গেল ৪ মে ২০২০ থেকে লকডাউন তুলে দিয়েছে ইউরোপের ছোট্ট দেশ স্লোভেনিয়া সরকার।মধ্য ইউরোপের মাত্র ৭ হাজার ৮২৭.৪ বর্গমাইলের দেশটিতে সর্বশেষ তথ্যমতে ২২ লক্ষ লোকের বসবাস।
সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা,বিভিন্ন ধরনের হ্রদ ও স্কি রিসোর্টের জন্য দেশটি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। করোনার ছোবল থেকে নিষ্কৃতি পায়নি ইউরোপের এই ছোটো ও সুন্দর দেশ স্লোভেনিয়াও।তবে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশটিতে সংক্রমণ ও মৃত্যু হার অনেক কম। মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দেশটি ইতোমধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের কাছে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়ায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে ১ হাজার ৪৩৯ জন।করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে এখন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ৯৭ জন।
গত ৩ দিনে দেশটিতে নতুন করে আর কেউ এ প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি।এ ছোটো পরিসংখ্যানই বলে দেয় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কতটা সফল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত দেশ স্লোভেনিয়া।
করোনা রোধে দেশটির সফলতার পেছনে রয়েছে বেশকিছু কারণ।যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দেশটি সম্পূর্ণ ডিসেন্ট্রালাইজড।অর্থাৎ পৃথিবীর অনেক দেশ যেখানে সব মানুষ একটি নির্দিষ্ট শহর কেন্দ্রিক, স্লোভেনিয়া সেখানে ব্যতিক্রম।স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জীবন শুধু দেশটির রাজধানী লুবজানা কেন্দ্রিক নয়। স্লোভেনিয়ার প্রায় সর্বত্র জনবসতির বণ্টন রয়েছে এবং সমগ্র স্লোভেনিয়া সুউচ্চ আল্পস এবং ডিনারাইডস পর্বতমালা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকায় স্লোভেনিয়ায় এ জনবসতির বণ্টন অনেকটা ছড়ানো ছিটানো। স্লোভেনিয়ার প্রত্যেকটি রাজ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই দেশটির নাগরিকদের অন্য রাজ্যে যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন পড়ে না।
কোবিড-১৯ মহামারীর বিস্তার রোধে দেশটির সরকার গত ১৯ মার্চ থেকে জরুরি অবস্থা জারি করে।এতে বিশেষ অনুমতি ব্যতীত এক শহর থেকে অন্য শহরে যাতায়ত বন্ধ হয়ে যায়। এটি দেশটির করোনা প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।
স্লোভেনিয়ার উত্তরে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে -হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া, পশ্চিমে ইতালি এবং দক্ষিণে ভূ-মধ্যসাগরের শাখা আড্রিয়াটিক সাগরের সঙ্গে যুক্ত। ইতালির সীমান্তবর্তী অংশে দেশটির অবস্থান হওয়ায় করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হওয়ার কথা থাকলেও ওই অংশে অর্থাৎ পশ্চিম স্লোভেনিয়ায় দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে কম।
গত ৪ মার্চ স্লোভেনিয়ায় সর্বপ্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি মরক্কো থেকে ইতালি হয়ে স্লোভেনিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন। স্কি স্লোভেনিয়ার একটি জনপ্রিয় খেলা এবং স্লোভেনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ স্কির প্রতি আসক্ত। স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে বলা হয়, স্লোভেনিয়ায় সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে যাদের শরীরে এ ভাইরাসটি ধরা পড়ে তাদের একটি বড় অংশ এর কয়েকদিন আগে ইতালিতে গিয়েছিলো স্কি খেলার জন্য। এরপরই স্লোভেনিয়া সরকার ইতালির সঙ্গে সীমান্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরবর্তীতে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়াসহ অন্যান্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশটি। ১৯ মার্চ থেকে দেশটিতে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে রাজধানী লুবজানায় অবস্থিত দেশটির একমাত্র বিমানবন্দরটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি বিভিন্ন ধরনের কার রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। ট্যাক্সিচালকদের বলা হয়, প্রত্যেকবার যাত্রী বহন শেষে তাদের ট্যাক্সিগুলো নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে।
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সব ধরনের গণজমায়েত নিষিদ্ধসহ জনগণকে দেশটির সরকার বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়। এছাড়াও স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে স্পেশ্যাল হট লাইন চালু করা হয়। কেউ সর্দি, কাশি, জ্বরসহ কোভিড-১৯ এর কোনো উপসর্গের সম্মুখীন হলে তাকে তৎক্ষণাৎ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা সেবায় নিয়জিত তিনটি অনলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি নিয়ে যে সব ইনস্টিটিউট গবেষণা করছে তার মধ্যে স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের ডিপার্টমেন্ট অব ইমিউনোলজি এবং ডিপার্টমেন্ট অব ভাইরোলজি অন্যতম। যাদের সমন্বিত গবেষণালব্ধ ফলাফল পৃথিবীর অনেক দেশই অনুসরণ করছে। এছাড়াও স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথও করোনা প্রতিরোধে কার্যকরী ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে কাজ করছে। অর্থাৎ দেশটির উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা করোনা রোধে সহায়ক হয়েছে।
অপেক্ষাকৃত নতুন রাষ্ট্র স্লোভেনিয়ায় শুধুমাত্র সরকারের উদ্যোগ, দেশটির সাধারণ মানুষের সচেতনতা, মানসিক দৃঢ়তা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিপক্ষে দেশটিকে জয়ী করেছে।
এদিকে আগামী সপ্তাহ থেকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুলে দেওয়া হতে পারে বলে রাষ্ট্রীয় সূত্রে বলা হয়েছে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্কুল,কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে সকল শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ক্লাশসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালু হবার কথা রয়েছে।