এলিসা গ্রানাতু
করোনাভাইরাসের থাবা একের পর এক মানবদেহ নিথর করে দিচ্ছে। এই অদৃশ্য শত্রুকে প্রতিরোধ করার হাতিয়ার তথা প্রতিষেধক খুঁজে চলেছে গোটা মানব সভ্যতা। এই হাতিয়ার তৈরির জন্য নির্ঘুম রাত কাটছে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। বিশ্বজুড়ে ৮০টিরও বেশি গবেষক দল কাজ করছে করোনাকে হারানোর প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষাও হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আশার বাণী পায়নি মানব সম্প্রদায়।
তারপরও ভীত-সন্ত্রস্ত বিশ্ববাসী আশায় বুক বেঁধেছেন সুখবর পাবেন বলে। নিরাশার বৃত্তে তাদের সামনে এ আশার আলো জ্বালছেন যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা, বিশেষত ওই বিজ্ঞানীদের নেতা অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গবেষকদের তৈরি করা ভ্যাকসিন বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ হয়েছে মানবদেহে। শিগগির এ পরীক্ষার ফল জানা যাবে। ওই বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ভ্যাকসিনটি কাজ করবে বলে তারা ৮০ শতাংশ আত্মবিশ্বাসী।
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীন থেকে ছড়িয়ে করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নিলে অন্যান্য দেশের গবেষকদের মতো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গবেষকরাও প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের যুদ্ধে নামেন। তিন মাসের প্রচেষ্টায় অবশেষে এ ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। নাম দেয়া হয় ‘চ্যাডক্স ১ এনকভ-১৯’। ভ্যাকসিনটির প্রি-ক্লিনিক্যাল কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট।
গবেষকরা জানান, শিম্পাঞ্জির সাধারণ সর্দির ভাইরাসের দুর্বল সংস্করণ (অ্যাডেনোভাইরাস) ব্যবহার করে ‘চ্যাডক্স ১ এনকভ-১৯’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। তাদের প্রত্যাশা, আবিষ্কৃত এ টিকা শরীরে দিলেই প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে, যা ঠেকিয়ে দেবে করোনাভাইরাসকে।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম জানায়, সরকারিভাবে অনুমোদনের পর বৃহস্পতিবার গবেষক দলের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন বা টিকা প্রথমে দুজন স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে দেয়া হয়। এদের একজন হলেন এলিসা গ্রানাতু নামে এক বিজ্ঞানী। এ পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন ৮০০ জন, অর্থাৎ তাদের শরীরেও ভ্যাকসিনটি দেয়া হবে। অর্ধেক ব্যক্তির শরীরে দেয়া হবে করোনার ভ্যাকসিনটি, বাকি অর্ধেকের শরীরে দেয়া হবে নিয়ন্ত্রিত মেনিনজাইটিস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন।
গবেষকরা বলছেন, পরীক্ষা প্রক্রিয়া এমনভাবে চালানো হচ্ছে, যেন এতে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা বুঝতে না পারেন তাদের শরীরে কোন ভ্যাকসিন গেছে। কেবল গবেষকরাই জানবেন সেটা। নিজেদের অনুমিত সময়ে এর ফলাফলও জানতে পারবেন গবেষকরা।
গবেষণার নকশা অনুসারে, তিন দফায় এই ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ করা হবে। ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সীদের দেহে প্রথম দফায় এই ভ্যাকসিন দেয়া হবে। যদি প্রথম দফার পরীক্ষা সফল হয় তবে দ্বিতীয় দফায় ৫৫ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের ওপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হবে। চূড়ান্তভাবে তৃতীয় দফায় ১৮ বছরের বেশি বয়সী পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে।
চ্যাডক্স-১ উদ্ভাবনের নেতৃত্বভাগে থাকা বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট বলেছেন, আমি এ ধরনের প্রতিষেধক নিয়ে আগেও কাজ করেছি। (করোনাভাইরাস গোত্রের) মার্স-এর প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করেছি। এর কী ক্ষমতা তা জানি। আমার বিশ্বাস, এই প্রতিষেধক কাজ করবে।
প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর সময় তিনি বলেছিলেন, ব্যক্তিগতভাবে এটি কাজ করবে বলে আমি ৮০ শতাংশ আত্মবিশ্বাসী। তবে অবশ্যই এটি পরীক্ষা করতে হবে আমাদের।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে ‘চ্যাডক্স-১ এনকভ-১৯’কে সুপার ভ্যাকসিন বলা হচ্ছে। যেখানে অন্য ভ্যাকসিনগুলোর প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেই কয়েকমাস সময় লাগছে, সেখানে ‘চ্যাডক্স-১’ এর এতো দ্রুত অগ্রগতি অনেককে বিস্মিতও করছে। ভ্যাকসিনটি নিয়ে গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশাবাদের বড় কারণ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৮ বছর বয়সী সারাহ গিলবার্টের অতীতের সাফল্য।
এর আগে ২০১২ সালে করোনাভাইরাস গোত্রের যে মার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল, সেটির ভ্যাকসিন তৈরির পথও দেখিয়েছিলেন সারাহসহ অক্সফোর্ডের গবেষকেরা। এমনকি ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় যে ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, সেটি প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আনার লড়াইয়েও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল ছিল অগ্রগামী। আর এতে নেতৃত্বভাগে ছিলেন সারাহ। সেই সারাহ যখন তার গবেষণার সম্ভাব্য ফলাফলের ব্যাপারে ৮০ শতাংশ আত্মবিশ্বাসের কথা বলেন, তখন আশাবাদের পারদ ঊর্ধ্বমুখী না হয়ে পারে না।
যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদই ১০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির আশা করছেন। এখন যে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে, তা সফল হলেই উৎপাদনের মাত্রা নির্ণয় করবেন গবেষকরা।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান হিল জানান, বিশ্বের সাতটি জায়গায় এই প্রতিষেধক উৎপাদনের কাজ চলছে। অক্সফোর্ডের সঙ্গে প্রস্তুতকারী অংশীদার হিসেবে রয়েছে যুক্তরাজ্যের তিনটি সংস্থা, ইউরোপের দুটি, চীনের একটি এবং ভারতের একটি সংস্থা।
‘চ্যাডক্স-১’ এর ডোজ উৎপাদনে গবেষক দলের এমন অগ্রগামী কার্যক্রম স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের করছে আরও আশাবাদী। তারা বলছেন, লাখ লাখ ডোজ ওষুধ উৎপাদনের কার্যক্রমে বিপুল অর্থ যোগানের প্রশ্ন আসে। অনেকটা নিশ্চিত না হলে প্রতিষেধকের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেতেন না গবেষকরা।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা নকশা অনুসারে মে মাসেই ভ্যাকসিনটির ফলাফল বুঝে যাওয়া যাবে। এই প্রক্রিয়ায় পরবর্তী কার্যক্রম এগোলে সেপ্টেম্বর নাগাদই বাজারে মিলে যেতে পারে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের টিকা।