এ-মুহূর্তে বিশ্বে সব চেয়ে বড়ো সমস্যা কোনটি? প্রশ্নের উত্তরে এক বাক্যে বেশিরভাগ মানুষই বলবেন, করোনা ভাইরাস! শুধু সংক্রমণের সমস্যা-ই নয়; এই মুহূর্তে আর্থিক সমস্যা থেকে শুরু করে অন্যান্য নানাবিধ সমস্যার জননী এই নভেল করোনা ভাইরাস! ইতিপূর্বে এমনকী দু দুটি বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়েও বিশ্ব এভাবে কাবু হয়নি! বিশ্বযুদ্ধ জনগণের চলাচলকে কোথাও কোথাও সঙ্কুচিত করলেও রহিত হয়নি। যে-সকল রাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি বা কোনও পক্ষকে সমর্থন করেনি, সে-সকল রাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধের ভয়াবহতা সেভাবে আঁচ করতে পারেননি! ঘটনাচক্রে ভারতবর্ষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ হিসেবে। তাই, এর খেসারতও দিতে হয়েছিল! বাংলাদেশে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের কাহিনি বাংলার ইতিহাস, গল্প, নাটক, সিনেমায় বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সেই মন্বন্তর কেন সমগ্র ভারতবর্ষে সংঘটিত না-হয়ে কেবল বাংলাদেশেই সংঘটিত হয়েছিল, তারও নেপথ্যে আছে দুঃখজনক কাহিনি! জাপান থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে জাপানি সৈন্য ভারতবর্ষে প্রবেশ করবে বলে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নিকট খবর ছিল! তাই, জাপানি সৈন্য যাতে বাংলাদেশ হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করলেও খাদ্যের অভাবে অগ্রসর হতে না-পারে, সেই জন্য বাংলাদেশের কৃষকের ভাঁড়ার প্রায় শূন্য করে সেই খাদ্যশস্য ব্রিটিশ সরকার নিজেদের দখলে নিয়ে গিয়ে কৃত্রিম খাদ্যসঙ্কট তৈরি করেছিল! ফলে, প্রায় পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষ সেই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছিলেন! এভাবে যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো সমস্যায় ক্লিষ্ট হয়েছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধ ছিল দৃশ্যমান শত্রুর বিরুদ্ধে! তা ছাড়া, যে-সকল রাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, তারা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে ছিল মুক্ত।
নভেল করোনা একটি অদৃশ্য শত্রু! যাকে খালি চোখে দেখা যায় না! তা ছাড়া, এই জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তো দূরের কথা, তার চরিত্র নিয়েই জীববিজ্ঞানীরা রীতিমতো ধুঁয়াশায় আছেন! জীবাণুটি সাড়ে তিনশর অধিক বার তার জিনেটিক চরিত্র বদল করতে সক্ষম হয়েছে! ফলে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে! প্রাচ্যে তার জন্ম হলেও প্রতীচ্যের বড়ো বড়ো বাণিজ্য নগরী থেকে শুরু করে মহা পরাক্রমশালী রাষ্ট্র আমেরিকার নিউইয়র্ক অবধি তার অবাধ বিচরণ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’ বলে পরিচিত জাপানের আস্ফালনের পর করোনা-ই হচ্ছে প্রাচ্যের একমাত্র তথা অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি, যে আমেরিকা, ইউরোপে দৌরাত্ম্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা জার্মানি কিংবা ইতালিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেনি সুপ্ত বর্ণবাদী চিন্তাধারা থেকে! বোমা দুটি ফেলেছিল প্রাচ্যের দেশ জাপানে! অর্থাৎ আমরিকা যখন মরণ-কামড় দিয়েছিল, তখনও তার বর্ণবাদী চরিত্রকে জলাঞ্জলি দিতে পারেনি! ইউরোপকে বাঁচিয়ে রেখে এশিয়ান রাষ্ট্র জাপানকেই টার্গেট করেছিল! আজ সেই প্রাচ্যের এক অদৃশ্য শত্রুর নিকট নতজানু দুর্ধর্ষ আমেরিকা থেকে শুরু করে সমগ্র বর্ণবাদী ইউরোপ! আফ্রিকা সেই তুলনায় অনেকটা-ই নিরাপদ!
নভেল করোনাকে কেউ কেউ যেমন ন্যাচারেল বলছেন, তেমনই অনেকেই এই জীবাণুকে মানব-সৃষ্ট বলছেন। যদি সত্যি সত্যি এই জীবাণু মানব-সৃষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে, এর নেপথ্যে ভয়ানক কোনও কারণ থাকতে পারে। কোন উদ্দেশ্যে জীবাণুটি সৃষ্টি করা হয়েছে, তা পরিষ্কার হবে অচিরেই। বিশ্বব্যাপী করোনার তাণ্ডবের মধ্যে গত ১৮ মার্চ চিন, রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ আটটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিলে যে নতুন সংগঠন তৈরির রূপরেখা তৈরি করেছেন এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আমেরিকান ডলার ও ব্রিটেনের পাউন্ড বা ইউরোর বিকল্প হিসেবে নিজেদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে বিশ্বের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় তিন দশক আগেই মালয়েশিরার সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী মাহাতির মুহাম্মদ আমেরিকান ডলারের বিকল্প হিসেবে নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের কথা বলে আমেরিকার চক্ষুশূল হয়েছিলেন! মাহাতির মুহাম্মদ এমনই স্বপ্ন দেখেছিলেন! প্রাচ্যের দেশ হলেও মালোয়েশিয়াকে ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহের ধাচে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর জীবদ্দশায় কি প্রাচ্যে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো ধাচের নতুন শক্তির আবির্ভাব বিশ্ববাসী অচিরেই প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছেন? সময়ই বলবে। তাই, নভেল করোনা জীবাণুটি কোনও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের উপসর্গ কি না, জানার আগ্রহ থেকে গেল। আপাতত, আমাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষ যেন পঞ্চাশের মন্বন্তরের মতো পরিস্থিতির শিকার না-হয়, তার জন্য সর্বশক্তিমানের নিকট আকুল প্রার্থনা।