প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ব্রিটেনে ঘুরে গেছেন। তার এই সফরে অংশ হিসেবে তিনি লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে গত ১২ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের ঘোষণা দিয়েছেন। ভোটাধিকারের দাবি ব্রিটেন প্রবাসীদের অনেক পুরনো। বিশেষত ইংল্যান্ড, ইউরোপ কিংবা আমেরিকার যারা অভিবাসী এদেশগুলোর নাগরিক হয়ে গেছেন, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি আইনগতভাবে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং সে জন্যই ভোটাধিকার প্রয়োগের দাবিটি ছিল বহু উচ্চারিত এবং দাবিটি প্রায় সিকি শতাব্দী থেকে উচ্চারিত হচ্ছে এবং ব্রিটেন প্রবাসীরা এ দাবিকে এক ধরনের আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়েছিল।
সে হিসেবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিটেনে এসে এ বিষয়ক একটা নির্দেশনা দেবেন, সেটা সবারই ধারণার মধ্যে ছিল। লন্ডন হাইকমিশনে এ বিষয়ক সভার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসেছিলেন ম্যানচেস্টার সহকারী হাইকমিশনে। স্বাভাবিকভাবে সেই একই কথা বলেছেন তিনি। কমিশন আনীত নতুন সিদ্ধান্তে ব্রিটেন প্রবাসীরা কি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, তা নিয়ে সভায় বলেছেন। ব্রিটেনের অভিবাসীদের একটা আকাক্সক্ষা ছিল এবং বর্তমান সরকার এটা বাস্তবায়ন করেছে, সেজন্য সরকার সমর্থক কিংবা বিরোধী দলের মানুষগুলোও এ নিয়ে উচ্ছ¡সিত ছিল। শুধু তাই না, ডিজিটাল পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ‘স্মার্টকার্ড’ দিচ্ছেন, এটা কম কথা নয়। যে কার্ডে একজন প্রবাসী ভোগ করবেন দেশের নাগরিকের মতো অনেক সুযোগ। এই কার্ডের মাধ্যমে প্রবাসীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, একজন প্রবাসী তার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, টেলিফোনের সিম ক্রয়, কর ও রাজস্ব প্রদান, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণের সুবিধা, জায়গাজমি ক্রয়-বিক্রয়সহ বিভিন্ন সুবিধা তারা পাবেন এ কার্ড দিয়ে।
লন্ডনের সভা করার পর নির্বাচন কমিশনার ম্যানচেস্টার সহকারী হাইকমিশনে এসেছিলেন সেই একই কাজে। ম্যানচেস্টারের সহকারী হাইকমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় তিনি একই কথাগুলোই পুনর্বার উচ্চারণ করেছিলেন। এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছেন অনেকেই। নির্বাচনের কমিশনের প্রণীত নতুন সিদ্ধান্তের ওপর ব্যাখ্যা চেয়েছেন কেউ কেউ। কেউ তাকে পেয়ে ধন্যবাদ দিয়েছেন বারবার। তাদের এই কৃতজ্ঞতার কাছে অভিবাসীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ইস্যু ম্লান হয়েছে। কারণ ধন্যবাদ দাতাদের কথায় মনে হয়েছে সরকারের করুণায় আজকের এই স্মার্টকার্ড।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন করতে হলে কিংবা স্মার্টকার্ড পেতে হলে প্রবাসীদের নিম্নের যে সবগুলো স্তর পাড়ি দিতে হবে, তার মাঝে বিদেশে অবস্থানরতদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাসপোর্টের কপি, বিদেশি পাসপোর্টধারীর দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের কপি বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে শনাক্তকারী একজন প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকের পাসপোর্টের ফটোকপি, বাংলাদেশে বসবাসকারী রক্তের সম্পর্কের কোনো আত্মীয়ের নাম, মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরসহ অঙ্গীকারনামা, বাংলাদেশে কোথাও ভোটার হননি মর্মে লিখিত অঙ্গীকারনামা, সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের প্রত্যয়নপত্র।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে প্রশ্নকারীদের মাঝে ছিলাম আমিও। জানতে চেয়েছিলাম, আমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকার পরও জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক আমি। শৈশব-যৌবন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পার করে একজন মানুষ অভিবাসী হওয়ার পরও বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত প্রয়োজনীয় আইনি সব কিছু শেষ করেই আমরা অনেকেই নিয়েছি বাংলাদেশের পাসপোর্ট। পাসপোর্ট নেয়ার পরও আমাকে কেন আবারো প্রমাণ করতে হবে আামি বাংলাদেশের নাগরিক, কেন নিতে হবে আরেকটা বাংলাদেশি সনদপত্র। বাংলাদেশি সনদপত্রের ব্যাখ্যা হিসেবে তারা বলছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দ্বৈত নাগরিক হিসেবে একটা প্রত্যয়নপত্র। অথচ একজন বাংলাদেশি নাগরিক যখন এমনকি ব্রিটিশ পাসপোর্ট নেয়, অর্থাৎ ব্রিটিশ নাগরিক হয়, তখনো কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তার বৈধতা প্রমাণ করতে হয় না, কিংবা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি কোনো সনদেরও প্রয়োজন পড়ে না। একজন অভিবাসী ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী নাগরিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেনের সব নাগরিক সুবিধাভোগী হয়ে যায়। আর ভোটার তো হয়ে যায় অনেক আগেই। বৈধভাবে ব্রিটেনে প্রবেশ করা কোনো নাগরিক যদি এমনকি ব্রিটেনের স্থায়ী বাসিন্দা না হয়েও ভোট প্রদানের অধিকার তো রাখেনই, এমনকি নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেন।
স্মার্টকার্ড প্রত্যাশী অভিবাসীকে একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নাগরিক শনাক্ত করবেন, শনাক্ত করবেন স্থানীয় বাংলাদেশি দূতাবাসও, স্মার্টকার্ড প্রত্যাশীর বাংলাদেশি পাসপোর্টও আছে, তবুও তাকে কেন নিতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ। একটা পাসপোর্ট তৈরি করার সময় একজন অভিবাসীকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। দেশ থেকে পেতে হয় পুলিশের রিপোর্ট। সে অভিজ্ঞতা যার আছে, সে জানে কীভাবে ম্যানেজ করতে হয় একটা পুলিশ রিপোর্ট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্রেও সেরকম ব্যাপারই আসছে আবারো। সব মিলিয়ে শুরুটা অতি জটিল হয়েই উঠল।
অদ্ভুত কিছু আইন আছে অভিবাসীদের জন্য। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে যখন জানতে চেয়েছিলাম, একই দেশ অথচ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন পথ। একজন অভিবাসী স্থানীয় নির্বাচন যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ কিংবা পৌরসভা নির্বাচন করতে পারবে ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের যে কোনো দেশের নাগরিক হয়েও, অথচ সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। একজন অভিবাসী সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে ভোট দিতে পারবেন সংসদীয় প্রার্থীকে, অথচ এই অভিবাসী সংসদে প্রার্থী হতে পারবেন না। একটা দেশ অথচ দুটো আইন। এর উত্তরে তার কথা ছিল, সংসদে দেশের আইন প্রণয়ন করা হয়, ভিন্ন দেশের নাগরিক থাকলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই ব্যক্তিকে দুদেশের ইন্টারেস্ট দেখতে হতে পারে। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের সংসদে এখনো ব্রিটিশ নাগরিক (হয়তো নাগরিকত্ব আপাতত ত্যাগ করা) আছেন, এর আগে মন্ত্রী পর্যন্ত ছিলেন। দেশের প্রতি ওই সাংসদদের দায়বোধ আছে বলেই পার্টি তাদের দলের একজন হিসেবে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণীতে তাদের নিয়ে যায়। যে অভিবাসী মানুষগুলো বাংলাদেশের সাংসদ হন, মন্ত্রী হন কিংবা এমনকি কেন্দ্র কিংবা জেলা পর্যায়ের নেতা হন, যে কোনো পার্টিই তাদের কাছ থেকে পার্টির সব লয়েলটি কিংবা আনুগত্য পায় বলেই তাদের ওই নীতিনির্ধারণীতে নিয়ে যায়। যদিও ওই নেতা কিংবা এমপি-মন্ত্রীদের পরিবার পড়ে আছে ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের কোনো কোনো দেশে।
ভারতে দ্বৈত নাগরিকত্ব পদ্ধতি নেই। ইউরোপের কিছু কিছু দেশেও এ পদ্ধতি চালু আছে। ভারতের মতো বাংলাদেশের একজন নাগরিককে দ্বৈত নাগরিকত্ব কিংবা ভোটাধিকার প্রদানের অধিকার না দিলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু দেশ তার প্রয়োজনে দ্বৈত নাগরিকদের একটা সুতোর মধ্যে বেঁধে রাখবে, প্রয়োজনে সেই সুতো ছাড়বে আবার তারই প্রয়োজনে টাইট দেবে। সেটা তো হতে পারে না। প্রসঙ্গত, একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনো শাখা নেই ব্রিটেনে। সম্ভবত পৃথিবীর কোনো দেশেই এ নামে কোনো সংগঠন নেই। এটা আওয়ামী লীগের একটা অত্যন্ত গঠনমূলক সিদ্ধান্ত, কিন্তু ঠিকই ব্রিটেনে অন্তত অর্ধশতাধিক শুধু বাংলাদেশি আওয়ামী লীগ নামের সংগঠন আছে। এবং এ সংগঠনগুলো ‘যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ’ নাম নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালায় এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা এসে এ দেশের মূল কমিটিগুলো তারাই অনুমোদন দেন।
আলোচনায় ব্যাপারটা এতটাই পরিষ্কার যে, সত্যিকার অর্থে শুধুমাত্র প্রয়োজনেই অভিবাসীরা ব্যবহৃত হচ্ছেন। একজন অভিবাসী আওয়ামী লীগ করতেই পারেন, এতে রাখঢাকের কি আছে। একজন রাজনৈতিক কর্মী বিএনপি, সিপিবি, জাতীয় পার্টি কিংবা যে কোনো বাংলাদেশি তার নাড়ির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন করবে এতে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ না আনাই উচিত। আর বিধিনিষেধ আনা হলে তা প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতি মানুষ আস্তাহীন হয়ে যায়।স্মার্টকার্ড প্রাপ্তির সংবাদটা বিশেষত ব্রিটেন প্রবাসীদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা প্রাপ্তি। কারণ এ নিয়ে বেশ দেন-দরবার করেছে ব্রিটেন প্রবাসীরা। কিন্তু যেভাবে এটাকে জটিল করে তোলা হয়েছে, তাতে স্মার্টকার্ড পেতে গিয়ে প্রবাসীদের হযরানি যেন পোহাতে না হয়, সেদিকটা বিবেচনায় নিলেই হয়।