করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর শঙ্কাটা বাড়ছে দিন দিন। দুঃখজনকভাবে ষাটোর্ধ্ব মানুষজনই মারা গেছেন এখন পর্যন্ত এবং তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন রোগে ভোগছেন। মৃত্যুর দীর্ঘ লাইন না হলেও ব্রিটেন যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাতে মানুষের মাঝে বিচ্ছিন্ন থাকার যেন একটা প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। সেজন্যই নাগরিকদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে এই দুঃসময়ে তারা যেন এক ধরনের বিলাসী হয়ে যাচ্ছে। না হলে মানবিক আচরণের এ দুঃসসময়ে মানুষগুলো এত স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক হয় কীভাবে?
চীন এখন আর পৃথিবীর গণমাধ্যমে নেই যেন। দেশটি বড় দ্রুত যেন অপসৃত হয়েছে গণমাধ্যম থেকে, করোনার আতঙ্ক যেন এখন আর খুব একটা প্রভাবিত করছে না তাদের দেশকে। বিশ্ব গণমাধ্যম এখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ইউরোপের দিকে। ইউরোপ আমেরিকা যেখানে চীনকেই নিয়ে এসেছিল তাদের প্রধান ফোকাস হিসেবে, এখন তারা নিজেরাই নিজেদের ফোকাস। বিশেষত ইতালি এখন যেন মৃত্যুপুরী। নিস্তব্দ হয়ে আছে দেশটির বিভিন্ন শহর। মরছে মানুষ। আতঙ্কে মানুষ দৌড়তেও পারছে না এক শহর থেকে অন্য শহর।
এ ভাইরাস স্পেনে হানা দিয়েছে ব্যাপকভাবে। ইতালি-স্পেনে ব্যাপক সংখ্যক বাংলাদেশির আবাস। আতঙ্কে আছে সবাই। সাময়িক চাকরি হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। স্পেনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার এক লাফে বেড়েছে ৮০ শতাংশ। এরপর প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আরো মানুষের সংক্রমণ ঠেকাতে সোমবার থেকে দেশটির সব স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি স্পেনের রানী লেতিজিয়া করোন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গত শুক্রবার পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন স্বামী-স্ত্রীসহ ৮ বাংলাদেশি। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে তারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তারা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। বাড়ি ঢাকায়। স্পেন সরকারের এক মন্ত্রীও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। স্পেনের কাতালোনিয়া এবং গ্যালিসিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শনিবার থেকে বন্ধ। বাকিগুলো বন্ধ হবে সোমবার থেকে। আর মাদ্রিদ ও লা রিওজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। প্রয়োজনে বন্ধের এ মেয়াদ আরো বাড়ানো হতে পারে।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার স্পেনের ৪টি শহর অবরুদ্ধ করা হয়েছে। স্পেনে এটিই প্রথম এ ধরনের পদক্ষেপ। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের কারণে সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেয়া হবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। সারা বিশ্বেই পর্যটন ব্যবসায় নেমেছে ধস। সাম্প্রতিক এ পরিস্থিতিকে সুনামি আখ্যা দিয়েছেন দেশটির হোটেল ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে চারটি শহর অবরুদ্ধ করেছে স্পেন। ইতালির মতোই স্পেনের চার শহরে বাইরের কেউ ঢুকতে পারছেন না, আবার ভেতর থেকে কেউ বের হতে পারছেন না। অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রে পুলিশের অনুমতি নিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত শহর থেকে বের হওয়া যাবে। এ চার শহরই বার্সেলোনা প্রদেশের ভেতর পড়ে। শহর চারটিতে প্রায় ৭৬ হাজার মানুষের বাস। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্পেনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইউরোপে এ ভাইরাস আক্রান্তের দিক দিয়ে স্পেনের অবস্থান দ্বিতীয়, প্রথম ইতালি।কানাডায় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর স্ত্রী ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তারা দুজনই বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। আমেরিকা আক্রান্ত হয়েছে। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে দেশটিতে।
এ সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই ব্রিটেন এখন এক রুদ্ধশ্বাস সময় পার করছে। চার স্তরের সাবধানতা অবলম্বন করছে ব্রিটেন। প্রধানমন্ত্রী প্রতি সপ্তাহেই তার রাষ্ট্রীয় মতামত তোলে ধরছেন। এবং প্রতিটি ব্রিফিংয়ের সময়ই করোনা ভাইরাস সংশ্লিষ্ট সবকিছুর বিশ্লেষণ করছেন ব্রিটেনের স্বাস্থ্যবিষয়ক দুজন প্রধান কর্মকর্তা প্রফেসর পল কসফোর্ড এবং স্যার পেট্রিক। মূলত তাদের কেন্দ্র করেই প্রেস ব্রিফিং থেকে শুরু করে এ সংকটের সবকিছুর ফোকাস করা হচ্ছে ব্রিটেনে। দ্বিতীয় স্তরে এসে তারা ঘোষণা দিয়েছেন, এখন পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। কিন্তু অবস্থা যেদিকে মোড় নিচ্ছে, এ সপ্তাহেই এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে। যদিও ইতোমধ্যে এ ভাইরাস হানা দিয়েছে এমপি-মন্ত্রী-ফুটবল খেলোয়াড়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দেহেও। এ ভাইরাস যাতে আতঙ্ক সৃষ্টি না করতে পারে এবং সব মানুষ একসঙ্গে গিয়ে হাপাতালগুলো টইটম্বুর করে তুলতে না পারে, সেজন্য সেল্ফ আইসোলেশনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে দেশটি। অন্তত এক সপ্তাহ নিজের ঘরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য বলা হয়েছে; অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে বলা হচ্ছে। ৪০ শতাংশ মানুষ একসঙ্গে হাসাপাতালে শুধু নিজেকে চেক করানোর জন্য উপস্থিত হলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে, সেই শঙ্কায় তা-ই করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে স্কুল বন্ধ না করার ঘোষণায় সরকার সমালোচিত হচ্ছে। ব্রিটেনে চার স্তরের দ্বিতীয় সাবধানতা স্তরের পা রাখার পরও প্রধানমন্ত্রীর স্কুল বন্ধ না দেয়ার ঘোষণায় বিস্মিত হয়েছে মানুষ। ব্রিটেনকে এখনো ‘জাতীয় দুর্যোগ’ হিসেবে বিবেচনা না করা এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করায় সমালোচনা করেছেন এমনকি তাদের সাবেক স্বাস্থ্য সেক্রেটারি জেরেমি হান্ট এবং সাবেক কেবিনেট মিনিস্টার রোরি স্টোয়ার্ট। কারণ ব্রিটেন এখন যতজনকে করোনার জন্য পজিটিভ হিসেবে উল্লেখ করেছে, তার চেয়ে অন্তত দশগুণ মানুষ আক্রান্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা সরকারিভাবেই উচ্চারিত হচ্ছে। শনিবার ঘোষণা করা হয়েছে আরো ১০ জন মানুষ এ রোগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এর আগের দিন মোট ১১ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল ব্রিটেন।
এক মাস আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেনের ২ হাজার ৫২১ জনকে পরীক্ষার পর ৯ জনকে পজিটিভ অর্থাৎ এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হিসেবে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্বেগ প্রকাশ করছিল তখনই, যদি এই রোগীদের বিচ্ছিন্ন না রাখা যায় তাহলে ব্রিটেনেও এ বিপর্যয় ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। শুধু তাই নয়, সন্দেহজনক যে কাউকেই এভাবে আইসোলেটেডে না রাখতে পারলে ব্রিটেনের ৪০ মিলিয়ন মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে লাখো-কোটি মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছে। যার পরিমাণ ৫০ মিলিয়ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রভাবটুকু ব্রিটেনেও পড়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ইন্টারেস্ট রেট কমিয়েছে। ঘরবাড়ির মর্টগেজ অর্থাৎ মাসিক ব্যয় কমে গেছে ইতোমধ্যে অধিকাংশ মানুষের। প্রায় ৯ লাখ ব্যবসার ওপর থেকে সরকারি কর মাফ করে দেয়া হয়েছে আগামী এক বছরের জন্য। ছোট ছোট ব্যবসাগুলো টিকিয়ে রাখতে ইতোমধ্যে ভর্তুকি দেয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে সরকার। অসুস্থ কর্মকর্তাদের বেতন দিতে কোম্পানিগুলোকে সহায়তা দেয়ার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।
ক্রয়ক্ষমতাকে স্থতিশীল রাখতে এবং অহেতুক আতঙ্ক সৃষ্টি না করতে সুপারমার্কেটগুলোতে প্রয়োজনীয় সাপ্লাই অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে সুপারমার্কেটগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কিন্তু তারপরও ব্রিটেন এক শ্বাসরুদ্ধর অবস্থার মাঝে যেন আছে, হ্যান্ড সেনিটাইজার বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় নিমিষেই। টয়লেট টিস্যুর সরবরাহে কমতি নেই তবুও মানুষ যেন হাহাকার করছে এর জন্য। সুপার মার্কেটগুলোর নিত্যদিনের পণ্যের সেলফগুলো শূন্য হয়ে যায় অতি দ্রুত। সারাদেশে এ নিয়ে আতঙ্ক আছে, কিন্তু অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জন ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত নয়। লন্ডনের রেডব্রজি এলাকায় একজন বাঙালি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, যিনি আতঙ্ক সৃষ্টি করে ক্রেতাদের কাছ থেকে অধিক অর্থ আদায় করছেন। তবে এ সংক্রান্ত অভিযোগ কেউ স্থানীয় ট্রেডিং কাউন্সিলে দিলে এবং এর প্রমাণ পেলে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়ার আইনই আছে। অন্যদিকে ওই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর মতো কিছু কিছু ইবে (বন্ধু) ব্যবসায়ী এমনকি ব্যবহৃত হ্যান্ড সেনিটাইজার পর্যন্ত বিক্রিতে (নিলামে) তোলেছে এবং যেগুলোর দাম ছয়-সাত পাউন্ডেও মানুষ অনলাইনে কিনে নিচ্ছে।
সারাদেশের সঙ্গে বাংলাদেশি অধ্যুষিত ইস্ট লন্ডন কিংবা বার্মিংহাম ম্যানচেস্টার-ওল্ডহ্যাম এ আতঙ্কের বাইরে নয়। বিশেষত করোনায় আক্রান্ত হয়ে একজন বাংলাদেশি ওল্ডহ্যাম শহরে মৃত্যুর পর এ আতঙ্ক যেন আরো ব্যাপৃত হয়। করোনায় আক্রান্ত তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে মৃত এ মানুষটি ছিলেন ইতালি ফেরত। এদিকে ব্রিটেনের ১১তম মৃত্যুবরণকারী মানুষ হিসেবে আরেকজন বাংলাদেশি ইস্ট লন্ডনে মারা যাওয়ার পর কার্যত বাঙালিদের রাজধানীখ্যাত ব্রিকলেন কিংবা হোয়াইট চ্যাপল জনহীন হয়ে পড়ছে। প্রাণচাঞ্চল্য নেই। নেই সেই প্রতিদিনের পথচলা সেখানে।
করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর শঙ্কাটা বাড়ছে দিন দিন। দুঃখজনকভাবে ষাটোর্ধ্ব মানুষজনই মারা গেছেন এখন পর্যন্ত এবং তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন রোগে ভোগছেন। মৃত্যুর দীর্ঘ লাইন না হলেও ব্রিটেন যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাতে মানুষের মাঝে বিচ্ছিন্ন থাকার যেন একটা প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। সেজন্যই নাগরিকদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে এই দুঃসময়ে তারা যেন এক ধরনের বিলাসী হয়ে যাচ্ছে। না হলে মানবিক আচরণের এ দুঃসসময়ে মানুষগুলো এত স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক হয় কীভাবে?
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম