‘মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীন, কিন্তু জীবনের সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত‘— রুশো
এক.
পৃথিবীতে মানুষ বহুভাবে শৃঙ্খলিত। প্রধান শৃঙ্খলটি হচ্ছে তার বিশ্বাস। অর্থাৎ মানুষ তার নিজস্ব বিশ্বাসের অধীন। এ বিশ্বাস আবার বহুধাবিভক্ত। মানুষ একজন সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর প্রেরিত পুরুষে বিশ্বাস করে। এ-বিশ্বাসই মূলত ‘ধর্ম’ নামে পরিচিত। সুতরাং মানুষ প্রথমে সৃষ্টিকর্তার অধীন, পরে তাঁর প্রেরিত পুরুষ দ্বারা নির্দেশিত বিধি-বিধানের অধীন। ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে এসব বিধিনিষেধেও তৈরি হয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। অধীনতার অন্ত নেই। অধীনতাই মানুষের মূল বিধিলিপি!
মানুষের ধর্ম তার নিজের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এবং স্পর্শকাতর বিষয়। ধর্ম মানুষের এক ধরনের আশ্রয়। হতাশা আর দুর্দশাগ্রস্ত জোবনে ধর্ম পালন করে মানুষ শান্তি পায়। কিন্তু পবিত্র ধর্ম যখন আয়রোজগারের বাহনে পরিণত হয়, তখন তার পবিত্রতা রক্ষা দূরে থাক সে তখন অত্যন্ত হিংস্র হয়ে ওঠে।
পদার্থের ধর্ম প্রধানত দুই প্রকার— ভৌত ধর্ম এবং রাসায়নিক ধর্ম। মানুষের ধর্ম পদার্থের ধর্মের মতো নয়। পদার্থের ধর্ম বলতে যা বোঝায়, মানুষের ধর্ম বলতে তা বোঝায় না। মানুষের ধর্ম মূলত বিশ্বাসের সংস্কৃতি এবং সরলীকৃতভাবে ধর্মের মূল কথা হচ্ছে মানুষের জীবন মৃত্যুপরবর্তী আরেকটি অন্তহীন জীবনের অংশ মাত্র। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের স্বরূপ এবং তার প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্বাসের পার্থক্যই মানুষের ধর্মের ভিন্নতা সৃষ্টি করেছে। কেউ পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে, কেউ পরজন্মে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। জবরদস্তি করে নির্দিষ্ট বিশ্বাসে আনা যায় না কিংবা জবরদস্তির মাধ্যমে কারো মনের বিশ্বাস মুছে দেয়া যায় না।
ধর্ম নিয়ে পৃথিবীজুড়ে হানাহানির অর্থ হচ্ছে বিশ্বাসের সংস্কৃতি নিয়ে হানাহানি। বিশ্বাসের প্রত্যেকটি সংস্কৃতি বিশ্বাসের অন্য সংস্কৃতির উপর আগ্রাসনের স্বপ্নে বিভোর। বিশ্বাসের সংস্কৃতির ভেতর (অর্থাৎ, ধর্মের ভেতর) আবার শত শত বিশ্বাসের উপসংস্কৃতি সৃষ্টি করে মূল সংস্কৃতিটিকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে পবিত্র ধর্মের খাদেমরা যা মানবজীবনের সার্থকতা এবং শান্তি নষ্ট করার একটি প্রধান কারণ। বিশ্বাসের এ প্রত্যেকটি সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন চালায় প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে। অর্থনৈতিক শক্তি অর্জনই সকল বিশ্বাসের সংস্কৃতির মূল উদ্দেশ্য হয়ে পড়েছে। সুতরাং, হানাহানির অবসান সুদূর পরাহত।
দুই.
ধর্মের চেয়ে উপধর্ম শক্তিশালী কি না— এ নিয়ে হাইস্কুলে পড়বার সময়ই আমার মনে সন্দেহ দেখা দেয়! আমি যেহেতু মুসলিম ঐতিহ্যের ভেতরে জন্মেছি এবং বেড়ে উঠেছি, সেহেতু আমার বক্তব্য ইসলামের গণ্ডির ভেতরে সীমিত থাকবে। শুরুতেই বলে নেই উপধর্ম বলতে আমি কী বুঝাচ্ছি? উপধর্ম হচ্ছে মূল ধর্ম থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন গ্রুপ বা দল যারা পারস্পরিক রক্তক্ষয়ী কলহে লিপ্ত। ইসলাম একটি ধর্ম এবং তার প্রধান আদি দুটি গ্রুপ হচ্ছে শিয়া ও সুন্নি যারা পরস্পরকে কাফের বলে মনে করে। এখন মুসলমান হওয়ার চেয়ে শিয়া বা সুন্নি হওয়া প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
আমি সুন্নি সমাজে বড় হয়েছি।
সুন্নিদের মধ্যে চারটি মাজহাব অনুসরণ প্রচলিত আছে (অর্থাৎ চারটি গ্রুপ) এবং পণ্ডিতরা যুগ যুগ ধরে বলে আসছেন চারটি মাজহাবের সবগুলোই সহি, এদের যেকোনো একটি অনুসরণ করলেই একজন মুসলমান সুপথপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে দেখা যাচ্ছে এক মাজহাবের অনুসারীরা অন্য মাজহাবের অনুসারীদের অত্যন্ত নিকৃষ্ট বলে মনে করে, বিলকুল সহ্য করতে পারে না!
আমি হানাফি মাজহাব অনুসরণ করি।
আমাদের হানাফিদের মধ্যে মিলাদ পড়া নিয়ে প্রধান দুটি গ্রুপ আছে— একটি মিলাদের পক্ষে, অন্যটি মিলাদের বিপক্ষে। এরা দলগতভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং পরস্পরকে কাফের বলে ফতোয়া দেয়— এ আমি শৈশব থেকে দেখে আসছি।
আমি মিলাদ পড়ি।
আমাদের মিলাদপড়ুয়াদের মধ্যে আছে আরো দুটি গ্রুপ যারা প্রকাশ্যেই পরস্পরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছে— শৈশব থেকে দেখে আসছি! এদের একদল মিলাদের মধ্যে কিয়ামের পক্ষে আরেকদল মিলাদের মধ্যে কিয়ামের বিপক্ষে!
আমি কিয়ামসহ মিলাদ পড়ে অভ্যস্ত যেহেতু এ গ্রুপেরই শিক্ষকদের কাছে আমি ইসলামের পাঠ নিয়েছি।
কিয়ামসহ মিলাদ-ওয়ালাদের আরো দুটি গ্রুপ— একদল দাঁড়িয়ে কিয়াম পালনের পক্ষে আরেকদল বসে কিয়াম পালনের পক্ষে। বসে যারা কিয়াম করে তারা অন্যদের মুশরিক বলে ফতোয়া দেয়, কেননা ওরা বিশ্বাস করে কিয়ামের সময় রাসুল (দ.) সশরীরে অকুস্থলে উপস্থিত হন।
দাঁড়িয়ে যারা কিয়াম করে তারা বসে কিয়াম পালনওয়ালাদের কাফের বলে ফতোয়া দেয়; কেননা, তাদের মতে ওরা রাসুলের (দ.) সাথে বেয়াদবি করে!
আমি জীবনের কৈশোর পর্ব থেকে আমার ধর্ম ইসলাম খুঁজে আসছি কিন্তু এখনো উপধর্মের পাণ্ডারা আমার পথরোধ করে বসে আছে! কোথায় যাবো, কার কাছে?
তিন.
এ সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে ধর্মকে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার বানানোর ফলে। আমাদের দেশে যে-পরিমাণ মাদ্রাসা আছে তার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? ধর্মের প্রয়োজনে দেশে মাদ্রাসা দরকার অতি অল্প কয়েকটি যেখানে উচ্চ মেধাবীরা অধ্যয়ন করবে এবং ধর্মীয় ফিৎনার সমাধান দেবে। কিন্তু আমাদের বিপুল প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদ্রাসার পাঠ শেষ করে একজন মানুষ আবিষ্কার করে জীবনের কোথাও তার জন্য কোনো কর্মসংস্থান নেই একমাত্র মসজিদের ইমামতি ছাড়া। কারণ, মাদ্রাসাশিক্ষা পুরোপুরি অনুৎপাদনশীল (unproductive)। মাদ্রাসাশিক্ষা শেষে কেউ অর্থনীতির মূল স্রোতে প্রবেশ করতে পারে না। বিকল্প হিশেবে তারা আরো আরো নতুন নতুন মাদ্রাসা তৈরি করে সেগুলোর শিক্ষক হয়ে ওঠে আর বাড়তি উপার্জনের জন্য ওয়াজ করে বেড়ায়। ওয়াজ এখন আর নসিহতের পর্যায়ে নেই। ওয়াজেরও তৈরি হয়েছে বাজার-অর্থনীতি। ওয়াজকারী মৌলানারা এখন বাজারদখলের উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। তারা সরলপ্রাণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে বুঝাচ্ছে ওয়াজমাহফিলের অশেষ সোয়াব আর ফজিলত। ওয়াজমাহফিলগুলোতে অর্থায়ন করছে মূলত হতদরিদ্র সরলপ্রাণ জনসাধারণ এবং অবৈধ টাকার মালিকরা। হতদরিদ্র সরলপ্রাণ জনসাধারণ অর্থায়ন করে সোয়াবের আশায় আর কালো টাকার মালিকরা অর্থায়ন করে তাদের সামাজিক বৈধতা তৈরির নিমিত্তে। যেকোনো স্থানে একবারের জন্য ওয়াজমাহফিল বসাতে পারলেই কাজ সারা, মৌলানারা পরবর্তী বছরের মাহফিলের জন্য চাঁদা তুলে নিজেদের আর্থিক উৎস নিশ্চিত করে রাখে। ওয়াজ এখন রীতিমতো ইন্ডাস্ট্রি। নানান সুরে-গানে ঠাট্টা-মস্করায় আনন্দ-উৎসবহীন সরল মানুষের জীবনে মৌলানারা বিনোদন যোগানোর পাশাপাশি উপধর্মীয় গ্রুপের শক্তি সঞ্চয় করতে মরিয়া।
এ ওয়াজ ইন্ডাস্ট্রি আপাতত আমাদের স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে সীমিত রাখলেও যেকোনো মূহুর্তে তা আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হতে পারে। এখন ওয়াজ মানেই ফিৎনা।— ওয়াজের বিরুদ্ধে ওয়াজ, মৌলানার বিরুদ্ধে মৌলানা। এ ক্ষুদ্র পরিসরে শব্দদূষণের প্রসঙ্গ আর না-ই তুললাম। তবে, জনজীবন যে বিপর্যস্ত— এটুকু সকলেই অনুভব করতে পারছে।
এহেন পরিস্থিতিতে সরকার রাজস্বনীতির প্রয়োগ করে দেখতে পারে, তাতে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করি। প্রতিটি মাহফিলে বক্তাপ্রতি অন্তত ৫০০০/- টাকা করারোপ করা যেতে পারে। ৫ জন বক্তা মঞ্চে উঠালে সরকারকে ৫০,০০০/- টাকা কর দিতে হবে। এ আর্থিক চাপে একদিকে আলতুফালতু বক্তা ওয়াজের মঞ্চে উঠার সুযোগ পাবে না যা ফিৎনার পরিমাণ হ্রাস করবে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বিপুল পরিমাণে বাড়বে যা পদ্মাসেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ করে তুলবে।
আমাদের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এক্ষেত্রে আরেকটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে— ওয়াজের নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে। ওয়াজ করতে বয়সের একটা ন্যূনতম সীমা বেঁধে দেয়া হোক। ওয়াজ করতে বক্তার বয়স কমপক্ষে ৪০ বছর করে দেখা যেতে পারে। তাতে উত্তেজনার মাত্রা প্রশমিত হওয়ার কথা। মাথা-পাতলা বয়সের মৌলানাদের ওয়াজ নিষিদ্ধ করা হোক। বয়স একটা বড় বিষয়। জ্ঞান হজম করে শান্ত হতে বয়সের দরকার হয়। সমাজের প্রতি দায়বোধ তৈরি হতে বয়স দরকার হয়। অন্যদিকে, অল্পবয়সীরা খ্যাতির (fame) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গোপন করে চলতে অপারগ, এটা বয়সের দোষ। অল্পবয়সের খ্যাতি দ্যুতির পরিবর্তে দুর্গন্ধ ছড়ায় বেশি। এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুর্গন্ধ ছড়ানো আদমসন্তানের অভ্যাসে পরিণত হয়, সমাজে সমস্যা বাড়তেই থাকে।
তাঁর মাথায় প্রস্ফুটিত শরতের বিজ্ঞাপন দেখে বুঝতে পারি— তিনি প্রাজ্ঞজন। সবাই ভাবেও তেমন। শিক্ষকতা করেছেন আজীবন। তাঁর ছাত্ররা, আবেগের অতিশায়নে, তাঁকে উপাধি দিয়ে বসে— শিক্ষাবিদ! বিকৃত সামাজিক উল্লাসের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছিলাম একদিন। বক্তৃতা শেষে আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন— Adjustment is the best education! জবাবে অনেক কথাই বলতে পারতাম তাঁকে, তর্কে গেলাম না। বলতে পারতাম— আপনার কথা সত্যি হলে আমরা পাকিস্তানিদের সাথে adjust করে চলতে পারতাম, স্বাধীনতার কোনো দরকারই ছিল না! তাঁকে জিজ্ঞেস করার ছিল— তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালালদের দোসর কি না? সামাজিক সম্ভ্রমের কারণে বলা হয় নি! তাঁকে বলার ছিল— বিকৃতির সাথে adjust করতে করতে কি এভাবেই আমরা একদিন ধ্বংস হয়ে যাব? adjustment সবক্ষেত্রে best education এর নিশ্চয়তা দেয় না। বিকৃতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ না করলে শিক্ষা কীসের জন্য! ঐ adjustment এর শিক্ষা এবং অভ্যাস নেই বলে আমরা অনেকেই এখনো সৎ আছি, প্রতিবাদ করছি অন্যায়ের, বিকৃতির, অশুভ শক্তির। আমরা নিজেদের তরুণ রেখে দিয়েছি আজীবনের জন্যে। ঐ adjustment এর স্বভাব রপ্ত করি নি বলে জীবন এতোটাই অসফল, এতোটাই বেদনাদায়ক!