হাজী মিম্বর আলী বিয়ানীবাজার উপজেলার মোল্লাপুর ইউনিয়নের মোল্লাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতা মরহুম হাজী ফরজমন্দ আলী ও মাতা গোলজাহান বিবি । ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে মিম্বর আলী তৃতীয়।
তিনি মাধ্যমিক স্কুলে অধ্যায়নরত অবস্থায় পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মিম্বর আলীর পিতা ছিলেন বৃটিশ জাহাজে কর্মরত। পিতা বার্ধক্য জনিত কারণে জাহাজে কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলে পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে, পিতার নলি ( কাজের পরিচয়পত্র ) নিয়ে তিনি বৃটিশ জাহাজে কর্মজীবন শুরু করেন । বৃটিশ জাহাজের কর্মজীবনের একপর্যায় ১৯৫৯ সালে জাহাজ বৃটেনে নোঙ্গর করলে তিনি বৃটেনে বসবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং কর্মজীবন শুরু করেন ।
বৃটেনে প্রথম জীবনে বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করলেও সময়ের ব্যবধানে মানিট্রান্সফার, ট্রাভেল ও রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায় যুক্ত হোন এবং সফল হোন। ব্যবসার পাশাপাশি মিম্বর আলী সামাজিক, রাজনৈতিক ও জনকল্যাণ মূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন । রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রথমে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ইউকে আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করা হলে বাংলাদেশি বৃটেন প্রবাসিরা শেখ মুজিব ডিফেন্স কমিটি গঠন করে । মিম্বর আলী সেই কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন ।১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙ্গালীর উপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তখন বৃটেনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে বৃটেনের বিভিন্ন শহরে সভায় যোগদান সহ সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ থেকে প্রাণ ভয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া মানুষের অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য বৃটেনে যে ফান্ড গঠন করা হয়, সেই প্রক্রিয়ায় মিম্বর আলী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া মানুষের সাহায্যের জন্য বৃটেন থেকে প্রথম যে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল ভারতের করিমগঞ্জ গিয়েছিলেন, মিম্বর আলী সেই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন । প্রতিনিধি দল মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে দেখেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনী জিনিসপত্র কিনে দেন । তাদের কাছে থাকা অতিরিক্ত ফান্ড ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে হস্তান্তর করেন ।
এছাড়াও মিম্বর আলী তার ব্যক্তিগত ছয় হাজার পাউন্ড দিয়ে লন্ডন থেকে কেনা উচ্চক্ষমতা সম্পূর্ণ একটি রেডিও ট্রান্সমিটার আনুষ্ঠানিক ভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে হস্তান্তর করেন। যা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও প্রচারণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মিম্বর আলীর এই কর্ম তৎপরতার সংবাদ তৎকালীন পাকিস্তানি গুয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে পৌছায় । অন্যদিকে তার পিতামাতা ভাইবোন আওয়ামী লীগ এর সমর্থক হওয়া এবং তার ছোটভাই ছাদ উদ্দিন আহমদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার অপরাধে ১৯৭১ সালে ২৩ জুলাই শুক্রবার জুম্মার আযান চলাকালীন সময়ে মিম্বর আলীর পৈতৃক বসতঘর রাজাকারদের সমন্বয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন ধরিয়ে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়। পরবর্তিতে পাক হানাদার বাহিনী তাদের সিলেট শহরের বাসাটিও পুড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জল অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস ২০০৪ সালে বাংলাদেশের তেত্রিশতম স্বাধীনতা দিবসে স্বাধিনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মিম্বর আলীকে মরণোত্তর সম্মান প্রধান করে।
মিম্বর আলী রাজনৈতিক জীবনে পরবর্তিতে বিএনপিতে যোগদান করেন । ১৯৭৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে বিএনপির প্রথম রাজনৈতিক শাখা গঠনের লক্ষ্যে একটি আহবায়ক কমিটি গঠিত হয় । মিম্বর আলী সেই কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি একাধারে দুইবার সভাপতি ও তিনবার আহ্ববায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
মিম্বর আলী রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনেরও দায়িত্ব পালন করেন । তিনি যুক্তরাজ্যস্থ ‘পূর্ব পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ’ এর দুইবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন । যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত ঐতিহ্যবাহী ‘বাংলাদেশ সেন্টার এর ট্রেজারার ও ১৯৯০ সালে বিয়ানীবাজার জনকল্যাণ সমিতি ইউকে’র আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়াও তিনি দীর্ঘদিন বিয়ানীবাজার জনকল্যাণ সমিতির উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন।
তিনি ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ সেন্টারের ফাউন্ডার ট্রাস্টি, বিয়ানীবাজার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ট্রাস্টি এবং বিয়ানীবাজার জনকল্যাণ সমিতি ইউকে’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
সামাজিক কাজের অবদানের জন্য ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ সেন্টার ও বিয়ানীবাজার জনকল্যাণ সমিতি ইউকে ও বিয়ানীবাজার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পৃথক পৃথক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে।
বিভিন্ন শিক্ষা ও চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠান গঠনের ক্ষেত্রে মিম্বর আলীর অবদান রয়েছে। এর মধ্যে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ , মোল্লাপুর ইউনিয়ন হাইস্কুল, ব্রিকলেন জামে মসজিদ, লন্ডন অন্যতম ।
বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা লগ্নে তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন এবং প্রথম সভাসহ অন্যান্য সভায় উপস্থিত থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। সভায় আলোচনা সাপেক্ষে মিম্বর আলী’কে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় যে ,ব্রিটেনে বসবাসরত বিয়ানীবাজারবাসিকে কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ অবগত করা এবং সহযোগিতার জন্য উদ্বুদ্ধ করা। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃটেনে এসে মিম্বর আলীর সকলের সাথে আলোচনা করে নিজে এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে অর্থ উত্তোলন করে কলেজ প্রতিষ্ঠা কমিটির কাছে পাঠান।
মিম্বর আলী একাধারে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যবসা জীবনে সফলতার স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি পারিবারিক জীবনেও ছিলেন একজন সফল ও অনুকরণীয় পিতা । মিম্বর আলীর স্ত্রী নাম সুফিয়া খানম রাণী । তাঁদের সংসারে চার সন্তান । প্রথম সন্তান- শামীম আহমদ ,পেশায় এরোমেটিক ইঞ্জিনিয়ার। দ্বিতীয় সন্তান (একমাত্র মেয়ে ) জাজ স্বপ্নারা খাতুন লাভলী। তিনি বৃটেনে বসবাসরত এশিয়ান কমিউনিটির মধ্যে প্রথম বাঙালী মহিলা জজ । ২০০৬ সালে বৃটেনের বিচার বিভাগে নিয়োগের সময় বয়সের দিক দিয়ে সর্বকনিষ্ঠ বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। বর্তমানে বিচার বিভাগে জজ হিসেবে কর্মরত । তৃতীয় সন্তান প্রফেসর ডা. শফি আহমদ একজন বিশ্বখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ (বর্তমানে রয়েল লন্ডন হাসপাতালে কর্মরত ) এবং প্রথম ভার্চ্যয়াল সার্জন হিসাবে যিনি গুগল গ্লাসের মাধ্যমে ৩৬০ ডিগ্রীতে সরাসরি অপারেশন করে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন এবং বিশ্বব্যাপী ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসা শিল্প সহজলভ্য করে নতুন দ্বার উন্মোক্ত করেন । এছাড়াও প্রায় ৩৫টি দেশে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার আমন্ত্রণে ভার্চ্যয়ার এর্ন্টারপেনার হিসাবে নিয়মিত বক্তব্য রাখছেন ডা. শাফি আহমদ। চতুর্থ সন্তান -জামি আহমদ, একজন সরকারি চাকরিজীবী ।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক,বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও সংগঠক মিম্বর আলী ১৯ নভেম্বর ২০০০ সালে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাকে লন্ডন ফরেসগেইট কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
লেখক : আ নো য়া রু ল ই স লা ম অ ভি; কবি, সাংবাদিক, লন্ডন।