অসমে প্রাদেশিকৃত (সরকারি) ও অনুদান প্রাপ্ত সাত শতাধিক (৭০৬টি) টাইটেল মাদ্রাসা, এরাবিক কলেজ, সিনিয়র মাদ্রাসা ও প্রি-সিনিয়র মাদ্রাসা বন্ধ করে সে-সকল মাদ্রাসাকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে রাজ্য সরকারের মন্ত্রীসভা গত দু দিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখ্য, এ-মুহূর্তে রাজ্যে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত টাইটেল মাদ্রাসা ১টি ও প্রাদেশিকৃত টাইটেল মাদ্রাসা ১৪টি। সরকারি প্রাদেশিকৃত এরাবিক কলেজ ৪টি। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত সিনিয়র মাদ্রাসা ৩০টি ও প্রাদেশিকৃত সিনিয়র মাদ্রাসা ১৩৩টি। সরকারি অনুদান প্রাপ্ত প্রি-সিনিয়র মাদ্রাসা ২৭৪টি ও প্রাদেশিকৃত প্রি-সিনিয়র মাদ্রাসা ২৫০টি। সব মিলিয়ে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ও প্রাদেশিকৃত মাদ্রাসা ও এরাবিক কলেজের সংখ্যা ৭০৬টি।
সম্প্রতি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পূর্ত দফতরের মন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এক সাংবাদিক সম্মেলনে উপরোল্লিখিত ৭০৬টি মাদ্রাসা ও এরাবিক কলেজ অচিরেই বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, সরকারি অর্থে ধর্মীয় শিক্ষাদান বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত। রাজ্যে প্রাদেশিকৃত সংস্কৃত টোলও একই সঙ্গে বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেন হিমন্তবিশ্ব শর্মা। উল্লেখ্য, রাজ্যের সিনিয়র মাদ্রাসাগুলোতে ইন্টারমেডিয়েটে মাদ্রাসার সিলেবাসের পাশাপাশি SEBA অনুমোদিত (অসম মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ) মাধ্যমিকের সিলেবাস পড়ানো হয়ে থাকে এবং ইন্টারমেডিয়েট পাশ প্রার্থীদের মাধ্যমিকের সমতুল্য বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়ে থাকে।
মাদ্রাসাগুলোতে নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে মাদ্রাসা ছাত্রদের সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠন যখন দাবি জানিয়ে আসছে, তখন সরকারি এই সিদ্ধান্ত অনেকের নিকট বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো! আগে থেকে কাউকে বিন্দুবিসর্গ না-জানিয়ে সরকারি এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন সোচ্চার হয়েছেন। সরকারি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে কয়েক হাজার শিক্ষক কর্মচারীর ভবিষ্যৎ যেমন অনিশ্চিত হবে, তেমনই বৃহৎসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর জীবনে অন্ধকার নেমে আসতে বাধ্য।
অনেকে সরকারি এই সিদ্ধান্তকে চরম অমানবিক ও মুসলিম-বিদ্বেষী বলে অবহিত করছেন। কেউ কেউ মাদ্রাসা বন্ধ করার সরকারি এই হঠকারী সিদ্ধান্তকে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির শোচনীয় ‘পরাজয়ের বদলা’ বলে জ্ঞান করছেন। কারণ, দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিমদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও শাহিনবাগের আন্দোলন বিজেপি নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেনি! তা ছাড়া, নাগরিকপঞ্জি নবায়নের মাধ্যমে বিজেপি সরকার চেয়েছিল রাজ্যের সিংহভাগ মুসলিমকে ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ পুশ-ব্যাক করতে! কিন্তু সেই গুড়ে বালি পড়েছে! রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ জনগণ হচ্ছেন মুসলিম। ফলে এঁদের দাবিয়ে রাখার লক্ষ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উটকো সমস্যা সৃষ্টি করে!
মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বিষয়টি নিয়ে আইনি লড়াই করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁরা মনে করেন, সরকার বিভিন্নভাবে মুসলিমদের প্ররোচিত করে রাজ্যে একটি অস্থির বাতাবরণ তৈরি করে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক স্ফীত করার অপচেষ্টা করছে। পাশাপাশি, আইন-শৃঙ্খলার অজুহাত দেখিয়ে সরকার নির্বিচারে মুসলিমদের হাজতবাসে পাঠাতে তৎপর হয়ে উঠবে! ফলে, সরকারের ফাঁদে পা না-দিয়ে আইনের আশ্রয় নেয়া উচিত। অপর একটি অংশ মনে করেন, বার বার মুসলিমদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে! এবার হেস্তন্যস্ত হওয়া উচিত। অসমের প্রাক্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ সরকারের এই সিদ্ধান্তে ব্যাপক চটেছেন। তিনি বলেন, তিনি নিজে যোরহাটের মাদ্রাসায় পড়ে তিন বার অসমের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। সাংসদ হয়েছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন। মাদ্রাসায় পড়ে অনেক বিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী হয়েছেন। মাদ্রাসা বন্ধ করার তিনি ঘোর বিরোধিতা করেছেন। বিশেষত, তাঁর পনেরো বছরের কার্যকালে বৃহৎসংখ্যক মাদ্রাসা প্রাদেশিকৃত (Provincialised) হয়েছিল।অপর দিকে সংস্কৃত টোল থেকে সার্টিফিকেট জালিয়াতির নজির ভূরি ভূরি! পাঠগ্রহণ ছাড়া-ই সরকারি চাকরি ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অসাধু ব্যক্তি টোল থেকে অর্থের বিনিময়ে ‘সার্টিফিকেট’ লাভ করে থাকে।
উল্লেখ্য, গত বছর রাজ্য সরকার সরকারি মাদ্রাসাগুলোতে শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটির পরিবর্তে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি বলে ঘোষণা করে। পাশাপাশি, রমজান মাসের বন্ধ বাতিল করে দেয়! এর আগে মাদ্রাসাগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা বোর্ডও ভেঙে দেয় রাজ্য সরকার। এদিকে, গত দু বছর আগে বাঙালি হিন্দুর দুর্গা পুজোর ছুটি এক মাসের পরিবর্তে চার দিন বলে ঘোষণা করে! যদিও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পরবর্তিতে দুর্গা পুজোর ছুটি চারদিন থেকে বৃদ্ধি করে নয় দিন করা হয়।
মাদ্রাসা বন্ধের সরকারি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে তুলপাড় সৃষ্টি হলেও রাজ্যের কোথাও অশান্তি বা আন্দোলনের খবর পাওয়া যায়নি এ পর্যন্ত। কেউ কেউ এ-নিয়ে আত্মসমালোচনা করে বলছেন, মুসলিমদের উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে ‘জালিম শাসক’ চাপিয়ে দিয়েছেন।
২০২১ সালের মার্চ মাসে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। অনেকেই সরকারি এই সিদ্ধান্তকে ভোট-ব্যাঙ্ক রাজনীতি বলে আখ্যায়িত করছেন। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু জনগণের সমর্থন যদি অনুকূলে নিয়ে আসা যায়, তাহলে রাজ্যে পুনরায় ক্ষমতা দখল বিজেপির জন্য শুধু সময়ের অপেক্ষা!