আমরা সবাই আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার ক্যামেরায় আমাদের গোটা মানব দেহসত্তা এবং রুহ বন্দি! আমরা রঙিন ভুবনে কোথায় লাফালাফি করছি; মৃত্যু এমন এক বাস্তবতা, যার থেকে কেউ পলায়ন করতে পারবে না। প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। কোথায় কখন কোন অবস্থায় কাফন, দাফন, জানাজা হবে কি না, তা-ও জানি না। আমার ভবিষ্যত্টা কী হবে, তা-ও জানি না, তাহলে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি আমি আবার কে? আমি হলাম ওই ব্যক্তি যে আমার নিয়ন্ত্রণে কিছুই নেই, সব নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার। আল্লাহপাক বলেন, হে নবী আপনি বলে দিন, মৃত্যু, যার থেকে তোমরা পলায়ন করছ, অবশ্যই সেই মৃত্যু তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের পাকড়াও করবেই যদি তোমরা সূর্যে দুর্গে অবস্থান করো। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, প্রতিটি জাতির মৃত্যুর জন্য একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে, যখন আল্লাহর নির্দেশে নির্ধারিত সময় চলে আসে তখন তার থেকে এক মুহূর্তও সামনে-পিছে আল্লাহপাক ছাড়া কারো কিছু করার ক্ষমতা নেই!
এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীটা যাকে নিয়ে তোমরা স্বপ্ন দেখছ, এই স্বপ্নের পৃথিবীটাও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে! কিয়ামতের সময় যখন নিকটবর্তী হবে তখন আল্লাহপাক তাঁর নিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতাকে সিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়ার আদেশ দেবেন। অতঃপর ফেরেশতা সিঙ্গায় ফুৎকার দেবেন। ফলে পৃথিবী ও পাহাড়গুলো উত্তোলিত হয়ে যাবে, পাহাড়গুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে এবং তারকাগুলো ঝরে পড়বে, সূর্য তার কিরণ হারিয়ে ফেলবে, সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলা হবে! সেদিন কিয়ামতের ভূমিকম্প ও কিয়ামতের ভয়ংকর অবস্থা দেখে সবাই মৃত্যুবরণ করবে। প্রত্যেক প্রাণীর যেমন দেহ আছে, ঠিক তেমনি পৃথিবীর দেহটা হলো আসমান ও জমিন এবং এর মধ্যে যে বায়ু প্রবাহিত হয় কনকন করে সেটা হলো পৃথিবীর রুহ। সেদিন পৃথিবীর দেহটাও মুছে যাবে। পুরো পৃথিবীটা আল্লাহপাকের কাছে এমন ক্ষুদ্র যে ফেরেশতা জিবরাইলের দুই ডানাতে পৃথিবীটা একটা হাতের তালুর মতো!
আল্লাহপাক বলেন, হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, নিশ্চয় কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর বিষয়। সেদিন তোমরা দেখবে প্রত্যেক স্তন্যদানকারিণী আপনভৃত পোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে! এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে! শুধু দেখবে মানুষকে পাগলের মতো, আসলে ওরা পাগল নয়। তবে আল্লাহপাকের আজাবই হবে কঠিন। অতঃপর যখন সিঙ্গায় ফুৎকার করা হবে, মাত্র একটি ফুঁ! আর জমিন, পর্বতমালা উত্তোলিত করা হবে! যখন পৃথিবীর দেহ আসমান বিদীর্ণ হয়ে যাবে, মাত্র একটি আঘাতে সব চূর্ণবিচূর্ণ করা হবে! আসমান ফেটে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে, নক্ষত্রগুলো ঝরে পড়বে, আর যখন সমুদ্রগুলো উত্তাল করা হবে, আর যখন কবরগুলো উন্মোচিত করা হবে তখন প্রত্যেকেই জানতে পারবে যে আল্লাহপাক আগে কী পাঠিয়েছেন এবং পরে কী পাঠিয়েছেন!
কিয়ামতের ভয়াবহতায় আল্লাহপাক বলেন, ‘সেদিন আমি মহান আল্লাহপাক ছাড়া প্রতিটি বস্তু ধ্বংস হয়ে যাবে। সেদিন আসমানের নিচে এবং জমিনের ওপর যা কিছু রয়েছে, সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর সেদিন মহামহিম ও মহানুভব আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা থাকবেন।’ তাফসিরে ইবনে কাছিরে বর্ণিত আল্লাহপাকের নির্দেশে যখন ইসরাফিল (আ.) সিঙ্গায় ফুৎকার দেবেন তখন সবাই মরে যাবে! আল্লাহপাক মালাকুল মাউতকে জিজ্ঞেস করবেন, আর কে মৃত্যুর বাকি আছে? তখন মালাকুল মাউত আজরাইল বলবেন, হে আল্লাহ, মৃত্যুর বাকি রয়েছেন হজরত জিবরাইল, মিকাইল ও আরশ বহনকারী ফেরেশতারা। তখন আল্লাহপাক মালাকুল মাউতকে নির্দেশ করবেন যে জিবরাইল, মিকাইল ও আরশ বহনকারী ফেরেশতাদেরও মরতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সব ফেরেশতা মারা যাবেন। অতঃপর আল্লাহপাক মালাকুল মাউত আজরাইলকে জিজ্ঞেস করবেন মৃত্যুর বাকি আর কে আছে? তখন মালাকুল মাউত বলবেন যে আল্লাহপাক আপনি এবং আমি মালাকুল মাউত আজরাইল বাকি আছি! তখন মালাকুল মাউত আল্লাহকে বলবেন, হে আল্লাহ, আপনি হলেন চিরঞ্জীব। তখন আল্লাহপাক মালাকুল মাউত আজরাইলকে বলবেন যে হে মালাকুল মাউত আজরাইল, তুমিও মরে যাও। কেননা তুমিও আমার মাখলুক। তৎক্ষণাৎ সব ফেরেশতাও মারা যাবেন।
শুধু চিরঞ্জীব আল্লাহপাক এক, এই হলো আল্লাহপাকের একত্ববাদের পরিচয়। অতঃপর আল্লাহপাক জমিনকে ভাঁজ করে ফেলবেন এবং আল্লাহপাক তিনবার বলবেন, আনাল জাব্বার, আনাল জাব্বার, আনাল জাব্বার। আল্লাহপাক হুংকার করে বলবেন, ‘আমিই প্রতাপশালী, আমিই প্রতাপশালী, আমিই প্রতাপশালী।’ অতঃপর আল্লাহপাক তিনবার জিজ্ঞেস করবেন, লিমানিন মুলকিল, ইয়াত্তম, আজকের রাজত্ব কার? আজকের সার্বভৌমত্ব কার? আজকের আধিপত্য কার? উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। অতঃপর মহান আল্লাহ নিজেই উত্তর দেবেন, ‘নিল্লাহিল্লা ওয়াহিদিল ক্বাহার। আজকের রাজত্ব, আজকের সার্বভৌমত্ব, আজকের আধিপত্য পরাক্রমশীল একমাত্র আমি আল্লাহর!’ রাসুলে করিম (সা.) বলেন যে কিয়ামতের দিন আল্লাহপাক সমগ্র পৃথিবীর দেহ জমিন ও আসমানকে নিজ হাতে ভাঁজ করে নেবেন। অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা অহংকার করে বলতে থাকবেন, ‘আনাল মালিক, আনাল জাব্বার, আনাল মুতাকাব্বির, আমিই প্রভু, আমিই প্রতাপশালী, আমি একমাত্র আল্লাহপাকই অহংকারী।’ সেদিন আল্লাহপাক বলবেন, পৃথিবীর জমিনের রাজা-বাদশাহরা কোথায়? সেদিন কারো কিছু বলার অধিকার থাকবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সেদিন সব মানবজাতিকে মৃত্তিকার কঙ্কালের হাড় থেকে জীবিত করা হবে।
অর্থাৎ পাঁজরের হাড়টাই হলো মানবজাতির Memory card (মেমোরি কার্ড)। দেহের সবই ধ্বংস হয়ে যাবে; কিন্তু মানবজাতির ওই হাড়টা ধ্বংস হবে না, সুবহানাল্লাহ! মহান রাব্বুল আলামিন সেদিন পাঁজরের ওই হাড়ে একবিন্দু পানি দ্বারা আবার মানবজাতিকে রুহ এবং দেহ দিয়ে সৃষ্টি করবেন। যেমন পৃথিবীতে মানবজাতিকে একবিন্দু পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, তেমনি রাব্বুল আলামিন একবিন্দু পানি দ্বারা জীবিত করে মানবজাতিকে কবরের জীবন থেকে ওঠাবেন! তখন মানবজাতি বলবে, হে আল্লাহ, আমরা তো ঘুমে ছিলাম। এখন বিশাল এক ময়দানে চলে আসছি! কিয়ামতের সেই মাঠে কেউ কাউকে চিনতে পারবে না। সন্তান, স্ত্রী, মা, বাবা ভাই-বোন কেউ কাউকে চিনবে না। এমনকি নবীয়ে করিম (সা.) ছাড়া সব নবী বলবেন, ইয়া নাফছি, ইয়া নাফছি। সব নবী বলবেন, হে আল্লাহ, শুধু আমি বাঁচতে চাই। আমরা সন্তান-স্ত্রীর বিষয়ে কিছু জানি না। প্রিয় পাঠক, শুধু রাসুলুল্লাহ (সা.) বলবেন, ইয়া উম্মাতি। আসলে পৃথিবীর জীবনটা খুব অল্প কয়েক দিন। ভয়ংকর দিবস হলো কিয়ামত। সেদিন আল্লাহপাকের ভয়ে কম্পন শুরু হয়ে যাবে। আসুন, আমরা সবাই আল্লাহপাকের ধ্যানে মগ্ন হয়ে যাই।
লেখক : ফ্রান্স প্রবাসী, সাবেক ইমাম ও খতিব, জাতীয় সংসদ মসজিদ