করোনা ভাইরাসে পুরো বিশ্ব যখন ভোগছে তখন বিশ্বের নানাদেশ তাদের দেশের মানুষ এবং প্রবাসিদের প্রণোদনা দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের জন্য বিশাল অংকের প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। ঘোষিত প্যাকেজে প্রথমে প্রবাসিদের প্যাকেজ না থাকলেও গতকাল ২০০ কোটি টাকার প্রণোদনার খবর পেয়ে প্রবাসিরা আশায় বুক বেঁধেছেন। আশার সাথে তারা ভোগছেন এখন যন্ত্রণায়ও। সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশে চেয়ারম্যানদের চাল চুরির ঘটনায় তারা নিজেদের বেলায়ও শংকায় ভোগছেন। দেড়কোটি প্রবাসিদের ৩ কোটির চোখের স্বপ্ন সুষ্ঠভাবে যেন প্রবাসিদের মাঝে বণ্টন করা হয় প্রণোদনার টাকাগুলো। অবশ্য, সচেতন প্রবাসিরা বলছেন প্রবাসিদের কোন টাকা কোনদিন মেরে খাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি, এবেলাও তা হবে না। তবে দ্রুত এটি কার্যকর করে প্রবাসিদের টিকিয়ে দেশের রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি করতে অনুরোধ করেছেন তারা।
-
বর্তমান সরকার প্রবাসি বান্ধব। সরকার প্রবাসবান্ধব কাজে নজির তৈরী করেছেন। প্রবাসিদের মরদেহ দেশে প্রেরণ, রেমিটেন্সে ২ ভাগ প্রণোদনা সহ নানা কর্মকাণ্ড প্রশংসার ব্যাংকবাড়ি ফুলে ফুলে শোভিত হয়েছে। প্রবাসিরাও নজির তৈরী করেছেন বৈধপথে টাকা পাঠিয়ে। গড়েছেন সর্বকালের সেরা রেকর্ড। গত (জুলাই-ডিসেম্বর) ৯৪০ কোটি ১২ লাখ (৯.৪ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসিরা। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। আর ২০১৯ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে ১৬৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। এক মাসের হিসাবে বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছে এই ডিসেম্বরে। আর রেমিটেন্স প্রবাহের এই ইতিবাচক ধারায় রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কার পরও বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে আমরা জেনেছি, প্রবাসিদের জন্য ২০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ আসছে বলে জানা গেছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এই প্রণোদনার ব্যবস্থা করছে। জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে এই টাকা নেওয়া হবে। কোন প্রক্রিয়ায় নেওয়া হবে এবং কোথায় কিভাবে বিতরণ করা হবে সে বিষয়ে একটি পরিকল্পনা এরইমধ্যে চূড়ান্তের পথে।
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন জানিয়েছেন, প্রবাস থেকে ফেরত আসা কর্মীদের সহায়তার জন্য তাদেরকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হবে। যাতে করে এই টাকা দিয়ে তারা দেশে কিছু একটা করতে পারেন। প্রথম পর্যায়ে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হবে। এই ঋণের সুদ হবে ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে। শুধু তাই নয় ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে কোনো জামানত লাগবে না বলেও প্রস্তাব রাখছে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বিশ্বের দেশে দেশে প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। এদের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখের মতো কর্মী করোনাভাইরাসের প্রভাবে নানা সংকটে আছে। এরইমধ্যে অনেকেই খাদ্য সংকটে আছে। বিভিন্ন দূতাবাস বাংলাদেশি কর্মীদের তালিকাও নিচ্ছে। তবে যেই পদ্ধতিতে নিবন্ধন করা হচ্ছে তা কর্মীদের জন্য পুরোপুরি সহায়ক নয়। এই কর্মীদের খাবার সহায়তার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে এরইমধ্যে ৪ কোটি টাকার বেশি সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, নতুন সহায়তা প্যাকেজ মূলত বিদেশফেরত কর্মীদের জন্য। করোনাভাইরাসের প্রভাবে এরইমধ্যে যারা ফেরত এসেছেন এবং যারা ফেরত আসবেন, তাদের জন্য এই সহায়তা প্যাকেজ আনতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এই ২০০ কোটি টাকার সাথে শিগগিরই আরো অর্থ যুক্ত হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। প্রবাসীদের কল্যাণে সরকারের এটি বড় ধরণের প্রণোদনা বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
-
বেসরকারি হিসেবে দেশের দেড় কোটি মানুষ প্রবাসি। একজন প্রবাসি গড়ে ৫ জন মানুষকে বরণ পোষণ করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে সাত কোটি। ঠিক মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে দেশের নাগরিক সংখ্যা। অথবা অন্যভাবে বলা যায় দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষের বরণ পোষণ চালাচ্ছে প্রবাসিরা। আমরা পরখ করলে দেখি রেমিটেন্স পাঠানোতে শীর্ষে আছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ দেশগুলোর প্রবাসিরা বেশিরভাগ নিম্ন আয়ের। বর্তমান সময়ে অনেকে কর্মহীন। তারা না প্রবাসে খাবার পাচ্ছেন আবার তাদের পরিবারের লোকজনও পারেছে না ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে। দেশের মানুষের কাছে প্রবাসি মানে টাকা আয়ের মেশিন। তাই তাদের পরিবারের লোকদের ত্রাণ দিতেও চান না অনেকে। আবার সামাজিক মাধ্যমে ছবি তুলে পোস্ট দেওয়া তথা লোক লজ্জার ভয়ে অনেক প্রবাসির পরিবারও ত্রাণ নেয়া থেকে বঞ্চিত। অথচ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এসব মানুষের আহাজারি আকাশ বাতাসে ধ্বনিত হয়।
করোনা মহামারির বিপর্যয় কাটলেও অনেকের চাকরি চলে যাবে। প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি অনেক ছোটখাটো ব্যবসায়িও হবেন দিশেহারা। বাংলাদেশের ব্যবসায়িদের প্রধানমন্ত্রী যেমন সাড়ে ৯ ভাগ সুদে ঋণ ঘোষণা করেছেন তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসিদের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক জনতা, সোনালি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দিলে ব্যবসায়িরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন। সেই সাথে প্রবাসিদের প্রণোদনার যে ২০০ কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে তা হয়তো ৭০ লাখ প্রবাসিকে দিলেও চলবে তবে এ জন্য সুষ্ঠভাবে বণ্টন আর সহজভাবে প্রদান করা সময়ের দাবি।
মধূসূধন দত্তের মতো বললে অথবা শঙচিল পাখির ডানার ভাষা বুঝা মানুষেরা জানেন নিজ দেশের জমিন পাড়ি দিলে বুঝা যায় দেশ কতো আপন। তাইতো একজন অক্ষরজ্ঞান মানুষও প্রবাসে থেকে দেশকে ধারণ করেন তাদের মধ্যে দেশপ্রেশ অনুকরণীয়। সারাদিন রোদে পুড়ে জ্বলে টাকা পাঠায় দেশে। আবার দেশের অনেক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষও দেশের টাকা চুরি করে পাচার করে বিদেশের ব্যাংকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসিদের অর্থনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করেছেন। দিয়েছেন আমাদেরকে সম্মান। আমরা প্রবাসিরা আশা করি প্রধানমন্ত্রী তদারকি করলে এ টাকাগুলো পৃথিবীর নানাদেশের অসহায় প্রবাসিরা তাদের ঘুরে দাঁড়াবার কাজে ববহৃত করতে পারবেন। কথা দিচ্ছি আমরা, দেশের উন্নয়ন যাত্রা অব্যাহত রাখতে আমাদের রেমিটেন্স অব্যাহত থাকলে দেশ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা কায়মনে বলি ‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন, এই দেশেতে মরি’। আবার সমকণ্ঠে বলবো সবাই–‘বাংলাদেশ জ্বলে পুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়….
লেখক: বার্তা সম্পাদক, ৫২ বাংলা টিভি এবং জাতীয় গণমাধ্যম একাত্তর টিভিতে কর্মরত।