সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন
টানা ১০ মাসের অপেক্ষা, উত্তেজনা, নানা শারীরিক জটিলতা আর অসংখ্য নির্ঘুম রাতের পরীক্ষা পাড়ি দেয়া স্ত্রীকে নিয়ে ১১ জুন সকালে হাসপাতালে হাজির হয় এক যুবক।
সকাল থেকেই স্ত্রীর অসহায় নয়ন যুগলের দিকে তাকাতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো তার। রয়েল লন্ডন হাসপাতালের রিসিপশন থেকে নির্ধারিত ওয়ার্ডে যেতে তাদের সময় লেগে যায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী। সম্পূর্ণ একক এবং টানা জন্ম যন্ত্রণার ভারে ন্যূয়ে পড়া স্ত্রীর দেহখানি যেন এগুতে চাচ্ছিল না চেনা করিডোরে।
সৃষ্টি কিংবা জন্ম রহস্যের খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সেই যুবককেও সেদিন কেন জানি খুব অসহায় লাগছিলো। শীত শীত অনুভূত হচ্ছিলো তার। গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল বারবারই।
সবকিছু চলতে থাকে ঘড়ির কাটা ধরে! ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পর পরই স্ত্রীর শরীরে দেয়া হয় বিশেষ ধরনের ওষুধ। উদ্দেশ্য কৃত্রিম প্রসব বেদনা সৃষ্টির মাধ্যমে সন্তানের জন্মদানকে সময়মতো এবং নির্বিঘ্ন করা।
বেলা ১১ টার দিকে ওষুধটি দেয়ার কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় সেই প্রলংয়করী ব্যথা। এ ব্যথার কথা যুবকও পড়েছে গল্প আর উপন্যাসে, শুনেছে লোকমুখে আর গানে গানে। বিজ্ঞানের ভাষায় যা -“Most high frequency pain in the world”
সময় গড়াতে থাকে আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে প্রলয়ের তীব্রতা। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ ভেদ করা সেই প্রলয় রূপ নেয় আর্তচিৎকারে। আর সেই চিৎকার আচড়ে পড়তে থাকে পাশের ওয়ালে, বিছানায়, পর্দায়। একসময় তা দেয়াল ছিদ্র করে, জানালার ফাঁক গলিয়ে যেন ঝড়তে থাকে পাশের রাজপথে।
এ যেন একটি জীবন্ত প্রাণীর শরীরের চামড়া টেনে টেনে তোলার বিভৎসতা! বর্ণনা অসম্ভব এক যন্ত্রনা! নিয়তির কাছে সব ছেড়ে দিয়ে অসহায় হয়ে কেবল অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা!
দুপর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, এরপর আসে রাত। এক পর্যায়ে ডাক্তার এসে পুন:পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বললেন ব্যথানাশক ইনজেকশন এপিডোরালের প্রস্তুতি নিতে।
ব্যাখ্যা করা হলো সম্ভাব্য সাইডএ্যফেক্টসমূহ। এমন পাওয়ারফুল ইনজেকশনে ‘আপত্তি নেই‘ মেনে নিয়ে অভিবাবক হিসাবে যুবকের স্বাক্ষর নেয়া হলো কাগজে।
কিছুক্ষণ পর বিশেষজ্ঞ নার্স বিশাল সূচ কায়দা করে পিঠের নীচের হাড়ে ঢুকিয়ে কর্ম সম্পাদন করলেন।
ওষুধের ম্যাজিকে যন্ত্রনার তীব্রতায় ভাটা আসে। সকল প্রতীক্ষারও অবসান ঘটে একসময়। পারমানবিক শক্তি প্রয়োগে এক সময় পৃথিবীর বুকে পা পড়ে এক ক্ষুদ্র মানব শিশুর।
স্ত্রীর ঘামে ভিজে যাওয়া শরীরে অজান্তেই গিয়ে যোগ হয় শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকা এক নবাগত পিতার কয়েক ফোটা অশ্রু…।
এরপর কাঁচি দিয়ে নাড়ী কেটে মূল শরীর থেকে ছিন্ন করা হয় থোক থোক রক্ত দিয়ে মোড়ানো সেই শিশুটিকে। আরেক জন এসে মুছে দেন সেই রক্ত। তারপর সাদা টাওয়াল দিয়ে মোড়া সেই সন্তানকে তুলে দেয়া হয় মায়ের কাছে।
এ যেন এক দূর্গম পাহাড়ের মাটি খুঁড়ে, অনেক গভীরে গিয়ে, কোন বন্ধ কোষাগারের দরজা ভেঙ্গে বের করে আনা চোখ ঝলসানো মহামূল্যবান কোন সম্পদ!
মহাকাশ যানের মতো অসংখ্য যন্ত্রপাতি আর আলোকজ্জ্বল শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের অদূরে দাঁড়িয়ে মানব জন্মের এই বিভৎস আয়োজন এবং একটি অপূর্ব আনন্দ-আলিঙ্গনের স্বাক্ষী হয়ে থাকা যুবকটিই হচ্ছে আজকের আমি, সেই জন্মদাত্রী হচ্ছেন আমার স্ত্রী এবং ভূমিষ্ট শিশুটি হচ্ছে পুত্র সাদাফ।
আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে আমিও এক জন্ম কারিগরকে ছিন্নভিন্ন করে পৃথিবীর বুকে পা রেখেছিলাম।
ভিন্ন আঙ্গিকে সাজানো ছিলো সেই আগমনী মঞ্চ। সেদিনের সেই আয়োজনের প্রধান অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যক্ষভাবে অজানা ছিলো সেই নাটকের সকল দৃশ্যপট।
অর্ধশতক আগে বাংলাদেশের হবিগঞ্জের চারাভাঙ্গা গ্রামে পালকিতে চড়ে বধূ হয়ে আসা এক সাধারণ নারীর এক অতি সাধারণ পুত্রের জন্মদানের ঘটনা কোন গল্পের বিষয় নয় কখনো।
কিন্তু পুত্র হিসাবে আমার ব্যক্তিগত জীবনে সেই গল্পের মূল্য অপরিসীম। এবং অবধারিতভাবে সেই গল্পের নায়িকা আমার মা। এবং নিশ্চিতভাবে সেই গল্পেও আছে আমার স্ত্রীর সমপরিমান বেদনা আর আত্মত্যাগ।
বড় হয়ে আমার কারিগরের কাছেই শুনেছি স্বশিক্ষিত নানুই ছিলেন প্রধান গাইনোকোলজিস্ট আর তার সহযোগী গাইনোকোলজিস্টের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কোন এক সেলামতের মা!
জানতে ইচ্ছে করে কেরোসিন বাতির নিভু নিভু আলোয় সেদিনের জন্মমঞ্চের আর্তচিৎকারগুলো কতদূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো!!
খুব মনে পড়ে আমার স্ত্রী একবার আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলো ‘আর পারছি না’। আমার মাও নিশ্চয়ই বলেছিলেন ‘আর পারছি না‘!
মায়ের শরীর থেকে গলগলিয়ে বের হয়ে আসা রক্ত কী মাটিতে গড়িয়ে পড়েছিলো?
পীত কালারের নাড়ী কেটে কে আলগা করেছিলো আমাকে?
পাশে দাড়িয়ে থেকে কপালের ঘাম কী কেউ মুছে দিয়েছিলো?
আমার মাকে কী সেই দিনটির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিলো ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি দিয়ে?
কিংবা ১০ মাসের অনিশ্চিত যাত্রায় আজকের বিজ্ঞান কী তার পাশে ছিলো?
পুত্র কন্যার জন্মের স্বাক্ষী হয়ে আমি এর সব উত্তরই জানি। আমি জানি আমার মায়ের জীবন আরো কষ্টের ছিলো।
শুধু জন্ম যন্ত্রনাই নয়, জন্ম পরবর্তী তার জীবন ছিলো আরো কষ্টের। পুরানো কাপড় সেলাই করে তাকে কাঁথা বানাতে হয়েছিলো আর বানাতে হয়েছিলো ত্রিভূজ আকারের কাপড়ের নেংটি। প্লাস্টিকের শীটে শুয়ে সকাল, দুপুর, রাতে সময়ে অসময়ে তা আবার পরিষ্কার করতে হয়েছে, আরেকবার ব্যবহারের জন্য রোদে শুকাতে হয়ছে। খাওয়াতে হয়েছে শরীরের রক্ত দিয়ে তৈরী বুকের দুধ।
গভীর রাতে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কিংবা শেয়ালের ডাকে ভয় পেয়ে যখন কেঁপে কেঁপে উঠেছি মা তখন ঝাপটে ধরেছেন।
‘Well done mum, congratulation’ লেখা কোন কার্ড, ফুল আর চকলেট তার জন্য কোন দিনই অপেক্ষা করেনি।
উল্টো জন্মের কয়েকদিন পরেই তাকে ফিরে যেতে হয়েছিলো রান্নাঘরে। সকালে উঠে সবার জন্য নাস্তা বানাও, স্কুলের জন্য সবাইকে তৈরী কর, দুপুরের খাবার বানাও, প্রস্তুত রাখ রাতের খাবারও। এ যেন -The sun rises in the east, sets in the west!
বাবা চাকুরীজিবী ছিলেন। ফলে সংসারের দৈনন্দিন প্রায় সকল দায়িত্বই আমার মাকে পালন করতে হতো।
দিন গেছে, নতুন মাস এসেছে। বছর শেষে আরেক বছর যোগ হয়েছে। সংসারের ঘানী বাড়া ছাড়া কমেনি কখনো। বরাবরের মতোই তার জীবন থেকে গেছে সাদা কালো। এই সাদা কালো জীবনে ছিলো না লং ড্রাইভ, ছিলো না পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যের উদয় কিংবা অস্ত দেখা। এ জীবনে ছিলো না রেস্টুরেন্টের কাটলেট-ওমলেট, উড়োজাহাজ, সিনেমা, থিয়েটার, শপিং সেন্টার, জন্মদিনের বেলুন কিংবা বিবাহবার্ষিকী।
সুগন্ধির জন্য শ্যানেল অথবা মাইকেল কর্সের প্রয়োজন হয়নি। বাবার ব্যবহৃত আতরের গন্ধেই মার জীবনে সুগন্ধ এসেছে।
আর হানিমুন! এতো স্টিফেন হকিংয়ের বিগ ব্যাং থিউরির মতোই রহস্যময়!
বছরে একবার নানার বাড়ী অথবা খালার বাড়ীই ছিলো একমাত্র বিনোদন। এই বিনোদন বিহারে মায়ের জলপাই রংয়ের ট্রাংকে কাপড় ভরে কতবারই সঙ্গী হয়েছি বেবি ট্যাক্সিতে পা বাঁকা করে বসে।
বাবা অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় ইজি চেয়ারে পা উচিয়ে বারান্দায় বসতেন চা নিয়ে আর সাথে থাকতো দৈনিক ইত্তেফাক। আম্মা বসতেন পাশের একটি চেয়ারে -একটু উচুস্তরের ‘প্রজার মতো‘ । এর ফাঁকে চলতো সারাদিনের জমানো কথা, গল্প ! ডাউনিং স্ট্রীটের কোবরা মিটিংয়ের মতো সংসারের সিদ্ধান্ত আসতো সেই আন্তরিক এবং খোলামেলা আলোচনা থেকে।
সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতাম আমরা- ভাই বোনেরা। টিউশনি, পড়াশোনার খবর, পরদিনের বাজার সদাই সবকিছু। পাছে মন ভেঙ্গে যায় এই কারনে অভাব আড়ালের কৌশলও নেয়া হতো মিটিং থেকে।
শিক্ষার প্রতি আমার মায়ের আগ্রহ ছিলো উল্লেখ করার মতো। বিশেষ করে তার আগ্রহ না থাকলে আমার দু‘বোনের ইডেন কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হতো না।
একসময় আমরা ৪ ভাইবোন একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। ৪ জন ৪ হলে। কত কষ্ট আর আত্মত্যাগ, কত সুখ বিসর্জন! একটু পক্ষ নিয়ে আবারো বলবো আমার মা ছাড়া এটা কখনোই সম্ভব হতো না।
আমার মা চাইতেন আমি যাতে বিদ্বান হই। মায়ের এই চাওয়া ছিলো ‘অন্ধজনে চোখে আলো‘র মতোই। আমি কথা রাখিনি, রাখতে পারিনি।
আমাদের সাদা’কালো জীবন এক সময় আংশিক রঙ্গিন হতে শুরু করে। আমি লন্ডন, আরেকজন আমেরিকায়। দেশে বাকী ভাই বোনরাও চাকুরী, ব্যবসা শুরু করেছেন। এরই মধ্যেই বিদায় নিলেন বাবা। তারপর থেকেই মা আস্তে আস্তে কুকড়ে যেতে থাকলেন। দাঁত চলে গিয়ে চোয়াল ভিতরমুখী হলো। চামড়া শীর্ণ হতে থাকলো। ‘দিনে দিনে ছোট হতে থাকলেন তিনি‘। একবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে পা ভাঙ্গলেন। ডাক্তার বললেন ক্যালসিয়ামের বেশ অভাব। বিদ্বান না হলেও এই অভাবের কারণ বুঝলাম। ক্যালসিয়াম যে সব আমাদের পেটে!
তারপর একদিন অনিবার্যভাবেই আসলো সেই খবর- আমার জন্ম কারিগর চলে গেছেন চন্দ্র কারিগরের দেশে।
ডেটলাইন ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর।
ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে সন্তানদের জন্য নিবেদিত একটি ব্যক্তিগত জীবনহীন কর্মময় জীবনের আলো নিভে যায় চিরদিনের জন্য।
ওয়েস্টমিনিস্টারের চার দেয়ালের ভিতর থেকে টেমসের টলমল পানি দেখতে দেখতে, আলপসের চূড়াকে পিছনে রেখে সেলফি তুলতে তুলতে কিংবা কোন এক রং মাখা দুপুরে আইফেল টাওয়ারের উচুঁতে দাড়িয়ে ফরাসী সৌরভ মেখে কৃষ্ণসাগরের বুকে ভাসানো জাহাজে বসে বাটার সস দিয়ে স্যামন খেতে খেতে যখনই নীচের দিকে তাকাই তখনই ভেসে আসে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সেই চেনা মুখ। প্রিয় মুখ।
দেখি কেউ একজন বেগুন দিয়ে ডিম ভূনা বানাচ্ছেন ছুটিতে আসা ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য। আর আমি পুকুরে গোসল সেরে বসে আছি গরম ভাত নিয়ে…. ।
চূড়া থেকে দৌড়ে নীচে নামি….তাকে পাই না। অস্থির হয়ে রাতের তারার দিকে তাকাই … কিছুই দেখি না।
মেঘের আড়ালে চাঁদ ডেকে আবার পরক্ষণেই ফিরে আসে। মা আর ফিরে আসেন না। জন্ম আর মমতার ঋণখেলাপের ভারে আমি কেবলই কুকড়ে যেতে থাকি… কুকড়ে যাই ….।
মেয়েরা আরেকটি নতুন জন্ম দিয়ে এই দায়ের ভাগ নিলেও ছেলেরা পরাজিত থেকে যায় চিরদিনই। যেমনটা আছি আমি এবং আমরা।
মাকে খুব মনে পড়ে…।
(এই লেখার সময় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করায় স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা)
লন্ডন, ৯ মে ২০২০।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন