ্চলের শিক্ষায় ব্রিটিশ অর্থায়ন প্রসঙ্গে। সেখানে শিক্ষায় ব্রিটিশদের প্রথম এক লাখ টাকা বরাদ্দ ব্যয় নিয়ে ১৮১৩ সাল থেকে ১৮২৩ সাল পর্যন্ত বাঙালিদের তর্ক বিতর্ক ও হাঙ্গামার দীর্ঘ পটভূমি ছিল। আমার হাইপোথিথিস ছিল সেটা ব্রিটিশরাই তৈরি করেছিল। যাতে পরে মেকলে কমিশনের মতামত ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। সেটা ছিল বাংলা অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিককরণে প্রথম চতুর পদক্ষেপ। পটভূমি তৈরি করার প্রয়াস। স্যার খুব শান্তভাবে আরও কিছু রেফারেন্স বললেন। যা আমার দীর্ঘদিনের ধারণাকে নস্যাৎ করে দিল। ব্রিটিশদের ওপর অভিযোগের তীব্রতা দুর্বল করে দিল। কমলকুমারের গদ্যরীতি বুঝতে বাংলা গদ্য বিষয়ে স্যারের মতামতগুলো খুব কাজে লেগেছিল। এ তো গেল স্যারের পাণ্ডিত্যের গভীরতার সামান্য পরিচয়। স্যারের ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতার সরাসরি পরিচয় পাই একবার বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায়। তখনে সরকার সদ্য বদলে গেছে। কিন্তু স্যার তখনও একাডেমির সভাপতি পদে রয়ে গেছেন। স্যার সভাপতি হিসেবে সভা পরিচালনা করছেন। সভায় একটা ইস্যুতে নতুন ক্ষমতায় আসা দলের সমর্থক তরুণ বুদ্ধিজীবীরা তীব্র ভাষায় বিরোধিতা করছেন। কিন্তু স্যার নৈতিক অবস্থান থেকে একটুও সরছেন না। সভা পণ্ড হওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু তাঁর অবস্থানের সিদ্ধান্তই বহাল রাখলেন। বিদেশের মাটিতেও স্যারের দৃঢ় আচরণ আর সেশন পরিচালনা দক্ষতার পরিচয় পেয়েছি।

স্যারের সাংগঠিন ক্ষমতার আরও ঘনিষ্ঠ পরিচয় পাই ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন আয়োজন করতে গিয়ে। বাংলা অঞ্চল নিয়ে গবেষণা করেন এমন সারা পৃথিবীর বাঙালি অবাঙালি গবেষকরা এ সংগঠনে জড়িত। এর আগের সম্মেলন হয়েছিল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরেরটি হওয়ার কথা জাপানে। ফলে স্বভাবতই আমরা এর সাফল্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান। আমি যুগ্ম আহ্বায়ক। স্যার ছিলেন সম্মেলন কমিটির সভাপতি। স্যার প্রতিটি ছোটখাটো সভায়ও এসে বসে থাকতেন। কখনও অমন হয়েছে আমরা ছোট মানুষরা সভায় আসতে দেরি করেছি কিন্তু স্যার একদম ঠিক সময়ে চলে আসতেন। আমি বিস্মিত হতাম এমনকি আহ্বায়ক কমিটির ছোট ছোট সভায়ও স্যার সময় দিতেন। সম্মেলন উদ্বোধন করার কথা ছিল তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শেষ মূহূর্তে তাঁর আগমন অনিশ্চিত হয়ে যায়। স্যার পুরো পরিস্থিতি একাই শান্তভাবে সামলেছিলেন। অর্থ সংগ্রহ থেকে পুরো অনুষ্ঠান সফল করা পর্যন্ত। শুধু বড় বড় বিষয় নয় খুব ছোট কিন্তু অর্থপূর্ণ বিষয়েও খেয়াল রাখতেন। একটা ঘটনা বলেই আমার লেখা শেষ করব।

স্যারকে একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছি। আমি তখন সবে সহকারী অধ্যাপক। থাকি ক্যাম্পাসেই। দুপুরে তৎকালীন উপাচার্যের কার্যালয়ে স্যারের সম্মানে ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। উপস্থিতরা ডিন ও অধ্যাপক পর্যায়ের। খাবারের সময় হলে স্যার আমার খোঁজ নিলেন। আমি ততক্ষণে লাঞ্চে বাসায় চলে গেছি। স্যারের কথা আমি সেমিনার আয়োজকদের একজন। আমাকে ছাড়া তিনি খাওয়া শুরু করবেন না। তারপর আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর স্যার আমাকে পাশে বসিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। একেই বলে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক- উপাচার্য স্মিত হেসে বলেছিলেন।

শোয়ইব জিবরানঃ কবি, শিক্ষাবিদ, গবেষক


সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

"এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব " -সম্পাদক