মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হয়েছে । মহানবী (সাঃ) বলেছেন , যখন আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেন, তখন তা দুলতে থাকে । তারপর তিনি পর্বতমালা সৃষ্টি করে তার উপর তা স্থাপন করেন । ফলে পৃথিবী স্থির হয়ে যায় । ফেরেশতারা পর্বতমালা দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন, হে আমাদের প্রতিপালক আপনার সৃষ্টির মধ্যে পর্বত থেকে মজবুত কি কিছু আছে ? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ, তা হলো- লোহা । ফেরেশতারা আবার প্রশ্ন করেন, হে আমাদের প্রতিপালক আপনার সৃষ্টির মধ্যে লোহা থেকে মজবুত কি কিছু আছে ? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ আছে, তা হলো -আগুন । ফেরেশতারা আবার প্রশ্ন করেন, হে আমাদের প্রতিপালক আপনার সৃষ্টির মধ্যে আগুনের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কি কোনো কিছু আছে ? আল্লাহ বলেন, আছে, তা হলো- বাতাস । ফেরেশতা প্রশ্ন করেন, হে আমাদের রব, আপনার সৃষ্টির মধ্যে বাতাসের চেয়ে অধিক প্রবল কি কিছু আছে ? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ আছে, তা হলো- আদম সন্তান ।
এই আদম সন্তান হলাম আমরা যারা বিবেক,বুদ্ধি, মানবিকতার চেতনায় প্রাণীকুলের মধ্যে সুস্পষ্ট আলাদা এবং শ্রেষ্ঠ । প্রাণীকুলের মধ্যে আল্লাহ যে আমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন তার জন্য এই পৃথিবীতে আমাদের দায়িত্ব সীমাহীন। এই পৃথিবীতে আল্লাহ আদম সন্তান কর্তৃক কোনো মানুষ বা কোনো প্রাণী ও প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হোক আল্লাহ চান না ।
আমরা যে সৃষ্টির সেরা তা এযাবত কালের হাজারো ঘটনা তা প্রমাণ করে । কিন্তু মাঝে মধ্যে কিছু কিছু মানুষ বা মানব গুষ্টি দ্বারা সংগঠিত ঘটনা আমাদেরকে লজ্জিত করে। তাদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনায় মনে হয়- আল্লাহ্র সৃষ্টির সেরাদের মধ্যে কিছু নিকৃষ্ট মানুষের বসবাস রয়েছে ।
পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় সংগঠিত ঘটনা তা প্রমাণ করে । আজকের দিনে এই পৃথিবীতে ভয়াবহ করোনা ভাইরাস কর্তৃক আক্রান্ত মানুষ জাতির এই দুঃসময়ে কারো কারো ভূমিকায় শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় যেমন পেয়েছি। তেমনি কারো কারো ভূমিকায় নিকৃষ্টতার পরিচয় ফুটে উঠেছে ।
বর্তমান সময়ে এই পৃথিবীতে মানব জাতির উপর যে বিপদ এসেছে, করোনা নামক ভাইরাসের প্রভাবে মানুষ যখন দিশেহারা, পৃথিবীর মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর যখন এর প্রতিষেধক তৈরী করতে যেখানে এখনও ব্যর্থ, চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নত পৃথিবীর রাষ্ট্র প্রধানরা যখন হতাশায় ডুবে আছেন। তখনই অনেক মানুষ তার মানবিকতা তাড়নায় করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা জেনেও একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করল মানুষের মানবিকতার শ্রেষ্ঠত্ব ।
দুই
আমরা সকলেই জানি করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা । এই ভাইরাস একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়, যার এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনো চিকিৎসা নেই । একজন থেকে অন্যজনে ছড়ালে মৃত্যুর চরম ঝুঁকি রয়েছে । এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলোর সরকার যখন উপলদ্ধি করছে ছোঁয়াচে এই রোগ থেকে জনগণকে বাঁচাতে হলে লকডাউনের বিকল্প নেই । তাই বিভিন্ন দেশের সরকার লকডাউন করতে বাধ্য হয়েছে । জনগণকে নিজ ঘরে আবদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে । একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাহিরে যেতে নিষেধ করেছে । এই পরিস্থিতিতে বৃটেন যখন লকডাউন ঘোষণা করে, তখন থেকে নিজে ঘরের মধ্যে বন্দি অবস্থায় রয়েছি।
টিভি এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের বদৌলতে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা উপলদ্ধি করে ব্রিটেন লকডাউন পূর্বে নিজের পরিবারের জন্য প্রায় মাস দিনের খাদ্য মৌজুত করেছি । সেদিন থেকে নিজের নিরাপত্তার জন্য গৃহ বন্দি হয়েছি, এই বন্দি থেকে নিজেকে একজন অপরাধী ভাবতে শুরু করেছি। ভাবনায় আসে আমি মানবিক, আমি সৃষ্টির সেরা জীব, আমার কি গৃহবন্দি হয়ে থাকা যৌক্তিক ? আমার কি দায়িত্ব নেই- এই অসহায় মানব জাতির দুরর্দিনে তাদের পাশে থাকার ?
পরক্ষণে আবার ভাবনায় আসে, সরকারি ঘোষণা মোতাবেক ঘরের বাহিরে থাকাটা অযৌক্তিক । এই যৌক্তিক আর অযৌক্তিকতার মধ্যে দোলাচল খেতে খেতে ঘরে বসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বদৌলতে বিভিন্ন পন্থায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিত্র দেখে নিজের বিবেককে গৃহের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে মানবিক হতে প্রভাবিত করে।
যে কয়েকটি ঘটনা আমাকে মানবিক হতে প্রভাবিত করে তার মধ্যে একটি হলো- আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী বর্তমান আমেরিকা প্রবাসী ছালমা বেগমের মেয়ে রেজওয়ানা ফারুক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবার একটি চিত্র। সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজের আমাদের কলেজ জীবনের সহপাঠীদের “সাথী ৮৮” নামে একটি Whatsapp গ্রুপ রয়েছে যা আমাদের মধ্যে যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই গ্রুপে সম্প্রতি আমেরিকা প্রবাসী ছালমা বেগম তার মেয়ে, পেশায় ফিজেসিয়ান রেজওয়ানা ফারুকের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানকালীন তোলা একটি ছবি আমাদের “সাথী ৮৮” গ্রুপে আপলোড করে আমাদের সকল সহপাঠীদের কাছে তার মেয়ে সুস্থ থাকার জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন। রেজওয়ানা ফারুকের এই ছবিটি আমার কাছে বিশাল এক মানব গুষ্টির মানবিকতার প্রতিকীচিত্র ফুটে উঠেছে।
আমরা সকলেই জানি, করোনা ভাইরাস একটি ছোঁয়াচে রোগ । যা একজন থেকে অন্যজনে বিস্তার করে। এই রোগ কারো গায়ে ছড়ালে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে । এই মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও বর্তমানে পৃথিবী ব্যাপি লক্ষ লক্ষ ডাক্তার, নার্স কেয়ারার এই পেশায় নিয়োজিত থাকাকে হয়ত অনেকে ভাবতে পারেন তাদের চাকরি রক্ষা আথবা টাকার রুজগারের জন্য তারা কাজ করছেন। অথবা তাদের দায়িত্ব পালন করতে তারা বাধ্য হয়েছে । আমাদের মধ্যে অনেক অমানবিক চিন্তার মানুষ রয়েছেন; তারা তা ভাবতেই পারেন।
মৃত্যু যেমন আমরা ভয় পাই, তেমনি ডাক্তার, নার্স, কেয়ারার-রাও ভয় পায় । আমরা যেখানে করোনা ভাইরাসের ভয়ে ঘরের কোণে নিজেকে আড়াল করে বসে আছি, সেখানে মৃত্যুর ভয় তোয়াক্কা না করে একজন মৃত্যু পদযাত্রী রোগীকে সেবা দান করা একমাত্র মানবিকতা সম্পূর্ণ মানুষের পক্ষে সম্ভব; অন্য কারো নয়। এবং এই মানবিক মানুষগুলোর মতো
তারাও মানবিক যারা তাদের নাড়িছেড়া ধন প্রিয় সন্তানকে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকার পরও মানবসেবায় যেতে তাদের সন্তানদের উৎসাহিত করেন । করোনা মহামারিতে চিকিৎসা সেবায় যুক্তদের সাথে তাদের বাবা-মা, যারা সন্তানদের মানুষের সেবা দানের জন্য শিক্ষা দিয়েছেনএবং এই কাজে এখনও তাদের অনুপ্রাণিত করছেন সেই সব বাবা -মাদের প্রতি সেল্যুট এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
বর্তমান সময়ে ডাক্তারদের সেবাদান শুধু আমাকে মানবিক হতে অনুপ্রাণিত করেনি। এই দুর্যোগ মুহূর্তে সর্বসাধারণে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে যেসব স্বেচ্ছাসেবক দল নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন তাদের কর্ম আমাকে মানবিক হতে অনুপ্রাণিত করে ।
তিন.
এই দুরর্দিনে সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে গতকাল আমার চাচা ডাক্তার আলাউদ্দিন আহমদ সাহেবকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম বর্তমান অবস্থায় তাদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে। আমার চাচা যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরের ওয়ানষ্টেডে থাকেন। তার বয়স বর্তমানে চৌরাশি বছর । এই বয়সে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের দৈনন্দিন বাজার খরচ করা কষ্টকর। তিনি বল্লেন, দৈনন্দিন খরচাদির ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হচ্ছে না। ইস্ট লন্ডন ভিত্তিক একটি ভল্যান্টরি বাঙ্গালী গ্রুপ তাদের সাথে যোগাযোগ করে এ পর্যন্ত দু-দিন তাদের সম্পূর্ণ খরচাদি করে দিয়েছে । তাদের কাছে খরচের তালিকা ফোনে পাঠালে, তারা খরচ করে ঘরের দরজার সামনে রেখে দিয়ে যায়। তারা কোনো ডেলিভারি খরচ নেয় না । চাচার কাছে জানতে চাইলাম এই মানুষগুলো কারা ? তিনি তাদের পরিচয় বলতে পারেন নি ।
এই মানবিক কাজে নিয়োজিত মানুষগুলোকে জানতে আমার আগ্রহ জাগে । ইতিপূর্বে কবি ও সাংবাদিক ছোটভাই আনোয়ারুল ইসলাম অভির কাছ থেকে এধরনের একটি স্বেচ্ছাসেবক দলের নাম শুনেছি । তাদের অনেকেই আমার নিকটজন। আমি এই গ্রুপের অন্যতম একজন- দেলোয়ার হুসেন দিলুকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম -তারা কি ইস্ট লন্ডনের কোন স্বেচ্ছাসেবী দলের সদস্য কি না। তারা কি আমার চাচা সহ অন্যদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে ? সে স্মিত হেসে বলল, স্বেচ্ছাসেবী এইকাজটি তাদের গ্রুপ ভলন্টিয়ার মেটারর্স কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে ।
তাদের এই মানবিক কাজের সূচনা কিভাবে শুরু এবং এর সাথে কারা সম্পৃক্ত তা জানতে চাইলে দেলওয়ার হোসের দিলু জানায়- এই গ্রুপের প্রায় সকলেই বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। সূচনালগ্নে দেলোয়ার হোসেন দিলু ও মুজাহিদুল ইসলাম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করে । পরবর্তীতে ব্যারিষ্টার আবুল কালাম চৌধুরী ও আব্দুর রহমান সিমু’র সাথে পরামর্শ করে তারা এই মানবিক কাজের যাত্রা শুরু করে। এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের সাথে এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন শহরে স্বেচ্ছাসেবি হিসাবে কাজ করছেন ষোল জন স্বেচ্ছাসেবি। করোনা পেনডামিক সময়ে মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে কাজ করা সদস্যরা হলেন – আবিদুর রহমান শিমু ( রেডব্রিজ ),ব্যারিষ্টার আবুল কালাম চৌধুরী (ইলফোর্ড),দেলওয়ার হোসেন দিলু ( টাওয়ার হ্যামলেটস),মুজাহিদুল ইসলাম ( টাওয়ার হ্যামলেটস ),ইমরান আহমেদ ( টাওয়ার হ্যামলেটস ),মিছবাহ রহমান ( নর্থ ওয়েস্ট লন্ডন), কাইয়ুম (কার্ডিফ সেন্টাল), শাহ আলম ( নিউকাসেল ),ফৈয়াজ আলী ( ওয়েস্ট ব্রোমউইচ),মো.মারুফ হোসেন (বার্মিংহাম), এডভোকেট গুলাম মোস্তফা ( ম্যানচেস্টার),মোহাম্মদ খান (ওয়েল ব্রমচান),মো. কামরুল ইসলাম (এসেক্স,),সাব্বির আহমদ (ডেগেনহ্যাম),সিরাজ আহমেদ ( কেন্ট ট্রেফ্রড) নজরুল হক (ওয়েস্টার)।
করোনা মহামারিতে মানুষের দুরর্দিনে তাদেরকে স্বেচ্ছাসেবি হিসেবে কাজ করতে দেখে আমাকে আরো মানবিক হতে শিখায় । তাদের কর্মে ফুটে উঠে মানুষের মানবিকতা ও মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ।
চার.
দুর্যোগে মানবিকতার এর বাহিরেও যে আমাদের মধ্যে নিকৃষ্টদের বসবাস রয়েছে তা বর্তমান এই মহাবিপদে প্রমাণিত হয়েছে। ব্রিটেন সরকার যখন করোনার মহামারী সম্ভাবনা আচ করতে পেরে লকডাউনের কথা ভাবছিল তখন, জনসাধারণের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি হয়। মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী কিনতে ব্যস্ত হলে এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর দাম দুই থেকে তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফা অর্জনে লিপ্ত হয়ে যায় আমাদের কিছু বাঙ্গালী ব্যবসায়ীরা। এই সুযোগ সন্ধানী অবৈধ মুনাফাখোররা দৈহিক দিক দিয়ে মানুষের মত হলেও এরা মানুষ কি না সন্দেহ রয়েছে । তবে আশার কথা হলো- এই সমস্ত অমানবিক ব্যবসায়ীদের কর্ম তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন আরেক মানবিক মানুষ, ব্রিটেনের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এস এর ফাউন্ডার চেয়ারম্যান মাহি ফেরদৌস জলিল। চ্যানেল এস টিভি তে ধারাবাহিক সংবাদ পরিবেশন এবং মাহি ফেরদৌস জলিলের উপস্থাপনায় প্রচারিত রিয়্যালিটি ইউথ মাহি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়- লোভী ব্যবসায়ী অমানুষদের। লন্ডনে মূলত তার কন্ঠে চ্যানেল এস এর প্রতিবাদই পরবর্তীতে বাঙ্গালী সুযোগ সন্ধানী অবৈধ মুনাফাখোরররা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
শুধু বাঙ্গালী খাদ্য সামগ্রী ব্যবসায়ীরা এই অমানবিক কাজটি করেনি। তাদের সাথে রয়েছে কিছু অমানবিক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ব্যবসায়ীরা। রেস্টুরেন্টে কর্মরত যেসমস্ত স্টাফ এর নিজস্ব ঘর নেই অথবা তাদের কাজ করার কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। যারা ব্রিটেনে লকডাউনের পূর্বে সম্মানে সাথে রেস্টুরেন্ট স্টাফ হিসাবে পূর্ণ বেতন পেয়ে কর্মস্থলে রাত যাপনের সুযোগ সুবিধা পেয়েছে। লকডাউনের পর ব্রিটেনের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে এইসব স্টাফদের করোনা দুর্যোগের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক রেস্টুরেন্টের মালিক অল্প বেতনে কাজ করতে বাধ্য করছেন ।
আল্লাহ এই পৃথিবীতে মাঝে মধ্যে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেন তা থেকে মানব জাতি শিক্ষা নেয়া এবং হেদায়েত পথ অনুসরণের ইংগিত করেন। এই সমস্ত ইঙ্গিত মানব সমাজে বসবাসকারী মানবরুপি কিছু অমানুষদের হয়তো উপলদ্ধিতে আসে না।
পাচ.
সব ব্যবসায়ী যে অমানবিক তাও নয় । ব্রিটেনে লকডাউনের পূর্বের রাত প্রায় একটার সময় যখন আমি ঘরে ফিরছি কাজ থেকে।তখন আমার স্ত্রী ফোন করে বলেন, একটি ব্রেড নিয়ে আসার জন্য। তখন স্থানীয় সব দোকানপাট প্রায় বন্ধ । দুটি দোকান খোলা দেখে সেখানে একটি দোকানে কোনো ব্রেড না দেখে অন্যটিতে গিয়ে একটি মাত্র ব্রেড পেয়ে ভাবলাম আমি ভাগ্যবান। ঐ একটা ব্রেড নিয়েই যাই । ব্রেডের উপরে দাম লেখা আছে- এক পাউন্ড সত্তর পেন্স। কাউন্টারে টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে দেখি ডেবিড কার্ড ছাড়া পকেটে আছে এক পাউন্ড পঞ্চাশ পেন্স। এটি একটি ছোট দোকান ,এখানে এই অল্প টাকায় কোন কিছু কিনতে নগদে কিনতে হবে বিধায় ব্রেডটি আমি যথাস্থানে রেখে চলে আসতে চাইলে, অবাঙালী দোকানদার আমাকে ডাক দেন। আমি যখন ভাংতি টাকা গুনছিলাম- সে আমাকে দেখছিল।
তিনি আমার কাছে সরাসরি জানতে চাইলেন আমার কাছে কত আছে? আমি বললাম বিশ পেন্স কম আছে। মানবিক ঐ দোকানদার স্মিত হেসে বিশপেন্স এর প্রয়োজন নেই বলে টাকাগুলো তার হাতে দেবার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল- ব্রেডটি নিয়ে যেতে।
খেয়াল করে দেখলাম- আমার বাসা থেকে কাজে যাওয়া আসার একটি রাস্তায় দোকানটি হলেও এই প্রথম এই দোকানে কোন কিছু কিনতে আমার আসা। অতীতে কখনও তার সাথে হাই-হ্যালো-ও হয় নি। কোনভাবে পূর্ব পরিচিতও নই।
লকডাউন সময়ে খাবার সংগ্রহের হিড়িক বা আতংক আমাদের বারায়ও ছিল। এই দোকানে যেহেতু একটি মাত্র ব্রেড অবশিষ্ট ছিল, চাইলে আমাদের বাঙালি অসাধু ব্যবসায়ীদের মত গভীর রাতে তিনগুণ দামে তা দোকানদারে পক্ষে বিক্রি করা সম্ভব ছিল ।
ব্রেড হাতে রাতে বাসায় ফিরতে ভাবলাম হয়তো দোকানদার ভেবেছে যে এই ব্রেডটি সকাল বেলা ক্রেতার বাচ্চারা খাবে, তাই ভেবে হয়ত দিয়ে দিয়েছে। ভোরের দিকে রাতের প্রহর চলে যাওয়ার সময়ে আমার আবেগি ভাবনায় বার বার একটি কথাই দুল খায় – এর নামই ‘মানবতা‘।
ছয়.
বর্তমান এই দুর্যোগ সময়ে ব্রিটেনে প্রায় প্রতিদিন যে মানবিকতার নিদর্শন দেখছি তা দেখে আমি আরো মানবিক হওয়ার চেষ্টায় আছি ।
প্রিয় পাঠক, আমি বিশ্বাস করি সমাজে নগণ্য কিছু মানুষ ছাড়া প্রতিটি মানুষের মানবিক হৃদয় আছে। পরিবার, সমাজে আমরা ভালো কিছু করতে চাই। ভালো কিছুর প্রত্যাশাও করি।
করোনা ভাইরাস জনিত মহামারি সময়ে সমাজের একজন সচেতন মানুষ হয়ে ঘরের কোণে স্বার্থপরের মত বসে না থেকে- আসুন আমাদের যার যার অবস্থান থেকে মানুষের এই মহাবিপদে এগিয়ে যাই । আপনি ,আমি হয়ত ডাক্তার,নার্স কেয়ারার বা উপরে উল্লেখিত ভল্যান্টিয়ার এর মতো ভূমিকা রাখতে পারবো না । কিন্তু সাধ্যমত মানসিক অথবা অর্থনৈতিক সাহায্য করা অবশ্যই সম্ভব ।
আমরা যারা সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবল,সক্রিয় তাদের উচিত আমাদের সমাজের দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো । বিশেষ করে আপনজনদের পাশে ।
প্রবাসে লোকাল কমিউনিটির পাশাপাশি আমাদের জন্মভূমির স্বজন, পরিজনদের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষেরা প্রায় গৃহবন্দি । কেউ কাউকে কাজে রাখছে না । তাদের খেয়ে বেঁচে থাকাটা কষ্টকর। এই অবস্থায় স্বাবলম্বীদের দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
আমরা যারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত দেশে থাকি, তারা রমজান মাস আসলে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে বড় বড় ইফতার পার্টি করে থাকি। করোনা পেনডামিক সময়ে তারা এই বছর ইফতার পার্টি করতে পারবেন না। আমাদের উচিত এখন থেকে প্রস্তুতি নেয়া। প্রতিটি সংগঠন অথবা যার যার অবস্থান থেকে দেশের দরিদ্র মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করে আমরা জানিয়ে রাখি আমরা মানবিক। দুর্যোগে, শোকে আমরা একে অপরের সমব্যাতি। অভাব অভিযোগেও আমরা সমবন্টনে এক থাকতে চাচ্ছি।
আমরা আশরাফুল মাখলুকাত । আমরা সৃষ্টির সেরা জীব ।
ছরওয়ার আহমদ: স্যোসাল এক্টিভিস্ট, সাবেক ভিপি ; বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ।