বিরক্ত হয়ে একদিন আমার শিক্ষার্থীদের বললাম— তোমরা যা শুরু করেছ তাতে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশ থেকে কেরানি পর্যন্ত আমদানি করা লাগবে। বিস্মিত হয়ে তারা সমস্বরে বললো— কেন স্যার! সেদিন তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাঠদানে মনযোগ দিলেও, আমার মনে হয়, যা বলার তা এখনই বলে নেয়া ভালো।
বাচ্চা পরীক্ষা দেবে, অভিভাবকদের ঘুম নেই— এ প্লাস পাবে তো! এ প্লাস পাবে তো! কিছু কিছু অভিভাবক আরো এক কাঠি সরস, তারা আবিষ্কার করে ফেলেছে গোল্ডেন এ প্লাস! এর নিচে কোনো কথাই নেই! বাচ্চা কী শিখলো তাতে কিছু যায়-আসে না। গোল্ডেন এ প্লাস পেতেই হবে। এই গোল্ডেন এ প্লাসের ধান্ধায় (মূলত আতঙ্ক বা ফোবিয়া) আমরা জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াচ্ছি, হাতে ধরা কিন্তু বাচ্চার হাত। ও দমবন্ধ হয়ে মরে গেলেও কিছু যায়-আসে না, এ প্লাস ধরা চাই। বাচ্চা এবং তাদের অভিভাবকদের জীবন থেকে শান্তি পালিয়ে গেছে। রয়ে গেছে কাগজে লেখা একটা এ প্লাস কিংবা ওই কাগজ অর্জন করতে না-পারার হতাশা। কেউ জিপিএ ৪.৯০ পেয়েছে, তো বাবা-মা’র মাথায় হাত, বাচ্চাকে গালিগালাজ, আদরসোহাগ বন্ধ! কোনো কোনো আবেগপ্রবণ বাচ্চা তাতে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলছে! আর কত জিপিএ পেলে তারা সন্তুষ্ট হবে? আর কত পেলে বাচ্চাটাকে ভালো বলবে? প্রতি বিষয়ের জন্য পৃথক পৃথক টিউটর, নানা কিসিমের কোচিং সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি, অন্তত এক ডজন বৃত্তি পরীক্ষায় (যা আদৌ কোনো বৃত্তি নয়, খ্যাতিলোভী কতিপয় ব্যক্তির স্ব-নামে বা পিতামাতার নামে চালু অপগণ্ড বিশেষ) অংশগ্রহণ করানো,… ইত্যাদির চাপে একেকটা বাচ্চার জীবন হাবিয়া দোযখে পরিণত হয়েছে। খেলাধুলা নেই, সামাজিক মেলামেশা নেই, মামার বাড়ি, ফুফুর বাড়ি, খালার বাড়ি যাওয়া নেই, শুধু গাইড বা নোট মুখস্ত করার প্রতিযোগিতা আর টেনশন তাদের চব্বিশ ঘন্টার সঙ্গী! তাতে তৈরি হচ্ছে সমাজবিচ্ছিন্নতা এবং বিবিধ মনোবিকার, গড়ে উঠছে পরম আত্মকেন্দ্রিকতা বা স্বার্থপরতা। এভাবে কি বড় মানুষ তৈরি হয়? যখন শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো মানবসন্তানকে বড় করে তোলা। আমরা কি বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্ন থেকে দূরে গিয়ে টাকা কামানোর মেশিন তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছি? অভিভাবকদের কি দেখা নেই— অতীতের কত শত শত এ প্লাস নর্দমায় পড়ে রয়েছে? জীবন অভিনন্দিত করেছে শুধু তাদের— যারা প্রকৃতপক্ষে কিছু শিখে, মস্তিষ্কের বিকাশ সাথে নিয়ে সামনে গেছে।— এসব তাদের অভিজ্ঞতায় নেই? আহা রে শিক্ষা!
সাধারণ অভিভাবকদের কী আর বলব, অভিজ্ঞতায় যখন দেখলাম— একজন ইউএনও এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মিলে এসএসসি পরীক্ষার সেন্টারে সকল নিয়মনীতি ডিঙিয়ে, তাদের দুজনের সন্তানদের এক বেঞ্চে বসিয়ে, প্রতিদিনের পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরগুলো শিক্ষকদের দিয়ে তৈরি করে ওদের হাতে পৌঁছে দিয়ে এ প্লাস আদায় করে চলে গেলেন! এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে! যারা প্রতিকার করবে ঘটাচ্ছে তারাই! কার কাছে গিয়ে কী বলবেন!
প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষাগুলো তো সাধারণভাবে এখন শিক্ষক বা অভিভাবকরাই দিয়ে থাকেন (পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাসহ)! তো এই বাচ্চাদের হাঁটু-কোমর ভেঙে যে উপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আমরা, ওরা কীভাবে উচ্চতর শ্রেণির বিদ্যা অর্জন করবে? ওরা কীভাবে আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর আর নৈতিক মানুষ হয়ে উঠবে? এক টুকরা কাগজ অর্জনের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে একটা গোটা জাতিকে ধ্বংস করে ফেলছি তা কি কেউই বুঝতে পারছি না!
প্লিজ, এখনই থামান আতঙ্কজনক এ খেলা। দেশের ভবিষ্যৎ পঙ্গু করে কে নিরাপদ থাকতে পারবে— বুকে হাত দিয়ে বলুক। শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থতা ফিরে আসুক। মনে রাখুন— একটা এ প্লাস-ই জীবনের সারকথা নয়! মানবসন্তানের জীবন এভাবে ব্যর্থ করে দেবেন না। এ প্লাসের পরিবর্তে বাচ্চার মস্তিষ্কের বিকাশের দিকে, তার সৃজনশীলতার দিকে নজর দিন। মনে রাখবেন— সকলের বিকাশ সমভাবে, অভিন্ন সময়ে হয় না, হবে না; সকল বাচ্চার স্বপ্ন একইরকম হয় না, হবেও না। অভিভাবক কিংবা শিক্ষক হিশেবে আপনার কাজ হচ্ছে বাচ্চার ভেতরের অগ্নিস্ফুলিঙ্গটুকু যথাসম্ভব উসকে দেয়া, তাতেই অসাধ্য সাধন হবে।
আমরা যে-পথে হাঁটছি তাতে আদমপাচারকারীদের হাত ধরে প্রবাসে গিয়ে জীবন গড়ার জন্য প্লাস্টিকের নৌকায় সাগড় পাড়ি দিতে অথৈ সমুদ্রে ডুবে মরা ছাড়া অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দেখছি না!
খালেদ রাজ্জাক: কবি, শিক্ষক ।