সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
https://blu-ray.world/ download movies
সর্বশেষ সংবাদ
বাংলাদেশে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের সম্পদ সুরক্ষায় অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে  » «   ইস্টহ্যান্ডস চ্যারিটির উদ্যোগে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং কর্মশালায় বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণ  » «   হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের  বিরুদ্ধে নীতিহীন কর্মকান্ডের অভিযোগ  » «   সাংবাদিক ক্যারলকে গ্লোবাল জালালাবাদ ফ্রান্সের বিশেষ সম্মাননা প্রদান  » «   গ্লোবাল জালালাবাদ এসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক জালালাবাদ উৎসব প্যারিস অনুষ্ঠিত  » «    সাকিব : নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতি  » «   লন্ডনে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী চাটগাঁয়ে মেজবান ৬ অক্টোবর রবিবার  » «   ১১তম মুসলিম চ্যারিটি রান ২০ অক্টোবর ভিক্টোরিয়া পার্কে  » «   ৭৫ শেফ এর অংশগ্রহণে বিসিএর শেফ অব দ্যা ইয়ার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত  » «   ৩০ বছরেও ধরা পড়েনি কোনো আসামী, বিচারের দাবীতে মেয়ের সংবাদ সম্মেলন  » «   ইস্টহ্যান্ডসের ফ্রি স্মার্ট ফোন পেলেন ৪০ জন  » «   সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য পদক ২০২৪’পেলেন কবি, সাহিত্যিক ও সংগঠক ফারুক আহমেদ রনি  » «   টাওয়ার হ্যামলেটসে হোমলেসনেস-এর প্রস্তাবিত নতুন পলিসি সাসপেন্ড করেছেন নির্বাহী মেয়র লুৎফুর  » «   লন্ডনে বিসিএ এ্যাওয়ার্ডস ২৮ অক্টোবর থাকছে নানা চমকপ্রদ আয়োজন  » «   বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৩২নং বাসভবন ভস্মীভূত এবং ভাস্কর্য ভাংচুরের নিন্দা ও প্রতিবাদ  » «  
সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন

হেঁটে হেঁটে হাকালুকি



সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

টিলার ভেতর থেকে ঢালুপথ বেয়ে নিচে নেমে আসার সময় দেখতে পেলাম অপরুপ সেই দৃশ্যটি। কমলালেবুর মত ছোট ছোট পাতা আর সরু কান্ডের আগরের বনের নিচের অংশে যেন জমাট বেঁধে আছে ধোঁয়াশে মেঘদল। দেখতে মেঘের মতই এই জমাট বাধা ঘন কুঁয়াশার চাদরে যেন থমকে আছে বিশ্বচরাচর। প্রকৃতি চুপচাপ, গাছের পাতারাও যেন নিরবে ঠায় দাড়িয়ে আছে। বাতাসে চাঞ্চল্য আনতে হঠাৎ কৈশোরের দুষ্টুমি মাথায় খেলা করল। হাত দু’টো তরবারির মত বাঁকিয়ে লাফিয়ে ওঠে বাতাসে কোপ চালাই। জমে থাকা কুঁয়াশার দঙ্গল থমকে ওঠে দুইপাশে সরে যায়। বাড়তি পাওনা হিসেবে হাঁড়-মাংস থেকে কিছুটা ঠান্ডা বেরিয়ে গিয়ে শরীরও একটু উত্তাপ পায়।

সাতসকালে আমাদের এই বেড়িয়ে পড়া হাকালুকি হাওরের উদ্দেশ্যে। দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি বড়লেখা, জুড়ি, কুলাউড়া, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও সিলেট ও মৌলভীবাজারের আরো কয়েকটি উপজেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। হাকালুকিতে যাওয়া যায় তাই কয়েকটি রুট দিয়েই। তবে আমাদের প্লান ছিল এবার সচরাচর পথের বদলে নতুন কোন পথে পায়ে হেঁটে হাকালুকিতে বেড়াতে যাওয়া। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে বন্ধু সৌরভের বাড়ী রতুলীতে গিয়ে ডেরা বেঁধেছিলাম আগের দিনই।

খুব ভোরেই মারুফ এসে পৌছার পর কনকনে ঠান্ডার মধ্যে শীতের কাপড় ভালভাবে গায়ে জড়িয়ে তিনজন বেরিয়ে পড়লাম। রতুলীর পরই পড়ল কামিলপুর। এই গ্রামটিতেও সুগন্ধি বৃক্ষ আগরের নিসর্গ পথে পথে চোখে পড়ে। গ্রামের পাকা রাস্তা শেষ হয়ে এলে আমরা একটি ছড়ার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকলাম। ভরা শীতের সময়েও ছড়াটি কানায় কানায় ভরপুর। এর পানিও একদম টলটলে পরিষ্কার। সৌরভ জানালো ছড়াটির নাম হচ্ছে মাধবগাঙ্গ। নাম শুনেই আন্দাজ করেছিলাম এর উৎস সম্পর্কে।

পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে মাধবকুন্ড জলপ্রপাত থেকেই আসছে এর এমন পরিষ্কার পানির প্রবাহ। মাধবগাঙ্গের পাড় জুড়ে কলমীবনের বেশ আধিপত্য। ছড়ার পাশের উর্বর জমিতে রবি শস্যের আবাদ দেখতে পেলাম। শর্ষে আর সয়াবিনের ফুল যেন হলুদ কার্পেটে মুড়িয়ে রেখেছে মাঠ। কলমী পাতা আর শর্ষে ফুলের পাঁপড়ি বেয়ে ঝরে পড়া মুক্তোর দানার মত শিশির বিন্দুতে মন জুড়িয়ে যায়। ফসলের মাঠ শেষ হয়ে হয়েছে একটি টিলার পাদদেশে গিয়ে। টিলাটি ঘন বাঁশঝাড়ে ঢাকা। বাঁশবন আর লতা গুল্ম ঝোপের ফাঁক-ফোকরের ট্রেইল দিয়ে হাঁটার পথ খুঁজে নিলাম।

টিলা থেকে বের হলে মাধবগাঙ্গের পারে আবার নিজেদের আবিষ্কার করলাম। সামনেই পড়লো ধনুকের মত বাঁকানো একটি সেতু। সেতুটি পার হয়ে এসে পথের বাঁক পেরোতেই রাস্তা লাগোয়া একটি ঝোপ নড়েচড়ে ওঠলো। সচকিত হয়ে তাকাতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো চার-পাঁচটি তিতির পাখি। তিতির গৃহপালিত পাখি হলেও সেটি এখন বেশ বিরল। তারা যেন অনাহুত আগন্তুকদের এ সময় আশা করেনি। তাই বিচিত্র শব্দে ডাকতে ডাকতে পালিয়ে যায়।

তারপর শতবর্ষী একটি মসজিদের সামনে এসে পড়লাম। মসজিদটির নামফলক থেকে জানলাম নির্মাণকাল বৃটিশ আমলে, ১৯০৪ সালে। আমাদের পা চলতে থাকে আর পথে পথে টিলা-বনবনানী, আগরবাগান, বসতবাড়ি, পুকুরঘাট, ফসলিজমি, জলাভূমি পেছনে চলে যেতে থাকল। হাঁটতে হাঁটতে আজিমগঞ্জ বাজার পেছনে ফেলে আমরা সালদীঘায় গিয়ে থামি। হাকালুকি পারের শেষ গ্রাম এটাই। গ্রামটির মাঝ বরাবর চলে গেছে জুড়ি উপজেলা পর্যন্ত পাকা রোড। দাসের বাজার থেকে শুরু হয়ে এই রোডটির প্রায় পুরোটাই চলে গেছে হাওরের পাশ বেয়ে। বর্ষায় হাকালুকির উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে এর গায়ে। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোডের আদতে এটিকে হাওর ড্রাইভ রোড বললেও অবশ্য মন্দ হতো না।

সালদীঘা থেকে হাওরের দিকে চলে যাওয়া মেঠোপথ ধরে হাঁটার সময় রাস্তার একপাশে ঘন মুর্তার বন দেখতে পেলাম। এসব মুর্তা দিয়ে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য শীতলপাটি বানানো হয়। মুর্তা বনের ফাঁকে ফাঁকে মাথা উচিয়ে আছে হিজল গাছ। হিজলের ডালে ডালে কানের দুলের মত ঝুলে আছে হিজল বীজের লতা। ছবি তোলার ফাঁকে বাকি দু’জন থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলাম। সৌরভের ডাক শুনে জোর পায়ে সামনে গেলাম। সে ঝোপের ফাঁক দিয়ে আঙুল তাক করে একটি হিজল গাছ দেখালো। তাকিয়ে দেখলাম গাছটিতে একটি খোড়ল। তার ভেতর কিছুটা ঘাস-পাতা। এ ধরণের খোড়লের ভেতর পেঁচা বাসা বানিয়ে থাকে।

হাওরপারের মানুষজন মেঠোপথের ধূলো উড়িয়ে বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। হাকালুকির শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে আমরা বেশ বড়সড় একটি জলার সামনে গিয়ে থামলাম। পুরো জলাটি লাল শাপলায় ভরপুর। রক্তিম আভায় ফুটে থাকা ফুলগুলো যেন একেকটি ঝলঝলে তাঁরা। সূর্যের আলো কুঁয়াশার চাদর ভেদ করে তখনো না উঠতে পারলেও শাপলার আলোয় যেন ভরে আছে পুরো জলাটি। জলার পানিতে কয়েকটি পানকৌড়ি বিরামহীন ডুব দেয়া আর ভুস করে মাথা তোলার খেলায় মেতেছিল। কিছু আবার আহারপর্ব সেরে বাঁশের কঞ্চিতে বসে পাখা ছড়িয়ে গা গরম করছিল। জলার পরিষ্কার পানিতে কিছু ডিঙি নাও ডুবিয়ে রাখা। হাওরে পানি বাড়লে এই নৌকাগুলোই হয়ে যাবে মানুষের চলাচলের একমাত্র উপায়।

আমাদের বিমূঢ়তায় ছেদ কেটে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক পরিযায়ী পাখি। পাখির দলটি যাচ্ছে হাওরের আরো গভীরের দিকে। জলা পেরিয়ে আমরা হাওরের মাঝে কিছুটা উঁচু একটা জায়গায় এসে দাড়ালাম। বড়সড় একটি পাকুড় গাছের নিচে দেখতে পাই শ্যাওলা ধরা পুরনো পাকা দেয়াল। চারকোনা দেয়ালটির ভেতরেও বট পাকুড়ের চারা জন্মেছে। কাছেই পড়েছিল কিছু পরিত্যক্ত কাঠের টুকরো। কৌতূহল মেটানোর জন্য কাউকে খুঁজছিলাম। কিছুটা দূরে বোরো ধানের চারা বুনছিলেন একজন চাষী। তার কাছ থেকে জানলাম, এটা শ্মশানঘাট। আমরা হাওরের মাঝে জলার ধারে ধানখেতের আল দিয়ে হাঁটতে থাকি। কিছুটা দূরেই ছিল নখখাগড়ার একটি ঝোপ। ঝোপটির কাছে যেতেই বাতাস কাঁপিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক সরালী হাঁস। চোখের ঘোর কাটিয়ে দেখি ডানার জল ফেলে তাদের উড়ে যাওয়া।

এরপর আরেকটু সামনে পেয়ে গেলাম লম্বা লম্বা পায়ের অনেক গুলো সাদা বক। কোনটা মেপে মেপে পা ফেলে কাদার ভেতর ঠোঁট ডুবিয়ে শিকার খুঁজছে। কোনটি আবার একপায়ে দাড়িয়ে পালকগুলো ফুলিয়ে যেন ধ্যানে মগ্ন। মাথার ওপর দিয়ে তীক্ষè স্বরে একটি মেছো ঈগল হাওরের জলায় ছোঁ মেরে উড়ে গিয়ে দূরে একটি গাছের উচুঁ ডালে বসল। কুঁয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্য ওঠার পর রোদ গায়ে চড়তে থাকলে আমরা পাকুড় গাছটির ছায়ায় ফিরে গেলাম।

যেতে চাইলেঃ বড়লেখা হয়ে হাকালুকি হাওরে যেতে চাইলে ধরতে হবে ঢাকা-বিয়ানীবাজার রুটের বাস। ভাড়া পড়বে পাঁচশ’ টাকা। বাস নামিয়ে দেবে বড়লেখায়। এছাড়া সিলেটের ট্রেনে কুলাউড়ায় নেমে লোকাল পরিবহনেও বড়লেখায় যাওয়া যাবে। মানসম্পন্ন হোটেল পাবেন বড়লেখা বাজারে। বড়লেখা বাজার থেকে হাওর পর্যন্ত রিজার্ভে সিএনজি পাওয়া যাবে। তবে ভোরের হাওর দেখার সবচে’ ভাল উপায় হাওরের ধারেকাছে কোথাও ক্যাম্পিং করে থাকা।

শিমুল খালেদ : ভ্রমণ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক এবং ব্যাংক কর্মকর্তা।


সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন