করিম সাহেব একজন পিতা | দশ জনের সংসার , এতদিন পিতা হিসেবে একাই টেনেছেন | কিছুদিন হলো- বড়ো ছেলে সামান্য রোজগার করছে | আগে মাসে একদিন হয়তো মাংস রান্না হতো | এখন সপ্তাহে অন্তত একদিন একটা মুরগি আলু সহ লম্বা ঝুল দিয়ে রান্না হয়, যাতে পরিবারের সবার পাতে পৌঁছায় | সিদ্ধ চালের ভাতে মাংসের গন্ধ নিয়ে পিতা বলেন, আলহামদুলিল্লাহ | পাড়ার অন্য দশ পরিবারের চেয়ে ভালো খাচ্ছি , আল্লাহর শুকরিয়া |
কথাটা সত্য না , তারপরও একটু জোর দিয়ে বললেন, যাতে সন্তানরা আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বড়ো হয় | বাবার মুখের কথা সবচেয়ে সত্য , সেই বিশ্বাসে, কিশোর সন্তান বন্ধু বান্ধবকে গৌরবের স্তুতি করতে ছাড়ে না | কারো কিছু যায় আসে না , তবু পাশের বাড়ির কাজের লোক হাস্য রস করতে থাকে তাচ্ছিল্যের সাথে |
মধ্যবিত্ত পিতা , অবুঝ বালক এবং ধনী ঘরের কর্মচারী সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সত্য এবং সঠিক | ছয়মাস পরে বড়ো ছেলে হঠাৎ করেই আবার বেকার ঘরে | ‘চিন্তার কোনো কারণ নাই , আমি আছি না’| বাবার মিথ্যা আশ্বাস ছেলের বুঝতে অসুবিধা হয় না | তবুও সেই সাহসে লড়ে যায় , চেষ্টা চালায় |
ব্যর্থ ইন্টারভিউয়ের পর ঘরে ফেরা ছেলেকে মা সান্তনা দেন , অভিশাপ দেন চাকুরীদাতাদের, আক্ষেপ করে বলেন, যদি কোনো মামা বা চাচার জোর থাকতো । এরই মধ্যে এক আত্মীয়ের মুখে বক্র উচ্চারণ ‘এই ছেলেকে দিয়ে কিছুই হবে না |’
এই প্রতিকূল সময়ে বাবার সাহস , আত্মীয়ের অবজ্ঞা ,ছেলের চেষ্টা আর মায়ের মমতাই মধ্যবিত্তের শক্তি , উঠে দাঁড়ানোর ভিত্তি |
এদিকে আমরা দিন মজুরদের কথা চিন্তা না করেই লকডাউনের দাবি করেছি |লক ডাউন পেয়েছি |আর্মি আচরণ জেনেও আর্মি চেয়েছি , পেয়েছি |
আমরা নিজের ঘর ভরপুর করে বলি- হায় গরিব খাবে কি ? কেউ দান করলে বলি- ছবি তুলে কেন ? আমরা জনপ্রতিনিধি বের হলে বল- লোক দেখানো, আবার না বের হলে বলি চেয়ারম্যান মেম্বার গেলো কই ?
আমরা মধ্যবিত্ত , দোষ ধরা অভিযোগ করা আমাদের মজ্জাগত | অথচ এই ঘাড়ত্যাড়া, তারছেঁড়া আমরাই বাংলাদেশটা অর্জন করেছি | এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম অর্জন ও বিসর্জন মধ্যবিত্তদের দিয়েই | আত্মকেন্দ্রিক আমরা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে ক্রমেই দূরে এসে এখন পুরো সৃজনশীল চর্চাটাই বিরান করে ফেলেছি |
যে আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করি, সেই আমরা এখন কেন মানুষ বাঁচাতে ঘরে থাকতে পারি না | যে লোক ত্রাণ দিয়ে ছবি তুলে তার হয়তো কারো কাছে বন্টনের জবাবদিহিতা করতে হয় | বলতে পারি ভাই , গরিবের অসহায় মুখটা না তুলে শুধু আপনার ছবিটাই তুলুন | অথবা ত্রাণ গ্রাহকের লজ্জিত মুখটা ব্লার করুন |
আকিজ,বসুন্ধরা, বেক্সিমকোকে সমালোচনা বা বাধা না দিয়ে স্বাগত জানাই | তাদের পথ আরো অনেকেই অনুসরণ করবে তাতে | কিছুই করতে না পারলে অন্তত ঘরে বসে উপাসনা করি | পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি , অন্যকে আক্রান্ত না করি | ভয় ভীতি না ছড়িয়ে আনন্দ ভালোবাসা বিলাই |
শুরুতে বর্ণিত করিম সাহেবের ওভারক্রাউড পরিবার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি | এই রাষ্ট্র , সরকার ব্যবস্থা একটি পরিবারের মতোই | এখানে পিতাকে যেকোনো পরিস্থিতে সর্বোচ্চ সাহসের যোগান দিতে হয় ঠান্ডা মাথায় | আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের অভিমুখে যাত্রার সাদৃশ্য এখানে | আর সেটা টেকসই না হওয়া পর্যন্ত ‘করোনা’ এর মতো হঠাৎ বিপর্যয় আমাদের ভেঙে দিবে |
আমরা হয়তো ভাঙবো কিন্তু যেন না মচকাই | সহজাত একাগ্রতা, সাময়িক কষ্ট আর মানবিক দৃঢ়তা দিয়ে আবারো উঠতে হবে | উন্নত জীবনে থাকা ধনী ঘরের কর্মচারীর তীর্যক হাস্যরস যতই সত্য ও শক্ত হোক আমাদের যেন মনোবল না ভাঙে |
হাটতেই যখন জেনেছি , হাঁটি না- সেটা কচ্ছপ বা ঘোড়ার গতিতে | আপাতত এছাড়া কোনো আলো দেখি না | লন্ডনে এই মুহূর্তে চার দেয়ালে আবদ্ধ | শুনছি জেমসের ‘দেয়াল’ গানটি | একটি কথা কয়েকবার শুনলাম “ মনের মিছিল এতোটা ছোট নয় , তোমার সামনে শ্লোগান সে দেবেই “ |
লেখক : পেশাজীবী ও অনলাইন এক্টিভিস্ট, লন্ডন