বিজ্ঞানের আবিষ্কারের কাছে করোনা নত হলেও বরিস জনসন প্রশ্নবিদ্ধই থাকবেন এনএইচএস প্রশ্নে, আর সে কারণে দায়ভার তার একটু বেশিই থাকবে ব্রিটেনের হাজার হাজার মৃত্যুর। অন্তত ডা. ফয়সলের ১১ বছরের কন্যা ওয়ারিশা ও ১৮ বছরের পুত্র ইনতিসারের পাহাড়সমান বেদনাকে তিনি ঢাকতে পারবেন না কোনো নীতিকথা দিয়েই। কারণ তারা তখনও বরিস জনসনের কাছে তাদের পিতার সেই চিঠির উত্তর চাইবে, চাইব আমরাও অগণিত মানুষ, স্বাস্থ্যকর্মীরা তো চাইবেই।
করোনার আক্রমণ থেকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ফিরে এসেছেন, ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে আসতে আরও সময় লাগবে যদিও।কিন্তু শঙ্কা কাটিয়েছেন তিনি, স্বস্তি এসেছে ব্রিটেনের মানুষের মাঝে। কেননা সারা পৃথিবীর সাথে ব্রিটেনও এখন পার করছে এক কঠিন সংকটময় সময়। ব্রিটেনের সকল নাগরিক যে বরিস জনসনকে পছন্দ করে, তাতো অবশ্যই নয়। রাজনীতিতে তিনি বহু উচ্চারিত এবং সমালোচিতও বটে। তার ঠোঁটকাটা কথাগুলো সময়ে সময়ে তার পথচলায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তাকে। এমনকী তার এই অত্যন্ত নাজুক সময়ে দুজন রাজনীতিবিদ তার অশুভ কামনা করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। লেবার পার্টির লিডস কাউন্সিলের কাউন্সিলার জুলি হেসেলউড প্রধানমন্ত্রীর আইসিইউতে যাওয়াকে জনগণের সমবেদনা পাওয়ার প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন। ডার্বিশায়ারের এক কাউন্সিলের আরেকজন লেবার কাউন্সিলার ও কাউন্সিল মেয়র শিলা ওউকস ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘করোনাভাইরাস বরিসের প্রাপ্য ছিল’। এ কথা বলায় যদিও পার্টি তাকে বহিষ্কার করেছে।
অর্থাৎ বরিস জনসন রাজনীতিতে যে খুবই জনপ্রিয়, তা নন। বিশেষত এনইচএস (জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা) নিয়ে বরিস জনসন কিংবা তার পার্টির অবস্থান মানুষকে আশাহত করেছে আগেও। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে বরিসের ওপর মানুষের নির্ভরতা আছে, এটা বলা যায়। কারণ বন্যায় যখন কোনো প্রাণী ভেসে যেতে থাকে, তখন যা কিছুই পায়, এমনকী খড়কুটো হলেও ভেসে যাওয়া প্রাণী এই খড়কুটোর ওপর নির্ভরতা খোঁজে। করোনাভাইরাসের বর্তমান প্যানডেমিকে তাই বরিসকে মানুষ নির্ভর করেছে। তিনি কিংবা তার সরকার সাধারণ মানুষকে ঘরে বদ্ধ রেখে মারছে না বরং সুরক্ষা দিচ্ছে। এটা উন্নত দেশগুলোর কিংবা একটা সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত। এটা পৃথিবীতে খুব একটা অসাধারণ কিছু না। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পও তা-ই করছেন।
কিন্তু অসাধারণ হলো এই সংকট এবং চরম দুঃসময়ে যারা লড়ছে, তারাই মানব সভ্যতার এই বিপন্ন সময়ে ইতিহাসের ভিন্ন অধ্যায়। ব্রিটেনের সরকার জনগণের ট্যাক্সের (কর) অর্থ জনগণের জন্য কাজে লাগাচ্ছে। জনগণের জন্য নতুন নতুন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এতে জনগণের স্বস্তি আছে হয়তো। কারণ রাজনীতির মাঠে এই সিদ্ধান্ত নেয়াই এখন একমাত্র পথ। এদিকে ব্রিটেনের স্বাস্থ্যকর্মীরা জানবাজি রাখছেন। এটাই ছিল এ সময়ের চাওয়া। যা করে যাচ্ছেন ব্রিটেনের স্বাস্থ্যকর্মীরা। দেশের জনগণ থেকে শুরু করে সরকারের প্রত্যেকটি সেক্টরই এনইচএসকর্মীদের অসাধারণ কর্মযজ্ঞের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। এমনকী প্রধানমন্ত্রী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে একই কথা বলেছেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাদের প্রতি।
একজন ডাক্তার কিংবা নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী এই সময়ে ব্রিটেনসহ পৃথিবীর সব দেশেই মানুষ বাঁচানোর সংগ্রামে যুদ্ধরত।ব্রিটেনে এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষ মরেছে ১০ হাজারেরও অধিক। হাজার হাজার কর্মী লড়ছেন লক্ষ লক্ষ আক্রান্ত মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। তা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে অন্তত ৩০ জন স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন, যেখানে আছেন বাংলাদেশের এক মেধাবী ডাক্তার ফয়সলও। ব্রিটেনের মতো দেশটায় এই যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে এই স্বাস্থ্যকর্মী নামক সৈনিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। তাদেরও অপ্রতুলতা আছে, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামে।
মানুষের সেবা দিয়ে বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা এবং সেখান থেকেই ডাক্তার হয়ে ব্রিটেনে আবাস গড়া ডাক্তার আব্দুল মাবুদ চৌধুরী ওরফে ফয়সল ব্রিটেনে এখন বহু উচ্চারিত এক নাম। তিনি যে শুধু একজন ডাক্তার হিসেবে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে দিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তা নয়। তিনি বলতে গেলে ব্রিটেনের জনগণের চোখটাকে আরও বিস্ফোরিত করে গেছেন। মৃত্যুর মাত্র কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কাছে যে আকুল আহ্বান রেখেছিলেন, তা-ই এখন ব্রিটেনের মিডিয়ায় উচ্চারিত হচ্ছে বারবার। ডাক্তারদের সুরক্ষা দিতে প্রাথমিক অবস্থায় ব্যর্থ হয়েছে ব্রিটেন, তা তার জীবদ্দশায় লিখে গেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কাছে আহ্বান করেছেন ব্রিটেনের মানুষকে বাঁচাতে হলে স্বাস্থ্যকর্মীদের বাঁচাতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের বাঁচাতে হলে তাদের সুরক্ষা দিতে হবে।
পৃথিবীর সাথে ব্রিটেনের মানুষও এই মহাদুর্যোগে হাহাকার করছে, আর এ সময়েই ডা. ফয়সলের কথার প্রতিধ্বনি করছেন এনএইচএসকর্মীরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বভাবজাত একগুয়েমির কাছে তা ঠিকছে না। নাগরিকদের সেবায় নিয়োজিত নার্সরা তাদের পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট নিয়ে আবারও মুখ খুলেছেন ডা. ফয়সলের মতো, কিন্তু মন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল তা যেন মানতে নারাজ। তিনি এ নিয়ে বরং সত্য লুকনোর চেষ্টা করেছেন, অস্বীকার করেছেন পিপিইর অপ্রতুলতার কথা। স্বাস্থ্যকর্মীরা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ, কিন্তু তিনি থেকেছেন নির্বিকার। এই সত্যটুকু স্বীকারতো করেননি তিনি, এমনকী দুঃখ প্রকাশটুকু পর্যন্ত করেননি।
অবশ্য প্রীতি প্যাটেল এ রকমই। তেরেসা মে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইসরায়েলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনহীন তার মিটিং নিয়েও কথা উঠেছিল, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল ইসরায়েল থেকে। এমনকী হালে এ মাসের শুরুতে সাবেক পদস্থ কর্মকর্তা স্যার ফিলিপ রুটনামের সাথে অশালীন আচরণ নিয়ে কড়া আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার পরও তিনি টিকে আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। তার আচরণ সমালোচিত হলেও তিনি ররিস জনসনের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন কিংবা পাচ্ছেন এ সময়েও। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, এনএইচএসকর্মী সবার সাথে তার কিছু আচরণ ব্রিটেনের সরকারি নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের আচরণের সংস্কৃতির সাথে যাচ্ছে না বলে মনে করছে এদেশের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোও। এমনকী এদেশের তরুণসমাজও প্রীতির এসব কর্মকাণ্ডে প্রীত নয়।
প্রীতি প্যাটেলের এই সমালোচনামূলক সময়ে বরিস জনসন ব্যক্তি হিসেবে খুব একটা সমালোচিত হচ্ছেন না। তাকে নিয়ে এমনকী তার দলের বাইরের মানুষগুলোও তার ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করেছে। তার সমালোচনায় মুখর নন এখন ব্রিটেনের নাগরিক বরং তিনি উচ্চারিত হচ্ছেন বারবার। ব্রিটেনের এই সংকটকালে তিনি নাগরিকদের নির্ভরতা দিচ্ছেন। এমনিতেই তিনি একজন সফল মানুষ, তিনি এমপি, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন লন্ডন মেয়র হিসেবেও। সাংবাদিক কলামিস্ট হিসেবে তিনি বুদ্ধিজীবী লেবেলে আন্তর্জাতিকভাবেও উচ্চারিত। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার সবচেয়ে বড় সার্থকতা হলো- তিনি ব্রিটেনকে বের করে নিয়ে এসেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে, যা ছিল যুক্তরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চাওয়া।
কিন্তু এ সময়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অর্থাৎ প্রীতি প্যাটেলের এ রকম একগুয়েমি সরকারের জন্য সুনাম বয়ে আনছে না বরং ব্রিটেন তথা পৃথিবীর এই ক্রান্তিকালে সরকারকে প্রশ্নবোধক করছে। লেবার পার্টিতে নতুন নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। লেবার পার্টির এ নেতা করোনাকালে সরকারের কোনো সমালোচনা না করেই নাগরিকদের খাবার বিতরণে প্যাকেট তৈরি করছেন।পার্টির কেউ কেউ বরিস জনসনের অসুস্থতা কামনা করলেও লেবার পার্টি তথা গোটা দেশই জাতীয় দুর্যোগে একাট্টা হয়ে আছে।
এখন প্রত্যেকটা নাগরিকের হৃদয় নিংড়ানো উচ্চারণ একই, জাতীয় ঐক্যই পারে এ দুর্যোগ মোকাবিলা করতে। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে গোটাজাতি। আর সে জন্যই প্রীতি প্যাটেলের এই কর্মকাণ্ডকে ইস্যু হিসেবে না নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে সবাই। কিন্তু করোনাকালের এই উচ্চারিত সত্যগুলোতো আগামীকালের ইতিহাস থেকে মুছে যাবে না। কারণ নাগরিকের হৃদয়ের গহীনে জায়গা করে নিচ্ছে প্যাটেলের এই অবিমৃষ্য উচ্চারণ, যা এ সরকারে ভালো কাজগুলোও করে তুলবে প্রশ্নবোধক।
বরিস জনসন এনএইচএসকে দেনামুক্ত করলেও এনএইচএস অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ব্রিটেনের জমানো ব্যর্থতা গেঁথে রইবে গলার কাঁটা হয়েই। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের কাছে করোনা নত হলেও বরিস জনসন প্রশ্নবিদ্ধই থাকবেন এনএইচএস প্রশ্নে, আর সে কারণে দায়ভার তার একটু বেশিই থাকবে ব্রিটেনের হাজার হাজার মৃত্যুর। অন্তত ডা. ফয়সলের ১১ বছরের কন্যা ওয়ারিশা ও ১৮ বছরের পুত্র ইনতিসারের পাহাড়সমান বেদনাকে তিনি ঢাকতে পারবেন না কোনো নীতিকথা দিয়েই। কারণ তারা তখনও বরিস জনসনের কাছে তাদের পিতার সেই চিঠির উত্তর চাইবে, চাইব আমরাও অগণিত মানুষ, স্বাস্থ্যকর্মীরা তো চাইবেই।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম