সব প্রবাসরি মতো আমারও শুরুটা এমন বোধ হয়। একজোড়া চোখের স্বপ্ন নিয়ে অজানায় পাড়ি। সময়টা ২০০৫ এর শেষের দিকের। সকাল থেকেই মেঘাছন্ন আকাশ, টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে বাবনের ভাল ঘুম হয়নি। কারণ অনেক দিনের পোষে রাখা স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে তার। আজ বাবনের ফ্লাইট, জীবনে প্রথমবার পাড়ি দেবে সে প্রবাসে।
অনেক উত্তেজনা কাজ করছে তার মনের মধ্যে। বিমান কত বড় হয়? নীল আকাশের ওই প্রান্ত থেকে কেমন দেখায় নীচের দৃশ্য? কেমনি বা দেখতে হয় বিদেশের মানুষজন- এমনি নানান সব কৌতুহলে ভরা বাবনের মন। গতকাল রাত থেকেই তার মায়ের চোখে জল, কিছুক্ষণ পরই মা রুমে এসে বাবনকে দেখে যায়। আর দুচোখ ভিজে যায় চোখের জলে। বাবনের বাবার মন খারাপ। তার সামনে বেশি একটা আসছে না তার বাবা, তবে একা বসে আছেন বাইরের ঘরে।
বাবনের ছোট ভাই কে.জি স্কুলে পড়ে। প্রবাসে পাড়ি দেয়া কী তা বুঝার মতন বয়স হয়নি এখনো তার। তবে এইটুকুন সে বুজতে পেরেছে যে এইবার বড়দা বাড়ি ফিরবে বহুদিন পর । বড়দা যাচ্ছে অনেক দূরে, যেখানে বিমান ছাড়া যাওয়া যায় না।
উত্তরাধিকার সূত্রে বাবন তার সকল খেলনা-পাতি আর জীবনের প্রথম উপার্জনে কেনা সাউন্ড সিস্টেমটা বুঝিয়ে দিল তার ছোট ভাইটিকে। তখনো যে বাবন জানতনা প্রবাস জীবন কতোটা দীর্ঘ হয়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, সময় এসে গেছে বিদায় জানানোর প্রিয় মুখগুলোকে। এইবার তো মা’কে সামলানো মুশকিল হইয়ে গেল বাবনের। কান্না যে থামছেই না মমতাময়ী মায়ের। বাবন মাকে জড়িয়ে ধরে বলল- মা’ আমি বিদেশ গিয়ে সংসারের সব দুঃখ কষ্ট দূর করে দেব, তুমি শুধু আশীর্বাদ করো, এইবার হাসি মুখে বিদায় দাও মা ।
বিমান বন্দরে পৌঁছে গেছে বাবন, সাথে তার পরিবার। সময় যেনো একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে চলেছে আজ। সবাই বিদায় জানাল বাবনকে শুধু মাত্র তার প্রিয় বন্ধু নীলয় ছাড়া। সকাল থেকেই নীলয়ের মোবাইল বন্ধ। বাবন ভাবছে, যার সাথে শৈশবের এতোগুলো সুন্দর সময় কাটিয়েছি আজ তার সাথেই দেখা হবে না আমার ? বাইরে তখন মুশুল ধারে বৃষ্টি নেমেছে, হঠাৎ বাবন দেখতে পেলো বৃষ্টিতে সারা শরীর ভেজা আর হাতে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের প্যাকেট নিয়ে নীলয় এগিয়ে আসছে তার দিকে। কাছে এসে প্যাকেটা হাতে দিয়ে বলল দোস্ত তোর জন্যে একটা ঘড়ি কিনেছি তুই হাতে পড়িস তাহলে আমার কথা মনে থাকবে। তোকে অনেক মিস করবো, ভাল থাকিস আর পৌঁছে আমাকে কল করিস। কিছু সময়ের জন্নে থমকে গেল বাবন, আর মনে মনে ভাবছিল- হাইরে কি ফেলে রেখে যে প্রবাসে যাচ্ছি আমি।
নীলয়ের মুখটা শুকনো হয়ে আসল কারণ বাবনের যে এবার যাবার সময় হইয়ে এল। কিছুটা মুচকি হেসে বাবন নীলয়কে বলল, আরে বেটা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটা মনে নাই তোর? “থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,- কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে”।
সব ভালোবাসা আর প্রিয় মুখগুলোকে ফেলে বাবন পাড়ি দিল প্রবাসে। পরিবার, স্বজন, বন্ধু বিহীন এক জায়গার নাম প্রবাস। সুখ কিনতে গিয়ে জীবনের সুখটাই বিক্রি করে দেয়ার নাম প্রবাস। হাজারো কষ্টের মাঝেও সুখ- দুঃখ বিসর্জন দিয়ে বছরের পর বছর কাটানোর নাম প্রবাস। নিজের ঘামের ঘ্রাণের টাকা দেশে পাঠিয়ে স্বজন আর দেশকে ভালো রাখার অনুভূতি কতো মধুর। আজো রাতের বেলায় বালিশে মাথা রেখে বাবন গুনগুন করতে থাকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদ এর কিছু লাইন-
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে!
আর কি হে হবে দেখা?
লেখক: সানি মজুমদার, আবুধাবি, ইউ এ ই