সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন
প্রকৃতি ঠিকই তার নিজের মতো আছে। বিপদে পড়েছি শুধু আমরা— মানবকূল। একটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছে গোটা পৃথিবী কিন্তু পেরে উঠছে না!
বনে-বাদাড়ে টগরফুল ফুটে শ্বেত-উৎসবে মেতেছে। বনে-বনে, খাল-বিলের ধারে ফুটেছে অজস্র ভাঁটফুল, তাতে মৌমাছিদের হট্টগোলে বুঝবার কোনো উপায় নাই— মানবকূলে মহামারী চলছে। ফুটেছে হুড়হুড়ি এবং আরো অজস্র ফুল, সবকিছুর নাম-ই তো জানি না!
গাছের ছায়ার আদরে বসে পাখি ডাকছে, ডাকছে ঝিঁঝিঁ পোকারাও। একটু আগেই একজোড়া বেনেবউ তাদের হলুদ সৌন্দর্য নিয়ে উড়ে এসে বসলো তৈকরের ডালে! অবিরত ডাকছে বসন্তবৌরি, দূরে কোথাও ডাকতে শুরু করেছে বৌ-কথা-কও। ঝোপের আড়াল থেকে একটা শেয়াল তাকিয়ে আছে গৃহস্থের ঘরের দিকে, সন্ধ্যা নামলো, শিকারের উৎকৃষ্ট সময় এখন!…
প্রকৃতি তার নিজের মতোই আছে— নির্বিকার! মহামারী যাচ্ছে শুধু মানবকূলের!
দুই.
বাংলাদেশ কেমন আছে? করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে বাঙলাদেশ সরকার যেখানে পৃথিবীর শক্তিশালী অর্থনীতিগুলোও করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে! ইতালিতে গোরস্থানের নীরবতা নেমে এসেছে। স্পেনেও অনেকটা তা-ই। ইরান দিশাহারা। গোটা ইউরোপ প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র কাঁপছে। বিশ্বের অর্থনীতি মাটিতে শুয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। অনেক দেশ অচিরেই খাদ্যসঙ্কটে পড়বে। দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। সুতরাং, সবারই এখন খাদ্যদ্রব্য ভোগে প্রচণ্ড কৃপণ হতে হবে। আপনার যেটুকু মজুদ আছে তা অল্প অল্প করে ভোগ করুন যাতে বেঁচে থাকাও যায় আবার চলতি মজুদ দিয়ে যতটা সম্ভব দীর্ঘ সময় চালানো যায়। সবচেয়ে বেশি খাদ্যসংকটে পড়তে পারে শহরের মানুষগুলো। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে গিয়ে টাকার জোরে সব কিনে ফেলবেন না, অন্যের জন্যও কিছু যেনো থাকে। সামনের দিনগুলোতে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আমার ধারণা, ভোগাবে খুব। সময় থাকতে কৃচ্ছতা সাধন শুরু করে দিন।
মানবজাতির মহাযুদ্ধ চলছে এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। কে বাঁচবো কে মরবো ঠিক নেই। তবু থামছে না মানুষের স্বার্থপরতা,— পারলে গোটা দুনিয়া নিয়ে কবরে ঢুকে পড়তে চায়। থামছে না মানুষের বেকুবি আর ফাতরামি। দৃশ্যমান শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুরুতে বিশেষজ্ঞদের কোনো পরামর্শেই কান দেয় নি জনতা, এমনকি তাদের সরকার! দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে যখন, কেবল তখন জ্ঞান ফিরেছে— কী করতে হবে— তার জ্ঞান। কিন্তু বাঙালি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জাতি। বাঙালি না বলে বলা ভালো— বাঙাল। এরা বেঁচে থাকার কাঙাল ঠিকই কিন্তু এই বিপদের মধ্যে বেঁচে থাকতে হলে যা করণীয় তা করবে না, এই কাঙাল বাঙালের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে— ফিচলেমি। আর বাঙাল যদি হয় অশিক্ষিত কুশিক্ষিত মহিলা, তাইলে ধ্বংসের কাজ শতকরা ৯০ ভাগ সারা।
চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলুন। আসুন, ভয় না পেয়ে একসাথে বাঁচার যুদ্ধে লিপ্ত হই। একদিন মরতে তো হবেই, কিন্তু মরার পূর্বেই মরে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। একে অন্যকে সাহায্য করুন। করোনার লক্ষণ দেখা দিলে নিজ দায়িত্বে সবার আগে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখুন অন্যদের থেকে।
‘আমি মরে যেতে পারি কিন্তু অন্যের মৃত্যুর কারণ হতে পারি না’— নিজের সাথে নিজের এইটুকু অঙ্গীকারই যথেষ্ট।
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের সাথে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া এখন বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি বলে মনে করি:
ক) দেরি তো হয়েই গেছে! তবু অনুরোধ করছি— দেশের যাবতীয় ধর্মীয় উপাসনালয়—মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ইত্যাদি— বন্ধ করুন। মসজিদের জামাত নিষিদ্ধ করুন। যারা মসজিদের জামাত নিয়ে তরল ভাবাবেগে ভুগছে তাদের দায়িত্বশীল আলেমদের দিয়ে মোটিভেট করুন। এই মহামারীতে কী করণীয় তা হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে এবং আরববিশ্ব সে অনুযায়ী যথার্থ আচরণ করছে। আমাদের অতিমাত্রায় ঈমানদারগণ বিপদের মাত্রা কয়েক হাজার গুণ করে ছাড়বে।
এদিকে পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বরিশালে ১০ হাজার প্রবাসফেরত মানুষ স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করছে!
আগেই বলেছি— প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যতীত বিদ্যমান বিপদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না আমরা। দেশে ‘মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি’ জারি করুন। মানুষ কথা শুনবে না, তবে মুগুর পড়লে ঠিকই সব কথা শুনবে।
খ) দেশের ভিক্ষুকদের আইসোলেশনের আওতায় নেয়া দরকার। এরা এই মুহূর্তে খুবই বিপজ্জনক ভূমিকায় আছে! ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তারা অনন্য হতে পারে! ভিক্ষা করতে গিয়ে করোনাভাইরাসকে পৌঁছে দেবে এক দরোজা থেকে আরেক দরোজায়, এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায়!
গ) করোনায় আক্রান্ত রোগীর নাম-পরিচয় এবং ঠিকানা প্রকাশ সংক্রমণের বিস্তৃতি রোধ করতে খুবই শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারতো। কিন্তু আমরা তা প্রকাশ করছি না! যেসব এলাকায় সংক্রমণ হয়েছে, সেগুলোর নাম প্রকাশ করুন, দেখবেন দ্রুত এলাকার আতঙ্কিত মানুষ নিজেদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করবে। ওইসব এলাকার মানুষের বিশেষ সতর্কাবস্থায় থাকা অতীব জরুরি।
ঘ) টাকার নোট থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে। তাহলে কাগুজে পত্রিকা থেকেও করোনা দ্রুত ছড়াতে পারে। এক্ষেত্রে আপাতত প্রিন্ট মিডিয়া তাদের অনলাইন ভার্সন রেখে প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ ঘোষণা করতে পারে। এটাও করোনার বিস্তার রোধে ভূমিকা রাখবে।
ঙ) শোনা গিয়েছিল— যেকোনো উন্নত দেশের চেয়েও আমাদের প্রস্তুতি অনেক ভালো! বিবৃতিবাজি বাদ দিয়ে অতি দ্রুত আমাদের হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার নার্সদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক পোশাক personal protective equipment (PPE) সরবরাহ করা হোক। ইতিমধ্যে করোনা সন্দেহে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চার চিকিৎসককে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে! চিকিৎসকদের নিরাপত্তা না দিলে তারা যদি চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেন সেটা কোনো অন্যায় হবে বলে মনে হয় না।
চার.
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত প্রতিষ্ঠানের নাম ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ এবং সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিটির নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বীর মুক্তিযোদ্ধা এই চিকিৎসক জীবনসায়াহ্নে এসেও মাতৃভূমির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ভুলছেন না, মানুষের জন্য যুদ্ধ করেই যাচ্ছেন। করোনা শনাক্তকরণের কিট আবিষ্কার এবং উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত-পরিচালিত প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
আমার জীবনে দেখা সর্বোচ্চ দেশপ্রেমিক মানুষটির নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁকে স্যালুট।
এই কিট আবিষ্কার ও ডিজাইনার টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন ড. বিজন কুমার শীল, তাঁকেসহ তাঁর পুরো টিমকেও স্যালুট।
করোনার সংক্রমণ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট সময় পেয়েছে কিন্তু বিবৃতি দেয়া ছাড়া কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে হয় না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তো অন্তত জাতির ক্রান্তিলগ্নে তাদের মেধা-শ্রম নিয়োজিত রেখেছে। যদিও তাদের আবিষ্কৃত কিট কতোটা কার্যকর হবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কিন্তু তাদের কর্মপ্রচেষ্টা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
পাচ.
মানুষ পাগল হয়ে প্যারাসিটামল, এন্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধ কিনে স্টক করছে! যেনো করোনায় আক্রান্ত হলে নিজেই চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে যাবে! ওষুধের দোকানগুলোতে প্যারাসিটামল এবং এন্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে এর মধ্যেই! মনে রাখা দরকার— করোনায় আক্রান্ত রোগীর কোনো চিকিৎসা পৃথিবীতে নেই। এটা রোগীর শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধব্যবস্থা সারিয়ে তুলতে পারে। শুধু শ্বাসকষ্ট হলে আইসিইউতে নিয়ে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করতে হয়। কোনো ওষুধ নেই— এটা মনে রাখুন। আর খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করবেন না। বিপদকালে সকলের চিন্তা করতে হয়, একা বেঁচে থাকার নামই বাঁচা নয়। অযথা পাগলামি করবেন না।
মানবজাতির কল্যাণ কামনা করি।
খালেদ রাজ্জাক: কবি, শিক্ষক।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন