মহাদুর্যোগে মানুষকে এভাবেই একটা গুষ্টি হতে হবে। একজন নয়, সমষ্টি হতেই হবে, দেশ কিংবা একক জাতি নয়, হয়ে উঠতে হবে মানব জাতিতে। ব্রিটেন এখানেই যেন সামষ্টিক হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিসত্তা থেকে বেরিয়ে যেন ব্রিটেন এক আত্মা হয়ে গেছে এই মহাদুর্যোগে। করোনার বিভীষিকা ব্রিটেনে মানবিক বোধকে এতটুকুও এককেন্দ্রিক করতে পারেনি। মৃত্যুভয়ে ভীত আছে মানুষ। কিন্তু এরপরও তো জীবনের স্পন্দন আছে।
ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল একজন সেবিকা ছিলেন। ইতালিতে জন্ম নেয়া এই নার্স ক্রিমিন যুদ্ধে একজন ‘হিরো’ হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলে দুই বছর পাঁচ মাস অথচ এই যুদ্ধে তিনি ছিলেন না কোনো যোদ্ধা। শুধু যুদ্ধাহত সৈন্যদের সেবা করেই তিনি পৃথিবীর পথপ্রদর্শক এক নার্স হয়ে উঠেছিলেন। পরিচ্ছন্ন পরিবেশই বাঁচিয়ে দিতে পারে অনেক জীবন, ক্রিমিন যুদ্ধকালীন সময়ে তা-ই দেখিয়েছেন ফ্লোরেন্স। ১৭ বছর বয়স থেকেই সংগ্রাম করে যে তরুণী মানবসেবায় দীক্ষা নিয়েছিলেন, সেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশ জাতির আইকন। এরপর ব্রিটিশ জাতির জন্য নাইটেঙ্গেল চিকিৎসাসেবায় একটা অধ্যায়, নার্সিং এক পেশা এক মহান পেশা তিনিই সারা পৃথিবীর কাছে চিহ্নিত করে গেছেন।
সেই নাইটেঙ্গেলের নামেই সারা পৃথিবীব্যাপী চলমান যুদ্ধে ব্রিটেনে চালু করল নাইটেঙ্গেল হাসপাতাল। মাত্র ক’দিনে বানানো এ হাসপাতালে ৪ হাজার আসন তৈরি করা হয়েছে। করোনা নামক যুদ্ধকে জয় করতে সেবিকা নাইটেঙ্গেলের সেবাকেই যেন আদর্শ হিসেবে ধারণ করে কাজ করে যাচ্ছে ব্রিটেনের চিকিৎসক আর নার্সরা। প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছেন তারা। জীবন বাজি রাখছেন তারা ব্রিটিশ জাতির জন্য এ মানবতার জন্য। ৩ মার্চও মারা গেছেন ৩৯ বছর বয়সী আরেক নার্স।
এই তো সেদিন উইগান ইনফারমারি হাসপাতালের এক নার্স ১২ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে একটা গাড়ি তাকে ধাক্কা মারে। গাড়িটা চলে যাচ্ছিল। তিনি গাড়িটাকে অনুসরণ করেন, একসময় গাড়িটা থামে। শারীরিক আড়ষ্টতায় বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে রাগে-ক্ষোভে নার্স লুসি তাকে ধাক্কা দেয়া গাড়িটির জানালায় টোকা দেন। কিন্তু লুসি স্তব্ধ হয়ে যান। গাড়িটির দরজা খোলে একজন বৃদ্ধ তার বাহুতে হাত রাখেন, বলেন আমার ইন্স্যুরেন্স আছে। কিন্তু সে কথাটায় না গিয়ে লুসি এই লোকটাকে দেখেন… লোকটা ঢলে পড়ছে, তার চোখ বন্ধ হয়, আবার কোনোরকম খোলে। এ রকম অবস্থায় লুসি ভুলে যান ব্রিটেনের একটা গাড়ি দুর্ঘটনার পর অসংখ্য ঝামেলা পোহানোর কথা। তার সেবার হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে ওই মানুষটাই বলেন, তিনি আট-দশ দিন থেকে খাবার পাননি। জ্বর-গলাব্যথা নিয়ে তিনি ঘরে থেকে বেরুতে পারেননি ভয়ে। এখন অনন্যোপায় হয়ে ড্রাইভ করেই বেরিয়েছেন খাবারের সন্ধানে।
এ অবস্থায় এই মানুষটা তাকে ধাক্কা দিয়েছেন। তিনি হয়তো দেখেনইনি, তিনি কোন দিকে গাড়ি চালাচ্ছেন। লুসি আর কিছু না ভেবে অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। গাড়িতে থাকা একটা মাস্ক পরেন, আর কিছুই ছিল না তার সঙ্গে। ওই বৃদ্ধের করোনা আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক সব নমুনা দেখার পরও এই বৃদ্ধকে ফেলে যেতে পারেননি ২৪ বছরের তরুণী লুসি। সান্ত¡না দিতে থাকেন। অ্যাম্বুলেন্স আসে। অ্যাম্বুলেন্সের প্যারামেডিকরা লুসিকে একটা অ্যাপ্রন দেয়, শুধু ওই অ্যাপ্রন পরেই তার নার্সসুলভ সব সহযোগিতা দিয়ে এই বৃদ্ধকে অ্যাম্বুলেন্স তোলেন। তার ধাক্কা খাওয়া গাড়িটা নিয়েই তিনি অ্যাম্বুলেন্স অনুসরণ করেন। হাসপাতালে যাওয়ার পর ৭৩ বছরের বৃদ্ধকে যখন হাসপাতাল বেডে নেয়ার জন্য সময় যাচ্ছে, তখন বৃদ্ধ তাকে সামান্য ক’টা পাউন্ড দিতে চাইলেন দুজনে দুটি কফি পানের জন্য। এরই মাঝে তার বেড তৈরি হয়ে যায়, বৃদ্ধ তার চিকিৎসার জন্য চলে যেতে থাকেন অন্য নার্সদের সঙ্গে। আর লুসি কায়মনোবাক্যে শুধু কামনা করেন বৃদ্ধ যেন ফিরে আসেন, এক কাপ কফি যেন পান করতে পারেন তাকে নিয়ে।
‘হোটেল ফুটবল’ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পাশেই একটি ফোর স্টার হোটেল। দুই ফুটবল তারকার মালিকানাধীন এ হোটেল। করোনা মহাদুর্যোগে এই হোটেলটি তার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। এই হোটেলের প্রত্যেকটা কক্ষ এখন এনএইচএস (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) কর্মীদের জন্য। ব্রিটেনের অসংখ্য এনএইচএস কর্মী তারা নিজেরাই শঙ্কা নিয়ে কাজ করছেন। এদের বাসায় না যেতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এদের তাই বিভিন্ন হোটেল কিংবা বিশেষ আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এভাবেই সারা ব্রিটেনে বড় বড় ব্যবসায়ীর আসনকেই তাদের স্থাপনা ছেড়ে দিয়েছেন এনএইচএস কর্মীদের কিংবা অন্য কাজে ব্যবহার করার জন্য।
ব্রিটেনের বিশাল বিশাল স্থাপনা ছেড়ে দেয়া হচ্ছে এই মহাদুর্যোগে। ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের একটা বিশাল জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়েছে মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের করোনায় রোগীদের সেবাবিষয়ক প্রশিক্ষণ কাজের জন্য। ব্রিটেন করোনা যুদ্ধে সংগ্রাম করতে দেশটার শহরে শহরে নতুন হাসপাতাল হচ্ছে। ম্যানচেস্টারে জিমেক্স (ম্যানচেস্টার সেন্ট্রাল কনভেনশন সেন্টার) সেন্টারে আরো ২ হাজার করোনা রোগীর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে, এনইসি বার্মিংহামে প্রস্তুত হচ্ছে ২ হাজার রোগীকে সেবা দেয়ার লক্ষ্যে। এছাড়া আরো ছোট ছোট ভেন্যুতে হাসপাতালে রূপান্তরিত হচ্ছে।
সরকারের ঊর্ধ্বতন মানুষগুলোর চোখে যেন ঘুম নেই। বরিস জনসন সেলফ আইসোলেশনে আছেন। স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রধান স্পোকসম্যান ব্রিটেনের চিফ মেডিকেল অফিসার ক্রিস হুইটি ও একইভাবে করোনার পজেটিভ হিসেবে আইসোলেশনে আছেন। প্রতিদিন সরকারের একজন মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক পদস্থ কর্মকর্তারা এখন সরকারি ব্রিফিং করছেন। সাংবাদিকদের উত্তর দিচ্ছেন ডিজিটাল মাধ্যমেই।
ইউরোপের ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানে বেড়ে চলেছে করোনা আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু মিছিল। সেই মিছিলে যেন যোগ হয়েছে যুক্তরাজ্য। প্রতিদিনই নতুন নতুন আক্রান্তের সংবাদে দিশাহারা মানুষ। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এখন আতঙ্ক আরো বিস্তৃত হয়েছে। স্বজন আর সজ্জনদের আক্রান্তের সংবাদ এখন প্রতিনিয়ত। কিন্তু এত কিছুর পরও চিকিৎসক-সেবক তথা এনএইচএস নিয়ে ব্রিটেনের মানুষের গর্ব আছে। চিকিৎসক কিংবা নার্সদের নিয়ে কারো কোনো সমালোচনা নেই। বরং এই করোনা মহাদুর্যোগে ব্রিটেনের গর্ব করার একটা নতুন জায়গা সৃষ্টি করেছে তাদের চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসক-নার্সরা সেবার ব্রত নিয়েই যে এ পৃথিবীতে এসেছে, তা ব্রিটেনের মহাদুর্যোগে কাজ করা মানুষগুলোকে দেখলে প্রতিভাত হয়।
তবুও হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক-নার্স কিংবা এনএইচএস কর্মীদের। সরকার আহ্বান করেছে, এনএইচএস কর্মীদের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার অবসরে যাওয়া কর্মীদের স্বেচ্ছায় আবার কাজে যোগ দিতে, ইতোমধ্যে সাড়া দিয়েছেন ২ হাজারেরও অধিক কর্মী। এদের প্রায় সবাই ষাটোর্ধ্ব। আমার এক সিনিয়র ভাই ডাক্তার অবসরে আছেন, সত্তরের কাছাকাছি যিনি, তিনিও কথায় কথায় বললেন, নাম লিখিয়েছেন, ডাক আসলে তিনিও সংযুক্ত হবেন, সাথী হবেন সংগ্রামের।
আড়াই লাখ ভলান্টিয়ারের জন্য আহ্বান করেছিল সরকার, যারা প্রবীণদের কিংবা একাকিত্বে থাকা কিংবা এ সময়ে বাইরে না বেরুনোর নির্দেশনা পাওয়া মানুষদের সাহায্য করবে এই ক্রান্তি সময়ে। এক বিস্ময় মাখানো বিষয় হলো, এখন পর্যন্ত এতে সাড়া দিয়েছেন ছয় লাখেরও বেশি মানুষ। আমি আমার বাসায়ও একটা কাগজ পেয়েছি, ফোন নম্বর দিয়ে অনুরোধ করেছে জেন নামের একজন মানুষ। মধ্যরাত পর্যন্ত যে কোনো সময় তিনি আমাকে কিংবা আমার পরিবারকে প্রয়োজনে সেবা দিতে প্রস্তুত। আশার কথা হলো, আমার পরিচিত বাংলাদেশি এমনকি আমার এলাকার কিছু তরুণ তাদের পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করেই লন্ডনসহ বিভিন্ন জায়গায় সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
মহাদুর্যোগে মানুষকে এভাবেই একটা গুষ্টি হতে হবে। একজন নয়, সমষ্টি হতেই হবে, দেশ কিংবা একক জাতি নয়, হয়ে উঠতে হবে মানব জাতিতে। ব্রিটেন এখানেই যেন সামষ্টিক হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিসত্তা থেকে বেরিয়ে যেন ব্রিটেন এক আত্মা হয়ে গেছে এই মহাদুর্যোগে। করোনার বিভীষিকা ব্রিটেনে মানবিক বোধকে এতটুকুও এককেন্দ্রিক করতে পারেনি। মৃত্যুভয়ে ভীত আছে মানুষ। কিন্তু এরপরও তো জীবনের স্পন্দন আছে। এই স্পন্দনকে আরো স্পন্দিত করে তোলতে মানুষই মানুষের জন্য এগিয়ে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। চিকিৎসা কিংবা নার্সিং পেশায় যারা আসেন, তারা শুধুই বেতন আর বেঁচে থাকাটাকে প্রধান বিবেচনায়ই আসেন না। পৃথিবীর সব চিকিৎসক-নার্সের তা-ই তো হলো মানবিক দায়বোধ, এটাই হলো ন্যূনতম নীতিবোধ। ব্রিটেনের চিকিৎসক কিংবা নার্স কিংবা স্বেচ্ছাসেবকদের এই মানবিক বোধ দেখলে পৃথিবীর যে কেউ আবেগী হয়ে উঠবে।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম